১৬ ফাল্গুন ১৩৭৭, সোমবার ১ মার্চ ১৯৭১
[১মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় গভর্ণর এ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে বরখাস্ত করা হয়। প্রাদেশিক সামরিক প্রশাসক লেঃ জেঃ সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বেসামরিক গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। জনতাবিমানবন্দর সড়কে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে । বিক্ষুব্ধ জনতার বাঁধভাঙ্গা জলরাশির ন্যায় চারিদিক থেকে শ্লোগান দিতে দিতে হোটেল পূর্বানীর সামনে জমায়েত হয়। পল্টন ময়দানে জনসভায় জনতা যোগ দেয় । দুপুর পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। স্টেডিয়াম ক্রিকেট খেলা চলছিল। রাজনৈতিক মহলে প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল আসন্ন জাতিয় পরিষোধের বৈঠক ।শাসনতন্ত্র, ছয়দফা, স্বায়ত্ব শাসন বিভিন্ন মহলেরও আলোচ্য বিষয় ছিল । পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ও কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংস খেলা চলছিল । প্রথম ইনিংস কমনওয়েলথ ৩৭৮ । পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ২০০। দ্বিতীয় ইনিংসে আট উইকেটে ৩০৬। খেলা ড্র নিশ্চিত। তবে শেষ বল্টি গড়া না পর্যন্ত কেউ কিছু জানেনা- অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। রাজনীতির মোচড়া খাওয়া আন্দোলনের মত।]
-১ মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুপুর ১-০৫ মিঃ এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে ৩ মার্চ তারিখে ডাকায় আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তিনি তার ভাষণে বলে, পাকিস্তান আজ চরম রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। সে সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি।…আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্ধোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহ অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছাবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছে । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক মোকাবিলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে । সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অথাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে ।
অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান পরবর্তী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।(দৈঃ পাঃ)
-জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে ভাইস এডমিরাল আহসানকে অপসারণ করেন। সামরিক প্রশাসক জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে গভর্নর অতিরক্ত বেসামরিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়। (সংবাদ ইত্তেফাক,দৈঃ পাঃ)
– রেডিওর ঘোষণা শোনা মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ সকম ছাত্রছাত্রী দলে দলে ক্লাস থেকে, হ’ল থেকে বেড়িয়ে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করে । সমুদ্রের এক একটা ঢেউ এসে ছড়িয়ে পড়ছে বটতলায় । ছাত্রলীগ আর ডাকসু নেতারা ঠিক করেন বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা করতে হবে।
-ইয়াহিয়া খান বেতারের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ছাত্র সহ সমস্ত শ্রেণির মানুষ বিক্ষভে ফেটে পড়ে এবং তারা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ঢাকা সঙ্গে সঙ্গে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল নগরীতে পরিণত হয় । স্কুল , কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, কলকারখানা, দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ হয়ে যায়। সংগ্রামী জনতার কাফেলা চারিদিক থেকে বায়তুল মোকাররম ও জিন্নাহ এভেনিউর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এ্যভিনিউ) দিকে আসতে থাকে, চারিদিকে কেবল জঙ্গী মিছিল, শেষ পর্যন্ত হোটেল পূর্বানীর সামনে এক বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়। ঐ হোটেল তখন আওয়ামীলীগ পরিষদ দলের সভা চলছিল।
(সংবাদপত্র)
_জয় বাংলা বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, “জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো” প্রভৃতি স্বাধীনতার শ্লোগানে ঢাকা মহানগরী আন্দোলিত। সেদিনই বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালীর হৃদয়ে ও রকে বাংলাদেশ জন্ম নিল।
_বিকেলে পল্টন ময়দানে এক স্বতঃস্ফূর্ত বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় সর্বজনাব তোফায়েল আহমদ, আবদুল মান্নান, সিরাজুল আলম খান, আ,স,ম আব্দুর রব ও নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ ছাত্র ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন এবং জনগণকে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।(দৈঃপাঃ)
—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঐ দিন বিকেলে হোটেল পূর্বনিীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কতৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি মঙ্গলবার ঢাকা শহরে হরতাল, বুধবার সারা দেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ (রবিবার) রেসকোর্সে জনসভা অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন।তিনি ৭ মার্চের জন সভায় পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচীর রূপরেখা দেবার কথাও ঘোষণা করেন। তিনি বললেন আমরা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবো,তবে আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য প্রস্থুত।জনগন ও আমার দল আমাকে যে কোন কর্মসূচী ঘোষনার ক্ষমতা দিয়েছে।বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা করলেন।নেতৃবৃন্দরা হলেন জননেতা মাওলানা ভাসানি,নুরুল আমীন,আতাউর রহমান, মুজাফফর আহমদ।তিনি বলেন, সকল বাঙ্গালীকেই জোট হতে হবে।আমি পূর্ব থেকেই বলেছি যে,ষড়যন্ত্রচলছে।-একমাত্র ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের মুসলীমলীগ ছাড়া আর সকল দলের পরিষদ সদস্য অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৩৫ জন গনপরিষদ ঢাকা এসে পৌছেছিলেন ।
-গভর্ণর ভাইস এডমিরাল এস, এম, আহসান পদত্যাগ করে।খ অঞ্চল (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা এম, ইয়াকুব খানের গভর্নরের বেসামরিক প্রশাসনের সাময়িক দায়িত্ব দেয়া হয়। সংবাদপত্রে অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোন খবর প্রকাশ করা যাবে না এই নতুন আদেশ জারি করা হলো।
-প্রেসিডেন্ড এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়িহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর গভর্নরদের নিয়োগদান করে এ সম্বন্ধে কিসিং কনটেম্প্ররারী আরকাইভস এ লিখেছেন :
“It was announced in Rawalipindi on the same day (March 1) that Gen. Yahya khan, in his capacity as president and CMLA, had appointed the following Martial law Administrators for the various provinces with immediate effect: Lieut-General Attiquer Rahman- Punjab; Lt. Gen, Rakhman Gul-Sind; Lt Gen Riaz Hussain- Baluchistan; Lt. Gen Azhar Khan North-West Frontier Province. The appointment of Lt.Gen. Tikka khan as Martial Kaw Administrator for East Pakistan was announced of March 7 All the Martial Law Administrators became Concurrently heads of the civil administrations-i.e assumed the functions of provincial Governors-in their respective provinces”(k.cA.pp-24566)
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রনেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনার নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ,স,ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এই চারজন এক গোপন বৈঠকে বিকেলে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। উল্লেখ্য একমাত্র ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দই সবধরনের ঝুঁকি নিয়ে ‘ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’ গঠন করে। অন্যছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কোন ঐক্যমত্য হয়েছিল কিনা তা সঠিক ভাবে জানা যায় নি। (সুত্রঃইত্তেফাক দৈঃপাঃসংবাদঃআজাদ)
-বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সংবাদ শিরোনামেঃ ১ লা মার্চঃ প্রথম সংবাদ (৪ কলম ব্যাপী) “ লাহোরের জনসভায় ভুট্টোর হুমকি/ পি,পি,পি কে বাদ দিয়ে পরিষদের অধিবেশন শুরু হইলে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন চালাইব” । (আজাদী)
-“দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম)” বনিক সংঘের সম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিব শাসনতন্ত্রের জন্য ভাল সুপারিশ একজন সদস্যার নিকট আসিলেও গ্রহণ হইবে। (আজাদী) অপর এক কলামে “এই রকম পাকিস্তান চাহি না ।” (আজাদী)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী