৩১ চৈত্র ১৩৭৭ বুধবার ১৪ এপ্রলি ১৯৭১
বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য সরবজনাব খোন্দকার মোস্তাক, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের দফতর ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ঐতিহাসিক বেতার ভাষণে পাঁচজন সেনাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করেন। মেজর জলিলকে বরিশাল,খুলনা ও পটুয়াখালী,মেজর খালেদ মোসাররফকে সিলেত,কুমিল্লা,মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম ও নয়াখালি,মেজর সফিউল্লাহকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং মেজর এম এ ওসমানকে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর রঙ্গাগন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
বিপ্লবী সরকারের সাথে যোগাযোগ ও অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য ফনি মজুমদার,আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ফরিদপুরসিটি আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক, বরিশালের আওয়ামীলীগনেতা এডভোকেট মহিউদ্দিন ফরিদপুর থেকে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে যাত্রা করে। ফরিদপুর আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন রয়েছে।
–ঢাকায় নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান মৌঃ ফরিদ আহমদ নেতৃত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় পাকিস্তানের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকরার জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
— মার্কিনী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস বলেছেঃ পূর্ববাংলার বড় বড় শহরগুলোতে ২০ ভাগ লোক বর্তমানে অবস্তান করছে, অনেক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোগ দিয়েছে। বহুজন নিহত হয়েছে।
একাত্তরের দশ মাস-১০
ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বাধীন মুলাডুলির বাহিনী বোনাপাড়া সরাসরি পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে এবং ৭ জন ইপিয়ার শহিদ হয়।প্রতিরোধকারী মুক্তিফৌজ অখান থেকে রাজশাহীর সরদার পথে সড়ে পড়ে।
পাকবাহিনী হাঁটহাজারী থানার ফতোয়াবাদ এলাকায় প্রবেশ করে নারী পুরুষ সহ ৭ জনকে হত্যা করে। মন্দির ধংস করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
–রাজশাহী শহরের অদুরে পদ্মাপাড়ের গ্রামগুলো পাকবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে অগ্নিসংযোগকারী যন্ত্রের সাহায্যে পুরিয়ে দেয়। হাজার হাজার আতঙ্কগ্রস্থ গ্রামবাসী পদ্মাপাড়ের চর এলাকায় পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে সমবেত হয়। থিক তখনই আবার হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান নিয়ে হাজার দেড়েক নিরপরাধ বাঙ্গালীদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
— পাকবাহিনী বিকেলে বাবুবাজার থেকে ঝিনাইদহ পতন ঘটায়। ৯খঃ পৃঃ৩৫৩।
–উল্লেখ্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ফণীভূষণ মজুমদার, সরয়ার মোল্লা, এডভোকেট হুয়মায়ুন(বরিশাল) সকালে রিকশাযোগে ঝিনাইদহে আওয়ামীলীগএম পি এ আব্দুল আজিজ তখন প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
–সারদা পুলিশ একাডেমীর প্রিন্সিপ্যাল (পরে আইজি পররাষ্ট্র সচিব) জনাব আব্দুল খালেক ঘাসের নৌকায় পাড়ি দিয়ে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর পৌঁছেন নিসঙ্গ ও অসহায়ভাবে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্তে ও প্রশাসনের সহায়তায় তিনি কলকাতায় যাত্রা করেন।
–সিলেট তামাবিল সড়ক ধরে মুক্তিবাহিনী হাবিব নগর মানিকগঞ্জ এবং খরিস নদীর তীর ঘেঁষে হেমু গ্রামে অবস্থান নেয় উদ্দেশ্যে সিলেট শহর দখল। কিন্তু স্থানীয় দালাল টিককা নিয়াজীর দোশররা পাক বাহিনীকে সব তথ্য জানিয়ে দেয়ার ফলে প্রচণ্ড লড়াই ও পাক বিমান হামলায় মুক্তি বাহিনীর বহু সদস্য শহীদ হন।
–সকাল ৯টা পাক বাহিনী ট্রেনের চারটি বগি ও সামনে পেছনে দু’টি ইঞ্জিন লাগিয়ে কুড়িগ্রামের খলিশগঞ্জ পৌঁছে যায়। জেলখানায় পাকবাহিনী গুলি মেরে ক’জন কর্মচারী ও সিপাহীকে হত্যা করে ফিরে যায় পথি মধ্যে ইগরাইহাটে ট্রেন পৌঁছার পর মুক্তিবাহিনী সঙ্গে তুমুল লড়াই হয় এতে পাকবাহিনী ১৫/১৬জন সৈন্য নিহত হয়।২২জনের লাশ ট্রেনে তুলে দ্রুত সরে পরে।মুক্তিবাহিনীর একজন আনসার আহত হয়।
–পাকবাহিনী দিনাজপুর শহর পুনদখল কালে অমানুষিক অত্যাচার চালায়। দিনাজপুর শহরের টেলিফোন ভবনে অনেক লোককে পাক সেনারা হত্যা করে। পীরগঞ্জ, সেতাবগঞ্জ,সগার মিলে হাজার হাজার নিরীহ লোক ও শ্রমিকদের হত্যা করা হয়। দাঃসুজাউদ্দিন, আব্দুর রহমান ও জনৈক অধ্যাপককে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে।সেতাবগঞ্জে ডাঃ তমিজুদ্দিন চৌধুরী, মুনিরুদ্দিন, দিনাজপুর কলেজের অধ্যাপক শাহ সুলেমান তৈয়ব পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। পাকসেনারা ঠাকুরগাঁ পঞ্চগড়, তেতুলিয়া ও বলিয়াডাঙ্গীতে অকথ্য অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড চালায় (১৫খঃ পৃ ৩৩০)
-ঢাকায় নেজামে পার্টির প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে পাকিস্তানে শত্রুদের যুদ্ধ করার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রস্তুতি থাকার আহবান জানানো হয়।
–নিউইয়র্ক টাইমস লেখেঃ ঢাকা,চট্টগ্রাম, কুমিল্লার মতো শহরে এখন সম্ভবত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোক রয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত সেনাদলের সামরিক আক্রমণে যারা বেঁচে গেছে তাঁরা প্রায় সবাই প্রতিরোধকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন।
–আগরতলা শিক্ষক প্রশিক্ষক কলেজের পরিত্যক্ত হোষ্টেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ সৈয়দ আলী আহসান, রশিদুল হক ডঃ কোরেশী, শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, ওসমান জামাল, এবং মেজর শামসুদ্দিন, মেজর শওকত, মেজর সফিউল্লার পরিবার আশ্রয় ভাল করে।
–আন্তর্জাতিক জুরষ্ট কমিশন জেনেভা থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলে যে, জুরিষ্ট কমিশন রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিশেষ সামরিক আদালতে যাওয়া উচিত।
–হানাদার পাক বাহিনী দিনাজপুর পৌরসভার সম্মুখে স্বাধিকার আন্দোলনের সৈনিক তথা স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মেতা আবু আহমেদ আসাদুল্লাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। উল্লেখ্য উনসত্তুরের গণ অভূথানের উত্তার দিনগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসাদুল্লা ঢাকা নিউ মার্কেটের কাছে মিছিলে পাক পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন।
–গঙ্গাসাগরে পাকিবাহিনী অবস্থানের ওপর মেজর খালেদ মোশাররফের মর্টারসেকশন নিয়ে তাঁর ২ টায় আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর ৩১ জন নিহত হয়। (৯:১৮৮) এই আক্রমণে ক্যাপ্টেন গফফার প্রথম সাফল্যজনক আক্রমন চালাল। মুক্তিফৌজের সবাই নিরাপদে ফিরে আসেন
–পাকবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়া বিমান থেকে গুলীকরে ফলে সাধারণ জনসাধারণসহ কিছু বাঙালী সৈন্য নিহত হয়। উল্লেখ্য সেদিন ব্রাক্ষণবাড়িয়া স্বাধীনতা পতাকা উড্ডীন থাকে। এস ডি ও জনাব রফিকউদ্দিন আহমদ তৎপর ছিলেন । প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরী করে গোকনহাটে ক্যাপ্টেন আব্দুল গাফফার , ক্যাপ্টেন শহীদ ও মাহবুবুর রহমান তাঁরা করোলা নদীর আশে পাশে অবস্থান নেয়। তত্ত্বাবধান করেন সেকেণ্ড লেফটেনেন্ট হারুনর রশীদ (৯:খ১৯১পৃঃ)
–ক্যাপ্টেন আইন উদ্দীণ নেতৃত্ব ব্রাক্ষণবাড়িয়া ইষ্টার্ণ মার্কে ষ্টাইল ব্যাংক থেকে ২ কোটি টাকা নিয়ে তোলিয়া পাড়ায় মেজর সফিউল্লাহের কাছে জমাদেন ।
–ন্যাপ (ভাসানী) নেতা মশিয়ুর রহমান কলকাতায় বামপন্থী নেতা দেবেন শিকদার সহ আরো আলোচনা করে ঠিক করলেন, রংপুর ডিমলায় ২৬ এপ্রিল এক বৈঠক সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য তাঁরা তখন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদখান ভাসানীর সংবাদ জানতেন না।
–দি টাইমস এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি ফ্রন্টের পক্ষ থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কলকাতায় অবস্থিত ব্রিটিশ কুটনৈতিক মিশনকে শীঘ্রই অনুরোধ জানান হবে। শেখ মুজিব এই নতুন রাষ্ট্রের নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ।
–পিটার হ্যাজেলহার্ষ্ট কতৃর্ক প্রেরিত এই রিপোর্টে একটি অসমর্থিত সংবাদের উল্লেখ করে বলা হয়, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাজউদ্দিন আহমদ শীঘ্রই একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করবেন
–চীন থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান মন্ত্রী চৌ এন লাই এক বাণী পাঠিয়েছেন।
–এই বানীতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে টা মূলতঃ অভ্যন্তরীণ ব্যাপ্রে বলে চীন সরকার মনে করে, ভারতের সম্প্রসারনবাদীরা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমাণাত্মক অভিযান শুরু করে তাহলে চীণের জন সাধারণ ও সরকার পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সমর্থন করবে ।
–ইতিমধ্যে পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ভুট্ট ও মওদুদী বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানের জন্য এয়ার কমোডোর জানজুয়া , তারিক আলী ফরিদ জাফরী, হামজা আলাভী ও অন্যান্য পাকিস্তানীদের রাষ্ট্রদোহী বলে প্রকাশ্যে নিদনা করে। উগ্রপন্থী পাকিস্তানী মোল্লারা তারিক আলী ও ফরিদ জাফরীকে কাফের বলে বর্ণনা করে এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার জন্য ভারতন সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা বিষোদগার করে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী