You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন আওয়ামী লীগ (প্রচার পত্র) ১ ডিসেম্বর, ১৯৭০

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাইবোনেরা,
আসসালামু আলায়কুম
আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহন করুন।
আগামী ৭ই ডিসেম্বর সারা দেশব্যাপী জনগনের প্রত্যেক্ষ ভোটে প্রথম সাধারন নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। জনগনের ত্যাগ ও নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফল হচ্ছে এই নির্বাচন। সারা দেশ ও দেশের মানুষকে তীব্র সংকট ও দূর্নীতি থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি করার সুযোগ এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গ্রহন করা যেতে পারে।
দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম আন্দোলনের পথ বেয়ে শত শত দেশপ্রেমিকের আত্মদান, শহীদের তাজা রক্ত আর হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীর অশেষ নির্যাতনভোগ ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগনের সামনে আজ এক মহা সুযোগ উপস্থিত। এই নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নির্বাচিত হবার পরপরই পরিষদ সদস্যরা বা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার গদিতে বসে পড়তে পারবেনা। তাঁদেরকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র প্রনয়নের কাজ সমাধা করতে হবে। বস্তুতঃ স্বাদীনতার তেইশ বছররের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল দায়িত্ব এবং অধিকার সর্বপ্রথম এবারই জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা লাভ করেছে। তাই তি এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমার দেশবাসী,
আমার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরেও যদি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিগণ দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিরতে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। কেননা সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও একনায়কত্ববাদের প্রতিভূরা দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার কাজে পদে পদে বাধা দেবে। ভোটাধিকারের নির্ভুল প্রয়োগ করার মাধ্যমে সেই মহা সুযোগ আমরা কুচক্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের দুঃখমোচন ও বাংলার মুক্তি সনদ ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়িত করা যাবে। একমাত্র এই কারণেই আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
কারাগার থেকে বেড়িয়ে আমরা জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ এক ব্যাক্তি ভোট এক ভোটের দাবী তুলেছিলাম; আজ সেটা আদায় হয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ যোগ্যতা ও সুযোগের অধিকারী। এখন বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরা যদি একই দলের কর্মসূচী ও আদর্শের সমর্থক হন অর্থাৎ সকল প্রশ্নে তাঁরা ঐক্যমতে থাকতে পারেন তবে আমরা অতীতে চাপিয়ে দেয়া সকল অবিচার, বৈষম্যমূলক আচরণ, আইন-কানুন এবং বে-ইনসাফী শোষনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সম্মিলিত দাবীর মুখে দেশের অপ্র অংশের পরিষদ সদস্যগণ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সনদ ৬-দফা ১১-দফা মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন। এর কারণ, পরিষদে আমরা সংখ্যা থাকব। আর আমরা যদি বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আত্মঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানকার সম্পদের উপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে।
আমার ভাইবোনেরা,
শেরে বাংলা আজপরোলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নেই। যাঁরা প্রবীনতার দাবী করছেন, তাদের অধিকাংশই হয় ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেনীর বাঙালী বিদ্বেষীদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে তল্পীবাহকের ভূমিকা গ্রহন করেছেন; নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং অন্যের সলা-পরামর্শে বশীভুত হয়ে কথায় ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে।তাদের চাওয়া ও পাওয়ার স্বার্থক রুপদানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই গ্রহন করতে হবে। এবং সে কঠিন দায়িত্ব গ্রহনে আমরা সম্পূর্ন প্রস্তুত। তার উপযোগী করেই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলা হয়েছে। নিজেদের প্রান দিয়ে হলেও যদি এদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জীবন কন্টকমুক্ত করতে পারি, আগামী দিনগুলোকে সকলের জন্য সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে পারি এবং দেশবাসীর জন্যে যে কল্পনার নিকশা এতদিন ধরে মনের পটে এঁকেছিলাম – সে স্বপ্নের বাস্তব রুপায়নের পথ প্রশস্ত করে দুঃখের বোঝা বোঝা যদি কিছুটাও লাঘব করে যেতে পারি – তাহলে আমাদের সংগ্রাম স্বার্থক হবে।
আমার প্রিয় দেশবাসী,
আমি ক্ষমতার প্রত্যাশী নই। কারণ, ক্ষমতার চেয়ে জনতার দাবী আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড়। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ ও দাবী আদায়ের দায়িত্ব যদি আমাদের উপর ন্যস্ত করতে চান তাহলে আমাদেরকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সে শক্তি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ। কারণ, এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে অধিকার আদায়ের চাবিকাঠি। তাই আমার জীবনের সুদীর্ঘ সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে আমার একটি মাত্র আবেদন – বাংলাদেশের সকল আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদেরকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিন।
সংগ্রামী দেশবাসী,
সর্বশেষে, আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনাদের কাছে কয়েকটি কথা পেশ করতে চাই। আপনারা জানেন ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় আমরা বাঙালীরা কিরূপ বিচ্ছিন্ন, অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বের সাথে এবং দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে প্রায় আমাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভেঙে পড়েছিলো। অবরুদ্ধ দ্বীপের ন্যায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কেবলমাত্র আল্লহর উপর ভরসা রেখে এক সীমাহীন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছিল। তথাকথিত শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রশাসনযন্ত্র বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে সেদিনের সেই জরুরী প্রইয়োজনের দিনেও আমাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাই আমার নিজের জন্য নয়, বাংলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্য ১৯৬৬ সালে আমি ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম। এই দাবী হচ্ছে আমাদের স্বাধীকার, স্বায়ত্বশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবী; অঞ্চলে অঞ্চলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানের দাবী। এই দাবী তুলিতে আমি নির্যাতিত হয়েছি।একটার পর একটা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাকে হয়রানী করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার সহকর্মীদেরকেও একই অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই দুর্দিনে পরম করুনাময় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরুপ আপনারাই কেবল সাথে ছিলেন।
কোন নেতা নয়, কোন দলপতি নয়, আপনারা – বাংলার বাংলার বিপ্লবী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে মনু মিয়া, আসাদ, মতিয়ুর, রুস্তম, জহুর, জোহা, আনোয়ারের মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি, জীবনে কোনদিন ভুলবো না, ভুলতে পারবো না। জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মমলার মত আবার যদি মৃত্যুর পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমি শহীদের পবিত্র রক্তের সাথে বেইমানী করবো না। আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুন্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনদিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করবো।
প্রিয় ভাইবোনেরা,
বাংলার যে জননী শিশুকে দুঃখ দিতে দিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁর নাখালপাড়ায় মারা গেল, বাংলার যে শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ঢলে পরলো, বাঙলার যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে জীবন দিলো, বাঙলার যে ছাত্র স্বাধীকার আন্দোলনের সংগ্রামে রাজপথে রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিলো, বাঙলার যে সৈনিক কুর্মিটোলার বন্দী শিবিরে অসহায় অবস্থায় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো, বাঙলার যে কৃষক ধানক্ষেতের আলের পাশে প্রাণ হারালো – তাদের বিদেহী অমর আত্মা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে ঘরে-ঘরে ঘুরে ফিরছে এবং অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার দাবী করছে। রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে যে আন্দোলন তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, সে আন্দোলন ৬-দফা ও ১১-দফার। আমি তাঁদেরই ভাই।আমি জানি ৬-দফা ও ১১-দফা বাস্তবায়নের পরই তাদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। কাজেই আপনারা ওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে জয়যুক্ত করে আসেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জালেমদের ক্ষুরধার নখদন্ত জননী বঙ্গভূমির বক্ষ বিদীর্ণ করে তার হাজারো সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়যুক্ত হবো।
শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।
জয় বাংলা।। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
নিবেদক-
আপনাদেরই
শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাচনী দফতর ৫১, পুরানা পল্টন, ঢাকা হইতে আব্দুল মতিন কর্তৃক প্রকাশিত ও পাইওনিয়ার প্রেস
ঢাকা হতে মূদৃত। 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!