১৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮ সোমবার, ২ আগষ্ট ১৯৭১
এ সময়ে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব লীগের নেতাদের উদ্যোগে ‘মুজিব বাহিনী” নামে স্বতন্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন করে। বাংলাদেশ সরকারের আগোচরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের ১২০০ অনধিক মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সারা দেশকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এ সব অঞ্চল ছিল পশ্চিমাঞ্চল , উত্তরাঞ্চল, ঢালু অঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল। মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চল অধিনায়ক ছিলেন ১৯৬৯ সনের গণঅভ্যুথানের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এম এন এ, সহকারী অধিনায়ক নূর আলম জিকু ও কাজী আরিফ আহমেদ। উত্তরাঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের প্রাণপুরুষ সংগঠক সিরাজুল আলম খান, সহকারী অধিনায়ক ছিলেন মনিরুল ইসলাম
ঢালু অঞ্চলের অধিনায়ক ছিলেন প্রখ্যাত ছাত্রলীগ নেতা আওয়ামী ভলেনটিয়ার সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক এমপিএ, সহকারী অধিনায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমেদ। পূর্বাঞ্চলে অধিনায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের প্রাণপুরষ যুবনেতা শেখ ফজলুল হোক মনি, সহকারী অধিনায়ক সৈয়দ
রেজাউর রহমান, আ স ম আব্দুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। মুজিব বাহিনীর গেরিলা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ব্যাপক অপারেশন চালাতে থাকে। এ মাসে মুজিব বাহিনী সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।
এ দিন ২নং সেক্টরের বীর মুক্তি্যোদ্ধা মোঃ নোয়াব মিয়া মৌলবীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার কালাছারা চা বাগানে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। শহীদ মোঃ নোয়াব মিয়া তার সাহসিকতার জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত হন
-এদিন সাপ্তাহিকী বলা হয়ঃ
উল্লেখ্য ঐসব পত্রিকায় ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধের অনুকুল প্রাকৃতিক অবস্থা ও বিপুল জনসমর্থনের কথা বর্ণনা করা হয়। বাংলাদেশের ধান পাটের ক্ষেত এবং গাছপালা, ঝাড়-জঙ্গলের মাঝে গেরিলারা পাকবাহিনীকে আক্রমণ করবার চমৎকার সুযোগ পেয়েছে-এসবের এবং জনগণ কিরূপ যত্নের সাথে তাঁদেরকে আশ্রয় ও খাবার সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছে তার নিখুঁত বর্ণনাও ঐসব বিদেশী সাংবাদিকতা তুলে ধরেন। (লেখক)
–আমিনুল হক বাদশা (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী প্রেস সেক্রেটারী)- কে ৬ আগষ্ট বেলা ১০ টার মধ্যে ঢাকার সামরিক আইন আদালতে হাজির হবার নির্দ্দেশ দেয়া হয় অন্যথায় তার অনুপস্থিতিতে বিচার করা হবে। উল্লেখ্য, এপ্রিল ৩০ তারিখে কলকাতার পূর্ণ সিনেমা হলে এক বুদ্ধিজীবী সমাবেশে জনাব আমিনুল হক ২৫ মার্চ রতে পাকসেনাদের নারকীয় হত্যাকান্ড ধারা বিবরণী দিয়ে এক ডকুমেন্টারী (নির্বাক) ফিল্ম প্রদর্শন করেন। ঐ দিনের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সম্মানে সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র অনুষ্ঠানে উদ্ধোধনী সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে শোনান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক মুর্শেদ, জহীর রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমামসহ বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। (লেখক)
এদিন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মিঃ রেজার্স এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন যে, জাতিসংঘের আসন্ন শারদীয় বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সদস্যপদ অর্জনের জন্য সমর্থন জানাবে। পক্ষান্তরে রিপাবলিক অব চায়না (ফরমোজা) কে বহিস্কার পদক্ষেপের উপর যুক্তরাষ্ট বিরোধীতা করবে। উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আগষ্ট ৪ তারিখে মিঃ রোজার্সের বক্তবযে দুই চীণের উল্লখের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে গত দিন লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসভা অনুষ্টিত হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে এই জনসমাবেশ ছিল ব্রিটেনে বাঙালীদের ঐতিহাসিক জনসভা। এদিন জনসভায় বক্তৃতাদান করে সর্ব জনাব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লর্ড ব্রকওয়ে, আশোক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইনমন্ত্রী), পিটার শোর, রেজ প্রেন্টিস, ব্রুক ডগল্যাসম্যান , জন ষ্টোনহাউজ, লর্ড গিফোর্ড,পল কনেট, বেগম লুলু বিলকিস বানু ও গাউস খান। এই জনসভায় বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগরস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তিনটি নির্দ্দেশের উল্লেখ করেন। নির্দ্দেশগুলো হলোঃ শীঘ্রই লন্ডনে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা, পাকিস্তানের বিমানে (পিআইএ) বাঙালীর ভ্রমণ বর্জন; বাঙালী কূটনৈতিক অবিলম্বে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ রফার গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেনঃ ঐসব গুজব ভিত্তিহীন। উল্লেখ্য এদিকে লন্ডনস্থ পাক দূতাবাসের কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ ঐ জনসভায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ইউরোপে তিনিই প্রথম কূটনীতিক চাকুরীতে ইস্তফা দিলেন।
-এদিন মাদ্রাসা সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম, খাজা খয়েরউদ্দিন, মওলানা আব্দুর রহিম, অধ্যাপক গোলাম আজম, মৌলবি ফরিদ আহমদ , মতিউর রহমান নিজামী, মওলানা আশরাফ আলী, ডঃ হাসান জামান প্রমুখ বক্তব্য রাখে। (সংগ্রাম)
-আজ রাজশাহীতে রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের সশস্ত্র ট্রেনিং সমাপ্ত হয়। শান্তিকমিটির নেতা আয়েনউদ্দিন ‘দুস্কৃতকারীদের হাত থেকে পাকিস্তানের আদর্শ , সংহতি ও অখন্ডতাররক্ষার জন্য রাজাকার বাহিনী তৈরী করা হয়েছে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী