১৯ চৈত্র ১৩৭৭ শুক্রবার ২ এপ্রিল ১৯৭১
- সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পোদ্গর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এক বার্তায় অগণিত মানুষের প্রাণহানি ও শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বন্দী ও নির্যাতন করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রাভদা লিখেছেঃ পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের উপর নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য এবং সমস্যা সমাধানের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে ( প্রেঃ ইয়াহিয়া) সন্নিবন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের স্বার্থ এবং সে অঞ্চলের শান্তিরক্ষার স্বার্থে এর ফলে রক্ষিত হবে। “ উদ্ভুত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানকে সমগ্র সোভিয়েট জনগন সন্তোষের সঙ্গে গ্রহণ করবেন ”।
- কুমিল্লা সীমান্তে মতিননগরের নিকট কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফের আলোচনায় যুদ্ধ পরিস্থিতি ওয়াকেবহাল হন। তিনি ঢাকা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করছিলেন।
- অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে পাক সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যায়। পরে মীয়ানওয়ালী কারাগারে বন্ধ প্রকোন্ঠে তাঁকে রাখা হয় বলে কুটনৈতিক সুত্রে জানা যায়।
- ঢাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে জিঞ্জিরা কলাতিয়ার রতন সাহেবের বাড়ীতে সর্বজনাব মুনসুর আলী, এ এইচ এম এম কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহম্মদ, আ, স, ম, আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন আশ্রয় গ্রহণ করেন।
- দুটো বোমারু বিমান যথেচ্ছ ভাবে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর ঘাঁটি ও নুরনগরে বোমা বর্ষণ করে।
- মিজানুর রহমান চৌধুরি এম, এন, এ, ( পরে প্রধানমন্ত্রী),আবদুল মাকেল উকিল এম, এন, এ, খাজা আহমেদ সহ বেশ ক’ জন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী ছোতাখোলা হয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা রওয়ানা হন। তারা রামগড় ও উদয়পুর হয়ে আগরতলা পৌছান। উল্লেখ্য রামগড়ে মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিক, জনাব তৌহিদ ইমামের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।
- দি টাইমস (লগুণ) এ লুইস হারেক লিখছেন ঃ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকসহ বহু রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
- স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ওপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর শেল বর্ষনে ক্ষতিগ্রন্থ হওয়ায় ৩০ মার্চ থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা সম্ভব হয় নি।
- পাক বাহিনীর জিঞ্জিরা অপারেশনের কোন তুলনা নেই সমকালীন বিশ্বে জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার মিলিটারী জ্বালিয়ে দেয়। চুন কুটিয়া শুভড্যা ধরে বরিশুর পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত মাইল এলাকা মিলিটারী ঘিরে ফেলে এবং নারী শিশু নির্বিশেষে যাকে হাতের কাছে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। নারীদেরকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছে। ক’জন কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ করেছে । সকাল সারে পাঁচটা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত চলে এই হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মত চরম বর্বরতা। (দৈঃ বাঃ ১৩/১১/৭২)
-ই, পি, আর, সেক্টর হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামে কর্মরত ক্যাপ্টেন রফিক উল ইসলামের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেশে সংগ্রহের উদ্দেশে ভারতীয় বি, এস, এফ, এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সচিন সিং এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ৯২তম বি এস এফ ব্যাটালিয়ন থেকে জরুরী অস্ত্র নিয়ে রামনগর পৌঁছে যান (৯ ১০২)
-মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে পরিচালিত সৈন্যরাই হানাদারদের অগ্রাভিযানে দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে বাধা প্রদান করতে সক্ষম হন। আখাউড়া কসবা যুদ্ধে খালেদ মোশাররফ বিপুল সফলতা অর্জনের পরও সুবিধাজনক অনুকুল অবস্থানের জন্য আগরতলার কাছে মতিনগরে পাহাড়ি এলাকায় সরে এসে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করেন। শালদা নদী, মন্দাভাগ, কসবা, বেলুনিয়া, পরশুরাম ও আখাউড়ার কিছু অংশে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বহু সফল যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
-পশ্চিম বাংলার শ্রীঅজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহন করেছিল। এ ফ্রন্টে সি পি আই(এম) নেতৃত্বাধীন ইউ এল এফ ছাড়া সকল দলেই শরীক হয়। শ্রী বিজয় সিং নাহার (কংগ্রেস) উপমুখ্যমন্ত্রী সহ ১৩ সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছিল। সিপি আই ও ফরওয়ার্ড ব্লক সরকার গঠনে সমর্থন দেয় কিন্তু মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়নি। পশ্চিমবাংলায় রাষ্ট্রপতি সাসন গভর্নর এস এস ধাওয়ান প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
-পাক বাহিনীর সেনাদল বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বিস্তার। রণাঙ্গনে দিসেহারা পাক সেনাদল প্রধানতঃ সহরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে আত্মরক্ষার সচেষ্ট। সর্বত্র পাক বাহিনীর নগ্ন বীভৎস আক্রমণ। বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে নাপাম বোমা, ট্যাংক থেকে বর্ষিত হচ্ছে গলা। বৃহস্পতিবার প্রায় সারাদিন স্যাবার জেট নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানঘাঁটি বাদ দিয়ে যশোরের সর্বত্র মুক্তিফৌজের আধিপত্য অক্ষুন্ন।( আঃ বাঃ পঃ)
-আকাশবানী, কলকাতা কেন্দ্রে থেকে পাকবাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার বিভীষিকাময় দিনগুলোতে সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট পোর্দগার্নি ইয়াহিয়ার কাছে লেখা পত্রের উদ্ধৃতি প্রচার করা হয়। এই আবেদন প্রতিবেশী ভারতের নয়। আই অনুজ্ঞা মহাশক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন পোর্দগার্নির ইয়াহিয়ার কাছে লেখা পত্রটি নিম্নরূপঃ
ঢাকায় আলোচনা ভেঙ্গে গেছে, সামরিক কর্তৃপক্ষ চরম ব্যবস্থা গ্রহণের পথ নিয়েছেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করেছেন – এই খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে । পাকিস্তানের যেসব মানুষ ঘটনার এরূপ আবর্তনের শিকার হয়েছে , দুর্ভোগ ও দুঃখ কষ্টে ভুগেন তাদের জন্য সোভিয়ত জনগণ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না । সাম্প্রতিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের সুস্পষ্ট সমর্থন প্রাপ্ত মিঃ শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন সোভিয়েত জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে । পাকিস্তানী জনগণের এই গভীর সংকটের দিনে আমরা বন্ধু হিসাবে একটি কথা না বলে পারি না । আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস বিশ্বাস করতাম এবং এখনো করি যে , পাকিস্তানে যে জটিল সমস্যা সম্প্রতি দেখা দিয়েছে শক্তি প্রয়োগ না করে রাজনৈতিক পথেই তা সমাধান করা যেতে পারে এবং অবশ্যই তা করতে হবে । পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতন ও রক্তপাত অব্যাহত থাকলে নিঃসন্দেহেতাতে সমস্যাগুলোর সমাধান বিঘ্নিত হবে এবং সমগ্র পাকিস্তানী জনগনের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের ক্ষতি হবে । মিঃ প্রেসিডেন্ট আমাদের জরুরী আবেদন , আপনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর নির্যাতন ও রক্তপাত বন্ধ করার আশু ব্যবস্থা নেবেন এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মীমাংসার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী