You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের
ঘোষণা
সূত্রঃ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল (প্রচারপত্র)
তারিখঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

গণ-বিপ্লব দিবসে মেহনতী জনতার নেতৃত্বেবিপ্লবী সরকার কায়েমের শপথ নিন
শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের ডাক

ভাইসব,

আটষট্টির অক্টোবরে করাচীর ছাত্রদেরস্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলনেরমাধ্যমে যে সংগ্রামের সূত্রপাত, উনসত্তরেরজানুয়ারী মাসে ঢাকায় ছাত্রদের সংগ্রামী জনতারবিপ্লবী ভূমিকায় সেই গণ অভ্যুত্থান ১৮ইফেব্রুয়ারি পর্যবসিত হয় এক রক্তাক্ত গণবিপ্লবে।আন্দোলন চলছে ছাত্রদের নেতৃত্বে,আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাহায্যপুষ্টস্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে। চলছে ধরপাকড়, গোলাগুলি। শহীদ হল আদমজীরশ্রমিক মুজিবুল্লাহ, বরিশালের শ্রমিকমজিদ, ছাত্র আসাদ, মতিয়ুর এবং নাম না জানা আরো অনেকে। সংগ্রামের রূপ হল আরো তীব্র,আগুন জ্বলে উঠল শহর থেকে বন্দরে, গ্রাম থেকে গঞ্জে। নেমে এল ‘কারফিউ’।এবার সংগ্রামে বলিষ্ট নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে এলো একনতুন শক্তি, ‘বিপ্লবী মেহনতী জনতা’। সে বৈপ্লবিক নেতৃত্বের সুবর্ণ সূচনাহলো কারফিউ ভঙের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে।

১৮ই ফেব্রুয়ারী, কারফিউ ভঙ্গ করে মালিবাগের মেহনতী জনতা মশাল হাতে নেমেএল ঢাকার রাজপথে; যোগ দিল তেজগাঁও, নাখালপাড়া,আদমজী আর ডেমরার বিপ্লবী শ্রমিক, যোগ দিল খিলগাঁও কৃষক, নেমে এলফার্মগেট, গ্রীনরোড, হাতীরপুল, পুরানা পল্টন এবং মগবাজার এলাকার দিনমজুরআর খেটে মানুষের, সহদাগরী আর সরকারী অফিসের ৪র্থশ্রেণীর কর্মচারী আর কেরানী; নেমেএল ছাত্র, শিক্ষক, ছোট ছোট দোকানদার আর রাস্তার পাশের ফেরীওয়ালারা, লাখোলাখো মানুষ, মেহনতী মানুষ, সংগ্রামী জনতা, লাঠি আরজলন্ত মশাল হাতে।

১৮ই ফেব্রুয়ারী, সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ উপায়ে কারফিউ ভেঙে রাইফেল আর বেয়নেটেরপৈশাচিক হামলাকে তারা রাস্তায় পদদলিত করে লক্ষ লক্ষ মারমুখী মেহনতী জনতাসেদিন নেমে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। রাস্তায় তুলেছিল বিপ্লবীব্যারিকেড, হাতাহাতি লড়াই করেছে তারা, রক্তে রক্তে সয়লাব হয়েছে ঢাকারকালো পীচ ঢালা পথ। তবুও তারা স্তব্ধ হয়নি। আগুন লাগিয়ে তারা জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর অনুচরদের সাজানোপ্রাসাদ। যে বিদ্রোহের আগুনের লেহিহান শিখায় খতম হয়েছে আইয়ুব সরকার, খর্বহয়েছে রাষ্ট্রের উপর থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতি, ভূ-স্বামী আর জায়গীরদারদেরঅপ্রতিদ্ধন্ধী প্রভাব। উন্মুক্ত হয়েছে গণতন্ত্রের পথ। ১৮ই ফেব্রুয়ারীপাকিস্তানের গণআন্দোলনের ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা একটি দিন’ বিপ্লবী দিন।

মেহনতী জনতার নেতৃত্ত্বে ১৮ইফেব্রুয়ারী কারফিউ ভঙ্গ এবং ঢাকা অবরোধ, বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীরনেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী সমাজবাদী বিপ্লবের সুবর্ণ সূচনা।

সাবাস। ঢাকার বিপ্লবী মেহনতী জনতা!

অমর হোক গণবিপ্লবের দিন, রক্তাক্ত ১৮ই ফেব্রুয়ারী।কিন্তু সুস্পষ্ট শ্লোগান, বর্তমান লক্ষ্য এবং সর্বহারাদের শ্রেণীভিত্তিকরাজনৈতিক দলের অভাবে এই গণবিপ্লবের সম্পূর্ণ ফল লাভ করার এক হীনষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে অনুন্নত অঞ্চলের পুঁজিপতি শ্রেণী। উদীয়মানপুঁজিপতিদের নেতৃত্বে জানুয়ারীর গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বৃহৎপুঁজিবাদ, জায়গীরদার জোতদারদের পৃষ্টপোষিত স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারেরউচ্ছেদ সাধন করে তথাকথিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন মেহনতী জনতার নেতৃত্বে ফেব্রুয়ারীর গণ-বিপ্লবে পরিণতহল, তখন এই গণ বিপ্লবের আপোষহীন আর রুদ্র রূপ দেখে এবং দেশের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী পরিণতির আশংকায়, একদিকে বৃহৎপুঁজিপতি, জোতদার- জায়গীরদার; অন্যদিকে স্বৈরাচারবিরোধী অনুন্নত অঞ্চলেরউদীয়মান পুঁজিপতিরাও আন্দোলনের উপরথেকে তাদের নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশংকায় ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের মধ্যেআপোষ রক্ষার মাধ্যমে এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায়মেতে উঠলো। সর্বদলীয় গোলটেবিল ছিল ফেব্রুয়ারিরর বিপ্লবকে বিপথে পরিচালনাকরার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের হাতে ফিরিয়ে নেবারজন্যই উদীয়মান পুঁজিপতিদদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরারা এই গোলটেবিলে যোগদিয়েছিলেন। দেশের সংবিধান রচনা এবং শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তরেরউছিলায় “আইনগত কাঠামোর” জোয়ালে বিগত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সেইষড়যন্ত্রেরই আরেক পর্যায়। জাতীয়তাবাদী সম্মোহনী শ্লোগানের মায়াজালে একঅভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করে এই উদীয়মান পুঁজিপতিরা নিষ্ঠুর আরনির্মমভাবে ব্যবহার করেছে এদেশের শোষিত মানুষের সহজ সরল আবেগকে, তাদেরশ্রেণীস্বার্থআদায়ের খোরাক আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। নির্বাচনেরফলাফল যাই হোক না কেন, দেশের সংবিধানের রূপ এবং কাঠামো যে কোন দফাভিত্তিকহোক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি আজো যেমন জনতার শত্রুকায়েমীস্বার্থবাদীদের হাতে বর্তমান, ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবে – যদি না রাষ্ট্রীয়
কাঠামোর একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। বিপ্লবী সমাজবাদীদের তাই আজকেরঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে উদীয়মান পুঁজিপতিদেরনেতৃত্বে এই ভাঁওতাবাজি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বেএবং কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর “মেহনতী জনতার গণতান্ত্রিক বিপ্লবে “পর্যবসিত করা। দেশের বর্তমান যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠীর পরিবর্তে, উদীয়মান এবং বিক্ষুব্ধ বুর্জোয়াদের হাতে শাষন ক্ষমতাএলেই সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ভাগ্যের বা অবস্থার কোনই পরিবর্তন হচ্ছেনা। একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতী জনতার ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়েই এই পুঁজিবাদী শোষন ব্যবস্থা খতম হওয়া সম্ভব, অন্যথায় নয়।

১৮ইফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত গণ-বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্থানের বর্তমানেধনবাদী শোষন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতীজনতার গণতান্ত্রিক সরকার। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি শোষনহীন সমাজবাদীরাষ্ট্র প্রতিষ্টা। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে একমাত্র সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বেমেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার। তাই সমাজবাদী দলের আজকের শ্লোগানঃমেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার কায়েম কর।রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারী বিপ্লব। তোমার কাছেআমাদের বিপ্লবী শপথঃসর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব মেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েওকায়েম করবোই।

রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারী বিপ্লব অমর হোক।

ঢাকার কর্মসূচি
১৮ই ফেব্রুয়ারী সকালঃ প্রভাত-ফেরী।
১৫ই ও ১৬ই ফেব্রুয়ারীঃ পথসভা, গণসংগীত।
১৭ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যাঃ বায়তুল মোকাররম
থেকে মশাল মিছিল।
১৮ই ফেব্রুয়ারী
পল্টনে জনসভা।
সন্ধ্যাঃ মশাল মিছিল ও বিপ্লবী শপথ গ্রহণ।
——————
শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের পক্ষে হারুন-উর-রশিস কর্তৃক ২৪৬ মধুবাজার,
ঢাকা-৯ থেকে প্রচারিতও প্রকাশিত।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!