You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.12 | ২৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১২ আগষ্ট ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১২ আগষ্ট ১৯৭১

-সমগ্র রংপুরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে তিস্তা নদীর ওপর স্থাপতি বড় খাতা সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানীরা তাই কড়া প্রহরাধীনে রক্ষা করতো একে। পর পর তিনবার ব্যর্থ হবার পর চতুর্থবার বীর মুক্তিযোদ্ধা হারিসউদ্দিন সরকারের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী একটা সাহসী দল প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে সেতুর গায়ে মাইন লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এই অভিযানে মারা যায় ১৫ জন শুত্রুসেনা, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এ দিন কাদেরিয়া বাহিনীর একটি দল কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্ব টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে সিরাজকান্দির ঘাটে ধলেশ্বরী নদীতে পাকসেনাদের সমরাস্ত্রবাহী ২টি জাহাজ আক্রমণ করে দখল করেন। এই জাহাজে ২১ কোটি টাকার অস্ত্র গোলাবারুদ কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যগণ ৭৭৫ নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যায়। এই বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদের কারণে ‘কাদেইয়া বাহিণী’র ১৭০০০ জন মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইল এলাকার পাক সেনাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ সংঘের্ষে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে সমর্থ হয়। এই যুদ্ধে কমান্ডার হাবিবুর রহমান জাহাজ মারা হাবিব বলে পরিচিত হন এবং তাঁর সাহসিকতার জন্য “বীর বিক্রম” উপাধিতে ভূষিত হন। উল্লেখ্য, কাদেরিয়া বাহিনীর ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ছিল ৭২ হাজার। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল কর্মক্ষেত্র। সুশৃঙ্খল প্রশাসনের মাধ্যমে ৫টি সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৮৭ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা।

-অক্সফাম আমেরিকা আজ থেকে ওয়াশিংটনে চাঁদা সংগ্রহের জন্যে একটা প্রচার বিলি করা শুরু করে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার শিশু-নারী যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তাদে সাহায্য করার আবেদন ঐ প্রচারপত্রে জানানও হয়।

-পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দ্বারা শেখ মুজিবের প্রাণদন্ড দান সংক্রান্ত খবরে প্রেক্ষিতে ভারতীয় রাজ্যসভার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এবং জাতিসংঘ আশানুরূপ কাজ করছে না বলে উল্লেখ করেন।

-এদিন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুজিবনগরে সাপ্তাহিক ‘নিউ ওয়েভ” পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুতয় এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ এখন জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। (বি ডি-১ পৃঃ ৩৪২)

-এদিন দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়ঃ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ল্যাভেটরীতে তিনটি বিস্ফোরণে তিনজন বিদেশী আহত হয়েছে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় সংবাদদাতা মিস ক্লেয়া হোলিওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়ঃ আগষ্ট ১১ রাত্রিবনেলা হোটেল ইন্টারকন্টিনেণ্টাল একটি বোমা বিস্ফোরণের ফলে পাঁচজন গুরুতরভাবে এবং ২০ জনের বেশী সামান্য আহত হয়। পাকিস্তানের সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচারের প্রতিবাদে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বিস্ফোরণের ফলে হোটেলের দোকানপাট সহ ‘লবী’ এলাকা অফিস ও পানাগার শুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ এবং টেলিফোন বিকল হওয়ার ফলে প্রায় ২০০ জন অথিতি অন্যত্র রাত কাটাতে বাধ্য হন। উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা সামাদ, বাকের উলফৎ, মোফাজ্জল হোসেন মায়া ও গাজী এই অপারেশনে অংশ গ্রহণ করেছিল।

-সিনেটর এডওয়ার্ড  কেনেডির পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা রাজ্য শরণার্থী শিবির  পরিদর্শন করেন। পূর্ব বাংলা সফর বাতিল সম্পর্কে কিসিং কন্টম্পরারী আরকাইভস (পৃঃ ২৪৯৯০) লিখেছেঃ” Senator Edward Kenedy, in his capacity as chairman of the U>S senate Judiciary Subcommitte on Refuges. Paid a Tow-day visit to the refugee camps on Aug 10-11 and watched streams of refugees crossing the frontier into India. He personally questioned many of the refugees all of whom told him that they had fled in fear for their lives because they were Hindus. The Pakistan Government had previously cancelled on Aug. 10 a scheduled visit to East Pakistan by Senator Kennedy, on the ground that resentment against his alleged pro-Indian prejudice might cause demonstrations.’’

-পাক-দালাল মওলানা সাদানী ঢাকার অদূরে মীরকাদিমে শান্তিকমিটির এক সভায় বক্তৃতাকালে গেরিলা হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন। (সংবাদপত্র)

উল্লেখ্য, এ সময়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলায় শান্তি কমিটির চেয়াম্যানও সদস্য হয়েছেন। পাবনা জেলায় বিভিন্ন থানায় যারা শান্তি কমিটি চেয়ারম্যান হয়েছিল তারা হলঃ মওলানা আব্দুস সোবহান (পাবনা), মওলানা খোদা বক্স খান (ঈশ্বরদী), মনেউদ্দীন (চাটমোহর), মোঃ নূরুজ্জামান (চাটমোহর), মওলানা আতাউর রহমান (দাশুড়িয়া), ইসহাক আলী খান (মুলাডুলী)। আবুল কালাম আজাদ ‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন, জুন-জুলাই মাস জুড়ে পাক বাহিনী শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহয়তা জেল্র হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। … ফরিদপুর থানা ডেমরা, হাদোল, আট ঘরিয়া থানার লক্ষ্মীপুর ও গোপালনগরে স্মরণাতীতাকালের বৃহত্তম গণহত্যা চালানো হয়।… লাহিড়ি মোহনপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকেও ব্যাপক সংখ্যক ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। এদে মধ্যে বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা শ্রী অমূল্য লাহিড়ীর পরিবারবর্গও ছিলেন। (পৃঃ৬৪) আবুল কালাম আরো লিখেছেন, আগষ্ট মাসেই পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে দেখা দিল চরম খাদ্যভাব…শুরু হল প্রবল বর্ষণ। পদ্মায় ডাক্লবান। সমস্ত এলাকা হলো প্লাবিত। পেটের দায়ে মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করলো…পেটের পীড়া মহামারী আকারে দেখা দিল। বহু দুর্ভিক্ষের জ্বালা সইতে না পেরে এন্ডিনপানে আত্মহত্যা করলো। (পৃঃ ৬৬)  ৭ মে রাজনকার থানা সদর থেকে প্রায় তিন মাইল তরে পাঁচ গাও গ্রামে হানাদার বাহিনী ও দোশররা ৭৩ জন নিরঈহ নাগরিককে হাত-পা বেঁধে সরকার বাজার দিঘীর জলে নিক্ষেপ করে। এ দিনের শহীদরা হলেনঃ পুতুল অধিকারী, নিরোদ শংকর, ব্রজেন্দ্র শংকর, মনাই বীবেরেশ, সুররাম, নিত্যশালা, উপেন, গোরী, হরেন্দ্র, গোপাল, কুমার মালাকার, অভিরাম, রমন, রমন লস্কর, নগেন, নবরাম, সুবল, মুখেন্দ্র, সুরেন্দ্র টুনা বৈষ্ণব, লুঙ্গ মালাকার, বিধু, রমন মালাকার, সদাই, সতীশ, নরেশ, উমেশ, পরেশ, হরিমালাকার, নরহি, অভয় চরণ দেবনাথ, ভগীরথ, পরেশ নমশূদ্র সনাতন, ললিতা, নরেশ শংকর, লালচাঁদ মালাকার, কানি মালাকার, বাদল বসন্ত, যতীন্ত্র, পিয়ারী, উমেশ, নাগাবাবু, রজনীবগন্ত, রজনীকান্ত, দেবনাথ, রমনী মোহন দেবনাথ, নগেন্ত্র দেব, নিখিল চক্রবর্তী, রসময় চক্রবর্তী, বিনোদ চক্রবর্তী, হিরময় দাস, দেবেন্দ্র ভট্টচার্য ও খোকা ভট্টচার্য প্রমুখ। ১৩ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি (লেখক)।

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী