৩০ শ্রাবণ, ১৩৭৮ সোমবার, ১৬ আগষ্ট ১৯৭১
-পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, সেক্রেটারী জেনারেলের আগষ্ট ১০ তারিখে প্রদত্ত শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কিত বিবৃতি জাতিসংঘ চার্টারের নির্ধারিত নীতিমালা বহির্ভূত। (দি ডন, করাচী)। উল্লেখ্য, গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ১১ আগষ্ট শুরু হলেও তা মুলতবী হয়ে যায়। সেপ্টেম্বর ৭ তারিখে বিচার পুনরায় শুরু হয়। বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা পরিচালনা করার জন্যে মিঃ এ কে ব্রোহী ও তার সহকারী মিঃ গোলাম আলী মেনন, মিঃ আকবর মীর্জা এবং মিঃ গোলাম হোসেনকে অনুমতি দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ দিল্লীতে ‘মুজিব বাহিনী’ নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে আহমেদ রেজা লিখেছেন, ‘এ সময়ে মুজিব বাহিনীর ব্যাপারটি গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দিল্লীতে এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ফিরে এসে মুজিব-বাহিনীর ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করলেন। মুজিব-বাহিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বিরোধী হওয়ার কারণে বিষয়টি তার জন্য রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতরছিল। এবং সে কারণে তার পক্ষে প্রত্যক্ষ ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মুজিব বাহিনী গঠনের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে প্রকাশ পেল। এই দ্বন্দ্বের মূলে প্রকৃতপক্ষে কোন রাজনৈতিক আদর্শবাদের কারণ ছিল বলে মনে হয় না। (একাত্তরে স্মৃতিচারণ পৃঃ১৪০) উল্লেখ্য, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের পর ভারতের সহযোগিতা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। এ সময়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাতেহ স্থির করা হয়, সেপ্টম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে কুড়ি হাজার করে মোট আরও ষাট হাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর জন্য গঠন করা হবে আর তিনটি ব্যাটেলিয়ান। (মূলধারা ৭১ পৃঃ৮১)
-বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর এদিন বাংলাদেশ দখলীকৃত এলাকা থেকে আনীত অর্থ ও সম্পদের সদ্ব্যবহার সম্পর্কে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন কএ। এই কমিশনের সদস্যরা হলে সর্বজনাব এ হান্নান চৌধুরী (চেয়ারম্যান), জয় গোবিন্দ ভৌমিক (সদস্য) এস বড়ুয়া (সদস্য-সচিব)। (৩ খঃ পৃঃ ৯৫) উল্লেখ্য, কমিশনের সদস্যগণ বিচার বিভাগের সদস্য ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব আবদুল খালেক (প্রাক্তন আইজি) স্মৃতিচারণে উল্লেখ করে যে, একটা সর্বগ্রাসী মুক্তিযুদ্ধ চালাতে যে অর্থ সম্পদের কথা ভাবা যেতে পারে তা আমাদের ছিল না। পাবনার ডেপুটি কমিশনার নুরুল কাদের খান (পরে সংস্থাপন সচিব) পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে একদফা সম্মুখ যুদ্ধের পর তার ট্রেজারির টাকা ভারতে এসে সেই টাকা প্রবাসী সরকারের (বাংলাদেশ সরকার, মুজিব নগর) হাতে তুলে দেন। তেমনি ট্রেজারির টাকা প্রবাসী সরকার পেয়েছিলেন প্রার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হোসেন তৌফিক ইমাম ও সাংসদ মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে থেকে। বগুড়া ষ্টেট ব্যাংকের টাকা আমাদের সরকারের হাতে আসেনি। সর্বসাকুল্যে সতেরো-আঠারো কোটি টাকায় চালাতে হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যায়।…অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলীর পরিবারকে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থানায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে বের করে কলকাতায় আনার খরচ বাবদ একশ’ টাকা তিনি জোগাতে পারেননি সাতদিনেও। পাবনা জেলার সাংসদ আব্দুর রহব (বগা মিয়া) কলকাতার এক বন্ধুর কাছ থেকে একশ’টাকা জোগার করে দেন এবং সেই টাকায় পুলিশ ইন্সপেক্টর গাজীউর রহমান বেগ মনসুর আলীকে কলকাতায় নিরাপদে পৌছাবার ব্যবস্থা করেন। (স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি, পৃঃ৬৬-৬৭) উল্লেখ্য, পুলিশ বাহিনীর প্রায় আট হাজার সদস্য সীমান্তের ওপার থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর সাংসদ আব্দুর রব (বগামিয়া) এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। মরহুম বগা মিয়ার মত ত্যাগী, নিরহংকারী সংগঠক বিরল। (লেখক)
-দিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, “শেখ মুজিবের বিচারকে আন্তর্জাতিক আইনের সর্বজনগ্রাহ্য ধারণার অবমাননা। তিনি আরো বলেন, শেখ মুজিব নির্বাচনে জয়লাভ করেছে-এটাই তার অপরাধ। “ At a press conference in New Delhi Senator Kennedy said on Aug. 16 that he was now convinced that the Pakistan Army had committed genocide in East Pakistan, and that the secret trial of Sheikh Mujibur Rahman, whose only crime was winning an election, was “an outrage and travesty of every concept of international law” The refugees would return, he added, only in the context of a political settlement under which Sheikh Mujib was released, and those with whom he had talked were without exception in favour of freeing themselves from Pakistani rule”
-এদিন রাতে অকুতোভয় বীর নৌ-সেনা মংলায় অবস্থানরত বিদেশী জাহাজ এম এস টাইটনিং কে লিমপেট মাইন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে। উল্লেখ্য, নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় দফা হামলায় ঐ জাহাজটি ডুবে যায়।
-এদিন ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত অর্দ্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুকি দাবী করার জন্য বিশ্ব জনমতের প্রতি আহ্বান জানান হয়।
-এদিন মার্কিন টিভি কর্তৃক প্রচারিত এক প্রোগ্রামে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী ভারতে বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিচ্ছে মর্মে অভিযোগ করেন। পাকিস্তানী কূটনীতিকের অভিযোগের প্রত্যুত্তরে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ এল কে ঝাঁ (লক্ষীকান্ত ঝাঁ) বলেন, ভারত-পূর্ববঙ্গ সীমান্ত উন্মুক্ত ও বিস্তৃৎ বলে টহল দেয়া অসম্ভব। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে থাকবে এটা অস্বীকার করা যায় না। উল্লেখ্য এ দিনেই ভারতীয় কূটনীতিক প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত অবস্থান করছে স্বীকার করলো।
-এদিন পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য মদদ দিচ্ছে। সুতুরাং, কাল বিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করে আসাম দখল করে নেয়া উচিৎ। তিনি বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের ৮৮ জন সাংসদের পদ বহাল থাকায় উদ্ধেগ প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, নভেম্বর মাসে পাক সরকার ঘোষিত জাতীয় সংসদের শূণ্য আসনে উপনির্বাচন হবে। পাকিস্তান সরকারের প্রথম ঘোষণা উপনির্বাচন সম্পর্কে ছিল নিন্মরূপঃ “ East Pakistan is to go t polls between November 25 and December 9 to elect 78 members to the National Assembly and 105 to its provincial Assembly, according to schedule announced by the Election commission of Pakistan on Sept 19, 1971)”
-এদিন পাক সামরিক সরকার ১৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনায়ন করে। ঐ ১৪ জন সাংসদকে ২২ আগষ্ট নাটোরের ২ নং সেক্টরের উপসামরিক আন প্রশাসকের সামনে হাজির হওয়ার নির্দ্দেশ দেয়। অভিযুক্ত সাংসদগণ হচ্ছেনঃ সর্বজনাব রিয়াজুদ্দিন আহমদ (রংপুর-২), মোশার্ফ হোসেন চৌধুরী (দিনাজপুর-১), আব্দুর রউফ (রংপুর-৯), মতিউর রহমান (রংপুর-১০), মোকসেদ আলী (দিনাজপুর-৩) মফিজ চৌধুরী (বগুড়া-১) মোহাম্মদ আজিজুর রহমান (দিনাজপুর-২), শাহ মাহতাব আহমদ (দিনাজপুর-৫) মজিবর রহমান (বগুড়া-২), মোতাহার হোসেন তালুকদার (পাবনা-১), আবদুল আওয়াল (রংপুর-৯), আব্দুল মোমিন তালুকদার (পাবনা-৩), আবু সাঈদ (পাবনা-৫), এ বি এম মোকশেদ আলী (দিনাজপুর-৩), এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (দিনাজ-৪)।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী