২১ চৈত্র রবিবার ১৩৭৭ , ৪ এপ্রিল ১৯৭১
-প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে ।তিনি ভারন্তের সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবেন।
–বগুড়া আওয়ামী লীগের জনাব আবদুর রহিম তালুকদার জীপ নিয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে বগুড়া পৌছলেন সঙ্গে আবু সাইদ এম পি। গাজীউল হক সাহেব বি এস এফ এর কর্নেল মুখার্জীকে লিখে দিলেন মনসুর আলী সাহেবকে নিরাপদে তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থার জন্য। (৯: ৪৯০)
–জিঞ্জিরা থেকে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সরিয়াকান্দি পৌছান সেখান থেকে বগুড়া যান। পরে কলকাতার উদ্দেশ্য যাত্রা করেন।
–লালমনিহাট পাকবাহিনী বহু বাঙালীকে হত্যা করে ছিল নিত্য দিনের সাধারণ ঘটনা
-চিরির বন্দনে পাকবাহিনী বালুপাড়া ও অনন্যা এলাকায় বহু বাঙালী হত্যা করা হয়
–পাকিস্তান বোমারু বিমান নরসিংদীর উপর বোমা ফেলেছিল ।(৯:৩৬)
–জিন্দাবাজার সিলেট শাখার ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৬/৭ বস্তা টাকা পাকিবাহিনীর ট্রাকে উঠায় নিয়ে যায়। প্রহারারত পুলিশদের হত্যা করে অস্ত্রগুলো নিয়ে যায়।
-মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন জনাব সাদেক খান ফেনী থেকে রামগড়ে মেজর জিয়ার সাথে মিলিত হয়।
–সিলেট জেলার লিয়াপাড়া চা বাগানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিট গুলির কমান্ডারগণ একত্রিত হন প্রতিরোধের যুদ্ধের সমস্যাবলী আলোচনা এবং সম্মলিত কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দশ্যে। এ বৈঠক যোগ দেন ই,পি আর এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত অবসর প্রাপ্ত কর্নেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী , লেঃ কর্নেল আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর কাজি শফিউল্লা, মেজর (অবঃ) নুরুজ্জামান , মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী আরও কয়েকজন। এই প্রথম বিদ্রোহী কমান্ডাররা তাদের আঞ্চলিক অবস্থান ও প্রতিরোধ খণ্ড খণ্ড চিত্রকে একত্রিত করে সারা দেশের সামরিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার সুযোগ পান। (মূল ধারা-৭১, পৃঃ ১৫) উল্লেখ্য এই বৈঠকে সমবেত সামরিক অফিসারবৃন্দ কর্নেল ওসমানীকে সমগ্র যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নেবার অনুরোধ জানান।
–মেজর মেহদী আলী ইমাম এর নেতৃত্বাধীন মুক্তিফৌজ খুলনার গোল্লামারীতে বেতার কেন্দ্র পাকবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণের তীব্রতার পাকসেনারা বেতার কেন্দ্র ছেড়ে খুলনা শহরে পালিয়ে যায়। (৯ খঃ পৃ ৫০৯) উল্লেখ্য এ আক্রমণের পাক সেনাদের মেজর সহ ৭৯ জন হতাহত হয়। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাবিব নামে ১৪ বছররের তরুণ শহীদ হয়।
–ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য মিঃ ফেনার ব্রক ওয়াজ এক জনসমাবেশে অবিলম্বে পূর্ব বাংলার ব্যাপক হত্যাকান্ড বন্ধের দাবী জানান। এ ছাড়াও তিনি সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি , পূর্ব বাংলা থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার এবং গণ পরিষদের বৈঠক আহবানের দাবী জানান।
–পাক সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং গণ পরিষদের বৈঠক আহবানের দাবী জানান।
–পাক বিশাল কামান নিয়ে নড়াইলের ওপর আক্রমণ চালায় এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। তিনশত মুক্তিফৌজ আনসার কামানের গুলিতে নিহত হয়।পাক বিমান বাহিনী সারাক্ষন নড়াইলের ওপর গুলী বর্ষণ করে। জনতার হাতে ২৯ মার্চ যশোরে ধৃত ১১৮ জন পাকসেনাকে মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী। বিচার করে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করেন এবং
কয়েক’শ বন্দীকে গুলী করে। এই দণ্ড কার্যকর করা হয়। (১৫ খঃ পৃ২০৭) উল্লেখ্য কামাল সিদ্দিকী সকল কর্মচারীদের ছয় মাসের অগ্রীম বেতন দিয়ে অফিস বন্ধ করে দেন। সক্ষম যুদ্ধাদের সীমান্ত পাড়ি দিতে নির্দেশ দিয়ে ঢাকায় তাঁর পিতা মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে তিনি সীমান্ত পাড়ি দেন ৭ এপ্রিল।
–দিল্লীতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠক শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ভারত পূর্ব বাংলা ঘটনার নিরব দর্শক হয়ে থাকবে না , কিন্তু আমাদের সকল ভাবাবেগকে সংযেত করাতে হবে। এ আস সি সি র এক বৈঠকে পূর্ব বাংলার জনগণকে সর্ব্বাতক সহযোগীতাঁর ঘোষণা দেয়া হয়।
একাত্তরের দশ মাস-৮
–তিনিদিন চট্টগ্রাম শহরের পতন ঘটলে পাকিস্তানী সেনারা ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিগে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ এপ্রিলের মধ্যে সেতুরনিকট তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোল। এই সময় শ্ত্রুরা ছিল আক্রমণমুখী এবং মুক্তিফৌজদের ভূমিকা ছিল আত্মরক্ষামূলক।
(৯খঃ পৃ ১০৬)
–এদিন রাত দশটায় মুক্তিবাহিনী তিনভাগে বিভক্ত হয়ে নৌকায় পার হয়ে শেরপুরে অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ৫ এপ্রিল ভোর পাঁচটার সময় পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু হয়। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। পাক সেনাদের মর্টারের গোলার আঘাতে অনেক ঘর বাড়ি ধ্বংস হয় এবং অনেক গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। এ যুদ্ধে অধিকাংশ পাকসেনা নিহত হয়। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অনেকে আহত হন। শাদিপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ সময়ে মেজর দত্তের অনুরোধে মেজর শফিউল্লাহ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসাবে কর্তব্যরত) ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য মেজর দত্তের সাহায্যে পাঠান। এ কোম্পানী কুলাউড়া, শেওলা , সূতারকান্দি , গোপালগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সিলেট শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে কদমতলীতে পাকসেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং পাক সেনারা সিলেট শহরে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আজিজ সুরমা নদীর তীরে প্রতিরক্ষা বুহ্য রচনা করেন। অন্যদিকে মেজর দত্ত শাদীপুর হয়ে সিলেটের পথে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিবাহিনী বিশ্বনাথ পুরে পাক বাহিনীর অবস্থানের ওপরে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে হতোদ্যম হয়ে পিছু হটে সিলেট শহরে পালিয়ে যায়। ৭ এপ্রিল শুধুমাত্র সিলেট বিমান বন্দর এবং লাকাতুরা চা বাগানের কিছু অংশ ছাড়া সিলেট জেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ( বিচিত্রা ২৬.৩.৯০)
লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দি অবজর্ভার ”—এ মস্কো সংবাদদাতাদের মুবারকা কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়,সোবিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানেরঅধিবাসীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও হত্যাজজ্ঞ বন্ধ করার জন্য ইয়িহিয়া খানের নিকট আবেদন জানান। ৩রা এপ্রিল তারিখে প্রেরিত এক কূর্টনৈতিক বার্তায় তিনি বলেন , সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের অধিকাংশ অধিকাংশ ভোটদাতার সমর্থন লাভের পর বাঙালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন সোভিয়েত ইউনিয়ানের পক্ষে উদ্বেগজনক। শক্তি প্রয়োগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা জটিলতর হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন ।তিনি এই সমস্যার শান্তিপূর্ন রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার অনুরোধ জানান।
—বিচারপতি চৌধুরী তাঁর “ প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি ” শীর্ষক স্মৃতিকথায় বলেন, বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়ার পর সোবিয়েত ইউনিয়নের মত একটি বৃহৎ শক্তি নীরব থাকেনী। “ এটা শুধু আমাদের জন্যই আশার কথা নয় , সকল দেশের মত নিপীড়িত মানুষের জন্যই আশার বাণী বহন করেছিল।” সোভিয়ত প্রেসিডেন্টের আবেদন সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনস্থ সোভিয়ত দূতাবাসে গিয়ে জনৈক উদ্ধর্তন কূটনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
(স্বা , সং, প্রঃ বাঃ- ৩৭ পৃঃ)
এদিন (রবিবার) দুপুর বেলা বাঙালী ছাত্রদের উদ্যোগে লণ্ডনে হাইড পার্কে একটি জনসমাবেশ এবং বিকেল বেলা ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাফালগার স্কোয়ারে প্রায় দশ হাজার লোকের এ জনসভায় অন্যান্যদের মধ্যে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রটারী শেখ আবদুল মান্নান, সুলতানশরীফ, আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেষ্টার) সাখাওয়াত হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু বক্তৃতা করেন। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় কার্য পরিচালনা করেন বি এইচ তালুকদার। এদিন সন্ধাবেলা হ্যাম্পষ্টেড টাউনে হলে শ্রমিক দলের প্রভাবশালী সদস্য জন এনালস এর সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববংগে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্য আহূত এই সভায় বক্তৃতাদান কারীদের মধ্যে লর্ড ব্রকওয়ে, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস মাকেল বার্নস, শেখ আবদুল মান্নান, মিসেস বিলকিস বানু, লণ্ডন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী সুলতান শরীফ ও ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-র সম্পাদক ফরিদ জাফরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লর্ড ব্রকওয়ে পূর্ব বাংলার ব্যাপারে জাতি সংঘের হস্তক্ষেপ দাবী করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে কোন প্রকার সাহায্য না দেওয়ার জন্য শ্রীলংকার প্রতি আবেদন জানান। পিটার শোর পূর্ব বাংলার হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং পূর্ব বাংলার জাতি সংঘের পর্যবেক্ষণ দল পাঠাবার জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পদক্ষেপ গ্রহনের দাবী জানান। মাইকেল বার্নস শরনার্থীদের সাহায্য দানের ব্যাপারে আলোচনা করে সময় অপচয় করার আগেই পূর্ববংগ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করা বাঞ্ছনীয় বলে মন্তব্য করেন। ফরিদ জাফরী ও তারিক আলী পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাআন্দলোনকে আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে বলেন, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বাঙালীরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই সভায় কোন কোন বক্তা বাংলাদেশ সংগ্রামকে ভিয়েতনামের সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁর বক্তৃতা থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশের জীবনমরন সংগ্রামে প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য বন্ধুদেশের তারা প্রত্যাশা করেন। অধিকাংশ শ্রোতা তাদের একমত হন। (স্বাঃ সং প্রঃ বাঃ –পৃঃ ৩৮)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী