You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
মওলানা ভাসানী কর্তৃক স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ঘোষণা সাপ্তাহিক ‘মাতৃভূমি’ যশোর থেকে প্রকাশিত ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০

পল্টন ময়দানের বিশাল জনসমূদ্রে মওলানা ভাসানীর ঘোষনাঃ “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান – জিন্দাবাদ”
(বিশেষ প্রতিনিধি)
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি প্রধান, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সংগ্রামী জনগণের মহান নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল শুক্রবার ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসমূদ্রে দাঁড়িয়ে ‘সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মরণপণ সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা’ করিয়াছেন।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল কর্তৃক যৌথ উদ্যোগে গৃহীত প্রতিবাদ দিবসের অন্যতম কর্মসূচী হিসাবে আয়োজিত এই জনসভায় ভাসন দানকালে তিনি জনগনকে সকল ভীরুতা-জড়তা ত্যাগ করে উক্ত সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।
মওলানা ভাসানী বলেন, “সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের এই দাবী আইনসঙ্গত – এই সংগ্রামও আইনসঙ্গত। এটি নিছক হুমকির বা চাপ সৃষ্টির আন্দোলন নয়; স্বাধীন-সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের এই সংগ্রামের প্রতি এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার শান্তিকামী ও মুক্তিকামী জনগণের পূর্ণ নৈতিক সমর্থন থাকবে।” এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংগ্রাম জীবন-মরণের সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ লক্ষ মানুষ সামূদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ দিয়েছে। আমাদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হলে আরও ১৫/২০ লাখ লোক জীবন দিয়ে হয় অভিষ্ট সিদ্ধ করবো, না হয় মৃত্যুবরন করবো।” মওলানা বলেন, “জয় বাংলা” স্লোগান বন্ধ করার জন্য কোন সৈন্য দেওয়া হয় নাই। স্বাধীন পূর্ব বাংলা বললে যদি সৈন্য নিয়োগ করা হয়, তাহলে বিরাট ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।”
ইতিহাসের নজিরবিহীন প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত পূর্ব বাংলায় লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের ‘পরে দাঁড়িয়ে যারা নির্বাচনী প্রচারনার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে চলেছে তাদের সম্পর্কে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না, তারা নিজেরাই বলুক যে তারা জনতার শত্রু না মিত্র।‘
শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান
‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে’ শরিক আওয়ামী লিগ প্রধান শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নব্বই বৎসরের বৃদ্ধ জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীবলেন, ‘মুজিব, তুমি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামে যোগ দাও। যদি আমেরিকা ও ইয়াহিয়ার স্বার্থে কাজ করো তাহলে আওয়ামী লীগের কবর ’৭০ সালে অনিবার্য’
এই প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী আরও বলেন, ‘যারা বলে নির্বাচনে শতকরা একশোটি আসনে জয়ী হয়ে প্রমান করবে জনতা তাদের পিছনে রয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের অতের মিল নেই। দক্ষিন ভিয়েতনামে দেশপ্রেমিক গেরিলারা যখন লড়াই করেছে তখনও সংগ্রামের মুখে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু তার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়নি যে নির্বাচনে বিজয়ীরা জনগণের বন্ধু। বরং তারা সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের তল্পিবাহক।‘
বিদেশি সৈন্য হটাও
দুর্গত এলাকায় রিলিফ দেওয়ার নামে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিপুলসংখ্যক মার্কিন ও বৃটিশ সৈন্যেও ঘাটি স্থাপন সম্পর্কে মওলানা ভাসানী বলেন, “আমেরিকা ও বৃটেন ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশ দুর্গত মানবতার সেবায় স্বেচ্ছাসেবক, সাহায্য দ্রব্য ও সাংবাদিক প্রেরন করেছেন। শুধুমাত্র আমেরিকা ও বৃটিশরা কামান-বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় মানবতার সেবা করতে এসেছে। সশস্ত্র হয়ে সেবা করা যায় না – যুদ্ধ করা যায়।” তিনি পৃথিবীর জনগণের শত্রু মার্কিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার লেজুর বৃটেনের সেনাবাহিনীকে আগামী ৩০শে ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে বিদায় নেওয়ার নির্দেশ দেন। অন্যথায় ‘মার্কিন ও বৃটিশ দূতাবাস জ্বালিয়ে দেওা হবে’ বলে হুশিয়ারী উচ্চারন করেন।
যুদ্ধ জননেতার বক্তৃতাকালে তিন লক্ষাধিক লোকের এই বিশাল জনসমূদ্র থেকে মাঝে মাঝে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘ইঙ্গ-মার্কিন দস্যুরা বাংলা ছাড়’, ‘পূর্ব বাংলার নয়নমণি – মওলানা ভাসানী’ প্রভৃতি শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।
এই পর্যায়ে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘শুধু শ্লোগানে সংগ্রাম হয় না। হয় মরে যাব, নয়তো সার্বভৌমত্ব পাব এই কি আপনারা চান? বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন। যদি কোরবানী দিতে প্রস্তুত থাকেন তবে হাত তোলেন। মওলানা ভাসানী নিজেই তখন শ্লোগান দেন, ‘নারায়ে তাকবীর – আল্লাহু আকবার’ ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান – জিন্দাবাদ’। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কন্ঠ থেকে তাদের প্রিয় নেতার শ্লোগানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে।
উক্ত জনসভায় আরো যারা ভাষণ দেন তাঁরা হলেন ন্যাশনাল লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে অলামায়ে ইসলামের সভাপতি পীর মোহসেন উদ্দীন, কৃষক-শ্রমিক পার্টি প্রধান জনাব এ. এস. এম সোলায়মান ও পুর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিয়ুর রহমান।
সভাশেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে উপস্থিত জনতার এক বিরাট মিছিল বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দিতে রাজধানীর সড়ক প্রদক্ষিন করে।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!