১৯ আষাঢ় ১৩৭৮, রবিবার, ৪ জুলাই ১৯৭১
এ দিন উত্তর রণাঙ্গনের গীতালদহ থেকে পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা ধরলা নদী অতিক্রম করে বিকেল পাঁচটায় তিনদিক থেকে মোগলহাটে পাক বাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর আচমকা আক্রমণে ১০/১২ জন পাক সেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের পাল্টা আক্রমণে নীলফামারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ ও আবু বকর শহীদ হন। মাইনের আঘাতে তিমলা খোগাখরি বাড়ির শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাতটি বি-৫৭ বিমান চেয়েছে মর্মে এক সংবাদও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
ঢাকার (দৈনিক পাকিস্তানে) প্রকাশঃ ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান শনিবার (জুলাই) পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অমর খানায় হামলা চালায়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর দ্রুততার সঙ্গে ভারত সরকারের নিকট –এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
পাকিস্তান লন্ডনের রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাক পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র এদিন বলেন যে, তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ –এর একজন প্রতিনিধি কর্তৃক পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণার জন্য সোসাইটির প্লাটফর্ম ব্যাবহারের বিরুদ্ধে লন্ডনস্থ পাক হাইকমিশনার বারবার প্রতিবাদ জানানো সত্ত্বেও সোসাইটি তা আগ্রাহ্য করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি ছিলেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী (উপচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। বিলেতে বাঙালী সমাজের স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বিশ্বে জনমনে বিরত আগ্রহ সৃষ্টি করে। কেননা, রয়েল কমনওয়েলস সোসাইটি রাণীর পৃষ্টপোশকতা পেয়ে থাকে। কমনওয়েলথ’ –এর ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে রয়েছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কমনওয়েলস বিষয়ক মন্ত্রী। পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ ছিল প্রবাসী বাঙালীদের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বিজয়।
বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র জনাব আমজাদুল হক দিল্লীতে এদিন, মুসলিম দেশ পাকিস্তানী অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার আবেদন জানান। তিনি বলেন, বাংলদেশ এখন বাস্তব এবং তর্কাতীত, ইসলামের নামে আর কোন সমঝোতা সম্ভব নয়। পাকবাহিনী মুসলিম নারীদের ওপর যেখানে চরম লাঞ্ছনা করেছে, মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। পাকিস্তান মহান ইসলাম ধর্মকে জঘন্যভাবে ব্যবহার করে মুসলিম দেশগুলোকে বিভ্রান্ত করেছে। বাংলাদেশে গণহত্যার ছাপাই গাইছে বৃহত্তর মুসলিম দেশের দোহাই তুলে। (১৪ খণ্ড পৃঃ ৮৪৪)
দিল্লীতে হিন্দু মৌলবাদী দল ‘জনসংঘ’ (বর্তমান বিজেপি)-এর নেতা অটলবিহারী বাজপায়ী বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও সশস্ত্র সাহায্যের দাবিতে ১ আগষ্ট থেকে ১১ আগষ্ট পর্যন্ত ( লোকসভার অধিবেশনের শেষ দিন পর্যন্ত) সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, অতীতে পুর্ববঙ্গ শরণার্থীর প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মতাবিরোধের কারণে ডঃ শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী মন্ত্রীপদ ত্যাগ করেছিলেন। সরকার তার দলের দাবি মেনে নিলে তিনি কেন্দ্রকে (ইন্দিরা সরকার) সমর্থন দান করবেন। (১৪ খঃ পৃঃ ৮৪৫)
-এস এসপি নেতা ও বিহারের মুখমন্ত্রী কপূরী ঠাকুর বলেন, পাক-ভারত যুদ্ধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভারতের উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। (সংবাদপত্র) উল্লেখ্য মে মাসের শেষ সপ্তাহে আওয়ামী লীগ নেতা মোল্লা জালাল উদ্দিন এম পি (ছদ্মনাম এ.কে.সেন) বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী সঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কথামত মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও কিছুসংখ্যক শরণার্থীদের ও আশ্রয় ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন।বিহারের মুক্তিযুদ্ধাদের সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হয়। (লেখক)
-ভারতের কৃষিমন্ত্রী জনাব ফকরুদ্দিন আলী আহমদের মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক সফর ব্যর্থ হয়েছে বলে জানা যায়। তিনি আরবলীগ মহাসচিব আব্দুস খালেক হাসুনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি লেবানন ও সিরিয়া সফর করেন। পূর্ববাংলার পাকসেনাদের গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা আলোচনায় প্রাধান্য পেলেও বাস্তব সাড়া পাননি। পাক কূটিনিতিক তৎপরতা এসব দেশে খুব ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। উল্লেখ্য, আরবদেশগুলো পাকিস্তানীর হানাদার বাহিনী বাহিনী নারকিয় হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ বা ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের উপর অত্যাচার সম্পর্কে সোচ্চার হয়নি।
পিএলও নেতা আরাফাত ও ইরাকের ছাত্র শ্রমিক শ্রেণী বিবৃতি দিয়ে গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। অন্যরা সাফাই গেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র দিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তীব্র প্রতিবাদ জানান।
সাতক্ষীরা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এ্যডভোকেট আবদুল গাফফার ভারত থেকে ফিরে এসে নিজে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করেছেন। ফেণী থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ওবায়দুল্লাহ মজুমদার সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসেন।
-পাকিস্তান বৃটেনের কাছে বৃটিশ পার্লামেন্ট, বিবিসি ও সংবাদপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদলিপিতে লন্ডনে বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ বৃটিশ নাগরিক ও বিদেশিরা (বাঙালীরা) যে কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে তার প্রতি বৃটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। লিপিতে বলা হয়, গ্রেট বৃটেনে বাংলাদেশের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাওবারুদের উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিবাদলিপিতে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের ২৩ জুনের বিবৃতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করা হয়।
-পাকিস্তান সরকার এদিন ১৫১ নং সামরিক আদেশের মাধ্যমে ১ নং সামরিক সেক্টরের ৯ নং উপসামরিক সেক্টরকে পুনর্গঠিত করে ১৩ নং উপ-সেক্টর সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অন্যদিকে,১৪৭নং সামরিক আদেশকে সংশোধন করে জারি করে ১৫২ নং সামরিক আদেশ।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী