শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
দেশবাশীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ভাষন | বাংলাদেশ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় | ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ভাষণ
প্রিয় দেশবাসী এবং আমার সহকর্মীগন, শেষবার যখন আমি আপনাদের সামনে এসেছিলাম তারপর থেকে অনেক কিছুই ঘটে গেছে এই পৃথিবীতে। বাংলাদেশের জনগন যারা একটা প্রাণঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে আছে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে তাদের জন্য একটা অসামান্য অর্জন হল এই যে সামরিক জান্তার পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ক্ষমতার ঘাটি টালামাটাল করে দেওয়া এবং বাংলাদেশে তাদের কিছু নিরাপত্তা ক্ষেত্রের উপর থেকে নিয়ন্ত্রন হারানো। আমাদের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের অস্বীকৃতি, ভূমি ও সমুদ্রে আমাদের গেরিলাদের চমকপ্রদ দক্ষতা প্রদর্শন, দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়া শক্তি এবং প্রতিরোধ করার ক্ষমতার প্রবলতা হানাদারদের পরাজয়ের দিন খুব নিকটে নিয়ে আসছে। আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই ধৈর্য ও সংযমের শক্তির উপর – দুইটা জিনিজ আমাদের এমুহূর্তে বর্তমান অবস্থায় খুব বেশি প্রয়োজনীয়, আর তা হল পুরোপুরি ভাবে শত্রু নির্মূল করা এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের পুনঃগঠন করা। পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে যাচ্ছে। তার প্রমান পাওয়া যায় ইন্দো- সোভিয়েত চুক্তির মাধ্যমে শত্রুদের যে চেষ্টা ছিল তা সফল না হওয়ার মাধ্যমে। বাঙালিরা নিঃসন্দেহে তাদের শক্তির উপর নির্ভর করে যা তারা তাদের অবিস্মরণীয় সংগ্রামের দিনগুলোতে আবিষ্কার করেছে, আর সেখানে আত্মতৃপ্তি আছে কারন এটা এসেছে জনগনের সমর্থন থেকে যেখানে একসময় শুধুই সাবধানতা ছিল। কিছু সরকার তাদের অনৈতিক কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে, যদিও জনগণ আমাদের সাথে তাদের দ্ব্যর্থহীন একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আমরা শুধু আশা করতে পারি তাদের কাজকর্মের ফাঁকফোকর গুলো শীঘ্রই পরিসমাপ্ত হবে। নিঃসন্দেহে যে পাকিস্তানী আর্মির নীতিমালাই হল পুর্ব পাকিস্তানীদের ধ্বংস ডেকে আনা তারা এদের ত্রান সরবরাহ করবে তা বিশ্বাস করার মত মানুষ কেউ ই নাই পৃথিবীতে। একইসাথে জাতিসংঘও পর্যন্ত বাঙ্গালীদের জন্য অন্য জাতির পাঠানো ত্রানকে খোদ পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমেই দখলকৃত এলাকাসমূহে পানিপথে বিতরনকে সঠিক বলে মনে করছে, যেটা আসলে তাদেরই হেলিকপ্টার, জাহাজ আর যানবাহনে করে নেওয়া হবে যা আসলে আরো বেশি দমন পীড়নের পথ সুগম করে দেবে। জাতিসংঘের পীড়িতদের সাহায্যের জন্য গঠিত ত্রাণ বিতরন দলের কাছে ত্রানসামগ্রীর সাথে যোগাযোগের জন্য উন্নততর যন্ত্র থাকবে যা আদতে সন্দেহাতীতভাবেই পাকিস্তানী সৈন্যদলকেই সাহায্য করবে বেশি। এইসমস্ত কার্যক্রম আসলে এই মানবিক মিশনকেই গভীরভাবে বিপদগ্রস্ত করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব যদি এই অঞ্চলে জাতিসংঘের সম্মান রক্ষা করতে সত্যিই আগ্রহী হয় তাহলে অবিলম্বে বাংলাদেশে এই প্রহসনের ত্রান কার্যক্রম বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিক। আমাদের শত্রু স্পষ্টতই বর্বর তা ই নয় বরং তারা ছলনাপূর্ন এবং ছদ্মবেশী। আমাদের জনগনের যে মূল দাবী পূর্ন স্বাধীনতা তা থেকে দিকভ্রান্ত করতে তারা সময়ে সময়ে আপোষের ফর্মূলা উপস্থাপন করেছে যা আসলে কপটতাপূর্ণ। যদি আমাদের শত্রুরা আপোষ চায় তারমানে তারা দূর্বল হয়ে পড়েছে অথবা তারা আমাদের জন্য পরাজয় বরণের ফাঁদ পাতছে। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিকে এসে সামরিক জান্তা তাদের আশ্রয় হিসাবে বাংলাদেশে প্রশাসনিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দেওয়ার কথা বলে যা আসলে এড়ানোরই কৌশল। জেনারেল ইয়াহিয়ার বদলে তার ঘৃনিত দালাল জনবিচ্ছিন্ন টিক্কা খানকে অসামরিকভাবে জাতিসংঘে উপস্থাপন মূলত ছিল বাঙ্গালীদের নিন্দিত করার পাশাপাশি সেই এড়ানোর কৌশলমাত্রই যার উদ্দেশ্য আসলে বাংলাদেশে চলা সামরিক শাসন, গনহত্যা আর দমন পীড়নকে লুকনো। শত্রুরা একটি আপোষ করতে চায় কারণ হয় তারা দুর্বল অথবা তারা আমাদের জন্য একটি ফাঁদ পেতেছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সামরিক জান্তা বাংলাদেশের বেসামরিক লোকদের ভাল করতে চায় এই দেখিয়ে একটি প্রতারণা পূর্ণ কৌশল করে। জেনারেল ইয়াহিয়ার স্থলে ঘৃণিত টিক্কা খানকে আনা, বাঙ্গালীদের দুর্নাম করা, জাতিসংঘে পাকিস্তান কে তুলে ধরা এসব কিছুই ছিল সেই একই প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের অংশ যার দ্বারা সামরিক আইনের নির্মম সত্য, গণহত্যা এবং বাংলাদেশী জনগণের ইচ্ছাকে লুকানো হচ্ছিল। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছু সদস্যকে পদচ্যুত করে ইয়াহিয়া কাকে খুশি করতে চাচ্ছিল? অথচ অন্য সদস্যরা যথাস্থানে বহাল ছিল। অথচ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার উৎস জনগন এবং তারা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী দের অধীন নয় এবং নিজস্ব সমর্থক তৈরীর কৌশলের অধীনও নয়। এম এন এ এবং এম পি এ রা তাদের গত জুলাই এর আলোচনায় তাদের শপথ পূণরাবৃত্তি করে যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত কষ্ট সহ্য করবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত করবে না। তাদের সহায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলেও তারা শপথ থেকে বিচ্যুত হবেনা। বিশ্বের একটি অংশ বাঙ্গালীদের উপর চালানো গণহত্যা, সামরিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর উপর চালানো গোপন বিচার ও কারারোধ, এটর্নি দের মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ট্রায়াল নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশ্বকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি ৭ কোটি মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে মানুষরা তাকে ভালোবাসে এবং ক্ষমতায় দেখতে চায়। বাংলাদেশের জনগণের উন্নয়নে এতদিন সব সরকারই অন্তরায় ছিল। এই পর্যন্ত একটি নিষ্ঠুর চক্রের দৃষ্টিহীন দাম্ভিকতা এর উপর সামান্যই প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু আমি জনগণকে আস্বস্ত করতে চাই যে লোক দেখানো বিচারের মাধ্যমে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করছে তারাও শাস্তির সম্মুখীন হবে। এর মাঝে আমি ইসলামাবাদের সকল প্রভাবশালী জায়গায় শেখ মুজিবের নিরাপদ মুক্তির ব্যাপারে আবেদন করেছি। সম্প্রতি বাংলাদেশি কূটনৈতিক দ্বারা পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তের একটি বিরাট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেখা গেছে যে স্বীকৃতি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের একটি দ্রুততম এবং বিজয়ী উপসংহার। বাংলাদেশের জনগণ যারা দখলদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল যারা অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে তারা অন্ততপক্ষে যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এর কথা যারা বলে তাদের কাছে এরচে ভাল কিছু প্রাপ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের সাথে বন্যা নতুন করে আরেকটি দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।
দুঃখের জল, যা আমাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গ্রাস করেছে, শোষণের বিদ্রূপকারী নীতি যা বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ জন্য প্রদান অবহেলিত একটি অভিযোগ আছে. এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সমস্যা কেবল বাঙালিদের নিজেদের ভাগ্য ভার গ্রহণ করে সমাধান করা যেতে পারে. পরিমাপের হিউম্যান মান স্কেল এবং আজ বাঙালির অন্তর্বেদনা গভীরতা আগে ভাঙ্গিয়া, কিন্তু আমি বাংলা আত্মার স্থিতিস্থাপকতা বিশ্বাস করে, এবং নিশ্চিত যে এটা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের উপর বিজয় লাভ হবে মনে. পরিশেষে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যার সাহস, আত্নত্যাগ, এবং কৃতিত্বের অস্ত্র সকল ক্ষমতার গর্ব এবং একটি মহান ভবিষ্যতের জন্য আশা নিয়ে জাতি পূরণ করুন. বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের সংহতি সুসংহত করেছে. এই সংহতি শক্তি তাদের স্থায়ী উৎস হউক
জয় বাংলা।