You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.06 | ২১ আষাঢ় ১৩৭৮ মঙ্গলবার ৬ জুলাই ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২১ আষাঢ় ১৩৭৮ মঙ্গলবার ৬ জুলাই ১৯৭১

পশ্চিমবাংলার বাগডোগরাতে (শিলিগুড়ি) বাংলাদেশের নির্বাচিত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ এক বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকে বিপ্লবী সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়। বক্তব্য রাখেন, খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, কর্নেল (অবঃ) এম.এ.জি. ওসমানী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বলেন, ‘আমরা যদি ভুল করে থাকি তবে দেশ স্বাধীন হলে আপনারা বিচার করবেন এবং আপনাদের রায় মাথা পেতে নেব’। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এটা ছিল প্রকাশ্য দলীয় বৈঠক। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের অভন্তরীণ মতানৈক্য প্রকাশ পায়। দ্রত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্বপক্ষে একদল আওয়ামী লীগের এম এন এ/এম পি এ চাপ দিয়েছেন।

-ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা জন্য নয়াদিল্লী পৌঁছেন। তাদের আলোচনা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে মার্কিনী অস্ত্র সরবরাহ স্থান পাবে মর্মে কূটনৈতিক ভাষ্যকারের মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

-ভারতীয় কাম্যুনিষ্ট পাটি (সিপিআই) ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অস্ত্রসহ সামরিক হস্তক্ষেপের দাবী জানায়। (সংবাদপত্র)

-মার্কিনী অস্ত্র পাকিস্তানকে সরবরাহএর প্রতিবাদে বোম্বাই, দিল্লীসহ দেশে অন্যত্র বিরাট ছাত্রজনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে ঐক্যমত্য প্রকাশ করে।

-কানাডীয় মিশন পাকিস্তানকে অস্ত্রসরবরাহের জন্য এদিন মার্কিনী নীতির সমালোচনা করেছে। (সংবাদ)

-আগরতলা (পূর্ব্বাঞ্চল সেক্টর) পরিদর্শন অভিজ্ঞতা  ও যুদ্ধরত নিয়মিত ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যা সম্বন্ধীয় দীর্ঘ প্রতিবেদন আব্দুল মালেক উকিল এম এন এ বাংলাদেশ সরকারের নিকট পেশ করেন। প্রতিবেদন উল্লেখ করেঃ গত মাসের ১৭ দিন যুদ্ধে সহস্রাধিক পাকবাহিনী নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ৭ জন নিহত এবং ৭০ জন আহত। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ অভিযোগ করেন- জীবনের বিনিময়ে আমরা দেশের জন্য ভাবছি সে ক্ষেত্রে সরকার তরফ থেকে তেমনভাবে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হারুন, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন জাফর, ক্যাপ্টেন গফফার তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি সেভাবে পাচ্ছেন না। রেশন, বস্ত্র, ঔষধ পর্যন্ত পূর্নমাত্রায় মিলছে না। এদের সকলের মনে অভিযোগ রয়েছে (সরকারী নথি থেকে)

–পিপলস পার্টির প্রধান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরান ও আফগানিস্তান সফরের প্রথম পর্যায়ে তেহরানের উদ্দেশ্যে করাচী ত্যাগ করেন।

-ব্রিটিশ সাংসদ আর্থার বটমলে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনীর নারকীয় গণহত্যার সত্যিকারে চিত্র তুলে ধরায় পাকিস্তান সরকার অস্বস্তিবোধ করলো। এদিন পাকিস্তানের সরকারী এক ভাষ্যে

বলা হলো, আর্থার বটমলে, এম পি’র সমালোচনা “unfair’। পাকসরকার পরবর্তীকালে সফররত কোন প্রতিনিধিদলকেই এসব ঘটনার কোনকিছু দেখতে দেয়ার পোগ্রাম বাতিল করে দেয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ সাংসদ দলের প্রতিবেদনে গণহত্যার সংবাদ

সত্য প্রমাণিত হওয়ার বিভিন্ন দেশের সাংসদগণ পাকিস্তান ও ভারতের শরণার্থী শিবিরের অবস্থা পরিদর্শন করতে আসেন। এসব দলের মধ্যে ছিলেন দু’সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্ট সদস্য। তাঁরা ৫ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে কি কি সুবিধা আছে তা দেখেন। ১০ জুলাই এলে অষ্ট্রেলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ লেন .এস.রীড। তিনি বন্যাপীড়িত রাজশাহী এলাকা পরিদর্শন করেন। ১৩ জুলাই এলেন কানাডীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল। তাঁরা খুলনা ও যশোরের কছু গীর্জা এবং চট্টগ্রামের বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শন করার সুযোগ পেলেন। ২৯ জুলাই এলেন পাকিস্তানের আর সি ডি’র সরমর্মী তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ গুলিক তিনি পাকিস্তানের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা বলে চট্টগ্রামের হস্তশিল্প দেখার সু্যোগ পেলেন। যাহোক, পাকবাহিনীর গণহত্যা সংবাদ পাল্টাতে চেয়েছিল কিন্তু গণহত্যা কাহিনী সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে গেল। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর দ্বারা শত শত ‘মাইলাই’ এর ঘটনার ইতিহাস গনহত্যার ইতিহাসকে ম্লান করেছিল। (সংবাদপত্র)

-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লেঃ জেনারেল এ, এ, কে নিয়াজী সিলেট এলাকার সীমান্ত ঘাঁটিসমূহ পরিদর্শন করেন এবং জোয়ানদের মনোবল অটুট রাখার পরামর্শ দেন।

-রংপুরের বুড়িমারীতে মুক্তবাহিনী ও পাক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

-“দি ডেইলি টেলিগ্রাফঃ পত্রিকায় বিশেষ প্রতিনিধি মিস ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ কর্তৃক ঢাকা প্রেরিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। তার কারণ, প্রেসিডেন্ট সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শক্তিশালী চরমপন্থী চক্রের মন রক্ষা করে চলতে বাধ্য। অবিলম্বে আপস-আলোচনায় ব্যবস্থা করা না হলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। মুক্তিযোদ্ধারা পাঁচ বছর কিংবা প্রয়োজন হলে এক যুগ ধরে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করবেই। কারণ, দেশের প্রায় প্রত্যেকটি লোক তাদের সমর্থন করে। সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিব কর্তৃক শতকরা ৯৬ ভাগ ভোট লাভ তার প্রমাণ। (“দি ডেইলি টেলিগ্রাফঃ ৬ই জুলাই,১৯৭১)

-অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেলেনঃ ‘আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম এবং যাঁদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছিলেন-১৩ এপ্রিল তারিখে বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথম  একত্রিত হলাম। উপস্থিত পরিষদের সদস্য বৃন্দের সামনে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করলাম।– স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমি আমার সহকর্মী পূর্বতম নির্দেশের বলে আমি জনাব খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাব মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রী আর জনাব এ, এইচ , এম, কামরুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেছিলাম…… আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করে নিঃসঙ্কোচে আর বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে সরকারের দায়িত্ব দিতে পারি। আমাদের সরকারের জন্মমুহূর্তে থেকেই কর্নেল এম,এ, জি ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে প্রধান সেনাপতি রূপে পেয়েছি।…। ক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করতে হয় যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায়। …ফারসী দেশের বীরনায়ক জেনারেল দ্যগল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যাণ্ডে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জেনারেল দ্যগল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্স অবতরণ করেছিলেন সেদিন হিটলারের বাহিনী তার সামনে টিকতে পারেনি।

দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আপনারা গঠনমূলক সমালেচনা দ্বারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। মনে রাখবেন বর্তমান মূহূর্তে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যের। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি আমাদের অবলম্বন। বিশ্বের নির্যাতিতি মানুষের স্বাধীনতার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতির পাশেই দাঁড়াব। চীনের বর্তমান নায়কেরা যায় বলুক না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পোষণ কর না। আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—যদি আপনাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনদিন বিচ্যুতি দেখেন, আপনারা আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এক সংকট মুহূর্তে, জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজার হাজার সৈনিক বন-প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহূর্তে আর একবার আপনারা আস্থা জ্ঞাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দীন সাহেব দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে পাশে সংগ্রাম করেছে, বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই মোস্তাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাঁদের উপর আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। … সমালোচনা উদ্দেশ্য হবে একটি কী করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করা যায়। (৪ খঃ পৃঃ ৫৪৭) উল্লেখ্য, এই বৈঠকে ৩৭৪ জন নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে-১৩৫ জন ছিলেন এম এন এ এবং ২৩৯ জন ছিলেন এম পি এ। সম্মেলন জুলাই ৬-৭, ১৯৭১ দুদিন শিলিগুড়ির বাগ ডোগরায় অনুষ্ঠিত হয়। (লেখক)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী