You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির

দেশটা কোন্ পথে যাইতেছে, তাহা আমরা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যে সকল ঘটনা ঘটিতেছে, তাহা শুধু অস্বাভাবিক, অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত বলিয়াই মনে হইবে না, জাতির কপালে চরম দুর্ভোগ না থাকিলে দিন দিন নূতন নূতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হইত না। সার্জেন্ট জহুরুল হকের বন্দী অবস্থায় থাকাকালীন বুলেটের আঘাতে মৃত্যু কতখানি হৃদয়বিদারক ঘটনা, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যেখানে আজ সর্বত্র দাবি উঠিয়াছে, ইহাদের মুক্তির জন্য, মামলা তুলিয়া লইবার জন্য, সেখানে এইরূপ একটি মর্মান্তিক ঘটনা কি করিয়া অনুষ্ঠিত হইতে পারিল, তাহা আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। সার্জেন্ট জহুরুল হকের শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি কি ভাষায় আমরা সান্ত্বনা জানাইব, তাহা জানি না। জাতির মন্দভাগ্য না হইলে এই প্রকার ঘটনা কেহ কল্পনাও করিতে পারে না। কি অবস্থায় এই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা আমাদের জানা নাই। তবে বন্দী অবস্থায় এইরূপ ঘটনা ঘটার দৃষ্টান্ত খুব কমই পাওয়া যাইবে। প্রকৃত ঘটনা হয়ত একদিন না একদিন উদঘাটিত হইবেই, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা দাবি জানাইতেছি, অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠানপূর্বক দোষী ব্যক্তিদের কোর্ট মার্শালে বিচার করা হউক: উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়াছে বা ঘটিতে পারে, তাহা এই বিয়োগান্ত পরিস্থিতিতেও আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু সামরিক হেফাজতে থাকাকালেই যখন এইরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়াছে, তখন জনমনকে সকল সংশয় ও সন্দেহ হইতে মুক্ত করার জন্য এই ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত ও আশু প্রতিকার ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার অন্য যে সকল আসামী সামরিক হেফাজতে আছেন, তাঁহাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন এবং তাঁহাদের অনেকে আমাদের নিকট এই দাবি তুলিবার অনুরোধ জানাইয়াছেন যে, অভিযুক্তদের অবিলম্বে জামিনে মুক্তি দেওয়া হউক। শুধু তাহাদের আত্মীয়-স্বজন এবং জামিনদারেরাই নয়, প্রয়োজন হইলে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও তাহাদিগকে নিয়মিত ট্রাইব্যুনালে হাজির করার দায়িত্ব বহনে প্রস্তুত আছেন।
মানুষের মৃত্যু কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। সকলকেই একদিন না একদিন মরিতে হইবে। কিন্তু যেভাবে সার্জেন্ট জহুরুল হকের অকালমৃত্যু ঘটিল, তাহা সারা জাতিকে শোকাভিভূত করিবে এবং ইহার কি সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে তাহা চিন্তা করিতেও আমরা শিহরিয়া উঠি। আশাকরি, সরকার অবিলম্বে অবশিষ্ট অভিযুক্তদের আত্মীয়-স্বজনদের ও দেশবাসীর তরফ হইতে যে দাবি উঠিয়াছে, মোকদ্দমা তুলিয়া না নেওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তদের জামিন প্রদানপূর্বক সেই দাবি পূরণ করিবেন এবং তাঁহাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সকলের মনে আস্থার ভাব জাগাইয়া তুলিবেন। গত দশ বছর অত্যাচার, অনাচার, কুশাসন ও বঞ্চনা, জেল-জুলুম মানুষকে এমনিতেই অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছিল, তার উপর সাম্প্রতিককালে গণ-জাগরণের মুখে কর্তৃপক্ষ যে নিষ্ঠুর দমননীতি গ্রহণ করেন তাহাতে আজ দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভ বিরাজ করিতেছে। এই আন্দোলনকালে দেশে অমন পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছিল, যাহাতে একটি লোকও নিরাপদ বোধ করিতে পারে নাই। অপর দশজনের মত যখন আমাদের ছেলেপিলে রাস্তায় বাহির হইয়াছে, তখন তারা গুলী খাইয়া মরিবে, না গ্রেফতার হইবে, এই দুর্ভাবনায় তাহারা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত আমাদিগকে অস্বস্তির মধ্যে কাটাইতে হইয়াছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে তখন যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছি, সেইরূপ এই দেশের অগণিত পিতা-মাতা একই দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়া দিনগুলি অতিবাহিত করিয়াছেন। মানুষকে অধিকার- বঞ্চিত রাখিয়া যে শাসনকার্য পরিচালনা করা হইতেছিল, সেই অগণতান্ত্রিক ও গণস্বার্থবিরোধী বিধিব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য আইন ও শৃংখলা রক্ষার নামে আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্র ও এদেশের মানুষের উপর যে জুলুম চালানো হইয়াছ, সেই বেদনাদায়ক ঘটনাবলী এবং ছাত্র-জনতার রক্তদানের কথা স্মরণ রাখিয়াও আমরা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনার জন্য আত্মনিয়োগ করিয়াছিলাম। দেশবাসীর এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এমনি সব ঘটনা এখনো ঘটিতেছে, যাহাকে উস্কানিমূলক না বলিয়া উপায় নাই। জানি না, ইহার পেছনে কোন উদ্দেশ্য রহিয়াছে, না ইহা কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা। তথাপি এই উত্তেজনা ও প্ররোচণার মুখেও আমরা দেশবাসীকে ধৈর্য সহকারে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আবেদন জানাইব। সার্জেন্ট জহুরুল হকও এই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে যে সকল কোমলমতি তরুণ ছাত্র-নওজোয়ান ও জনসাধারণ জুলুমের শিকারে পরিণত হইয়াছেন, তাঁহাদের বিদেহী আত্মা ও পরিবার-পরিজনকে আমরা এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি যে, তাঁহাদের ত্যাগ ও আত্মদান বৃথা যাইবে না এবং দেশবাসীর কাছে তাঁহারা চিরস্মরণীয় শহীদ হিসাবেই অমর হইয়া থাকিবেন। পরিশেষে ঢাকায় গতকল্য অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি যে সকল দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের সান্ত্বনা যে, গণবিক্ষোভ বাঙালী-অবাঙালী রূপ পরিগ্রহ করে নাই। যেকোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক শান্তিরক্ষা করিতে হইবে, সকল শ্রেণীর নাগরিকের নিকট ইহাই আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!