You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ : নীতি ও কর্মসূচী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১ লা আগষ্ট, ১৯৬৯

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ

নীতি ও কর্মসূচী ঘোষণা

(ম্যানিফেষ্টো)

তাজউদ্দীন আহমদ

সাধারণ সম্পাদক

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।

[১৯৬৪ সনের মার্চ, ১৯৬৬ সনের মার্চ ও ১৯৬৭ সনের আগষ্ট মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন সমূহ গৃহীত সংসধনীনিচিয় আন্তরভুক্ত করিয়া এই ‘নীতি ও কর্মসূচীর ঘোষণা’ (ম্যানিফেষ্টো) তৃতীয় প্রকাশরুপে পুর্নমুদ্রণ করা হইল।]

ভূমিকা

স্বাধীনতা ও সার্বভৌম পাকিস্তান কায়েম করা হয় এই উদ্দেশ্যে যে, এখানে সুবিচার ও ন্যায়-নীতিভিক্তিক এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা হইবে-যেখানে জনগনের জীবনযাত্রার সর্বাঙ্গীন মানোন্নয়নের মাধ্যমে এক সুখী, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল সমাজ গড়িয়া উঠিবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত করা হয় এই আশায় যে, এখানে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বা কয়েক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হইয়া দেশের সমগ্র জনসাধারণের মধ্যে সমভাবে বণ্টিত হইবে, তাহাদের সর্বাত্মক কল্যাণ ব্যয়িত হইবে। স্বভাবতই আশা করা গিয়াছিল যে, এখানে প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সহজ, সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের ন্যুনতম শর্তাবলী পূরণের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করা হইবে। পাকিস্তানের নাগরিকরা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবেই আশা করিয়াছিল চিন্তার ও চিন্তাধারা প্রকাশের পূর্ণ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা, পাক স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, মুদ্রণ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, দেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা এবং মৌলিক স্বাধীনটার পূর্ণ নিশ্চয়তা; আশা করা গিয়াছিল অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও জনগনের ভোগের সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা।

কিন্তু দেশবাসী মর্মান্তিকভাবে হতাশ হইয়াছে, তাহাদের আশা পূর্ণ হয় নাই, তাহারা এই সকল মৌলিক অধিকার ভোগের অধিকার পায় নাই। জনগনের এইসব অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও উপভোগের জন্য হে সুস্পষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ও দেশের কার্যকরী করার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। ক্ষমতা লোভী একদল চক্রান্তকারী, এক সংকীর্ণ আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী এবং স্বার্থ সর্বস্ব একটি সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শ্রেণী সম্মিলিতভাবে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলনের প্রতিটি প্রচেষ্টা বাঞ্চাল করিয়া দিয়াছে। এই স্বার্থপর কুচক্রীদলের দেশ ও গন স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের নজিরের অভাব নাই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী মরহুম হোস্বন শহীদ সোহরওয়ার্দী সাহেব যখন তাহার স্বল্পকালস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে এ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁহাকে পদত্যাগ করুতে বাধ্য করা হইয়া ছিল।

এই অশুভ চক্রের তৎপরতার ও প্রাধান্যের ফলেই ন্যায়-নীতি ও ইন্সাফ বিসর্জন দিয়া এবং পাকিস্তানের ঐক্যের মুলে কুঠারাঘাত করিয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের এক বিরাট পাহাড় সৃষ্টি করা হইয়াছে, যাহার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো আজ প্রায় ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।

         এই দুর্বিষহ অবস্থা হইতে দেশকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব আমাদের, -আমাদিগকে এই দায়িত্ব পালন করিতে হইবে। মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব দেশকে এই দুঃসহ অবস্থা হইতে মুক্ত করিবার জন্য অর্থাৎ এ দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র কায়েম করিবার জন্য এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বচার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। জেল-জুলুম ও অন্য সমল প্রকার প্রতিবন্ধককে সহ্য ও অগ্রাহ্য করিয়া জন্মবধি আওয়ামী লীগ এই মহান উদ্দেশ্য হাসিল ও বাস্তবায়নের পথ দৃঢ় ও নিরালস সংগ্রাম করিয়া চলিয়াছে। এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক অবিচারের অন্ততঃ কিছুটা মৌখিক স্বীকৃতি সকল মহলই প্রদান করিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু ইহা মৌলিক স্বীকৃতি মাত্র, কার্যতঃ সর্বক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইয়া চালিয়াছে।

         ভৌগোলিক ও অন্যান্য কারণে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী অবশ্যই যুক্তিপুর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালে এই অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনায় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত এই অঞ্চলের স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যাপারে যে অসুবিধার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহাতে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যৌক্তিকতা ও অপরিহার্য্যতা বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে অকাট্যরুপে প্রমাণিত হইয়াছে।

         আমাদের প্রিয় নেতা মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রতিষ্ঠাত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক গণতন্ত্র এবং আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে, কারণ, ইহাকে পাকিস্তানের সকল জনগনের দাবী এবং ‘জনগণের নির্দেশেই সকল ব্যবস্থার উৎস’।

শাসনতান্ত্রিক আদর্শ

         আওয়ামীলীগ জাতিয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। ইহা অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত বিশ্বাস করে যে, জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পরিচালিত হইবে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনায় নিয়োজিত সকল ব্যক্তিই তাহাদের নিজ কার্য্যকলাপের জন্য জনসাধারণের নিকট সর্বতোভাবে দায়ী হইবে।

         উল্লিখিত মূল নীতি সমূহের ভিক্তিতে শাসনতন্ত্রের আইন প্রণয়ন, শাসঙ্কার্জ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও দেশরক্ষা কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ বর্তমানে সর্বাধিক প্রয়োজন। শুধু এই যুক্তিযুক্ত ও বাস্তব ব্যবস্থার মাধ্যমেই পাকিস্তানের সঙ্ঘতি, স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।

         রাষ্ট্রে সকল প্রতিনিধিত্ব মূলক প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের সার্বজনীন ও প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হইবে। ধর্ম, বর্ণ। শ্রেনী ও মত নির্বিশেষে নারী-পুরুষ প্রত্যেক নাগরীক ১৮ বৎসর বয়সে ভোটাধিকার নাভ করিবে এবং ২১ বৎসর পূর্ণ হইলে যে কোন ভোটার নির্বাচনে প্রার্থী হইবার অধিকারী হইবে। নির্বাচন স্বাধীনভাবে এবং গোপন ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হইবে।

 

মৌলিক অধিকার

ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণী, মত ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বীকৃত প্রতিটি অধিকারী হইবে। নাগরিকদের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু জীবনযাপনের অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, এবং ন্যায়সঙ্গত ও সহজ উপায়ে জীবিকা অর্জন ব্যবস্থা থাকিতে হইবে।

আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান বলিয়া বিবেচিত হইবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকই আইন সঙ্গত সকল অধিকার ও মর্যাদা সমানভাবে ভোগ করিবে। অল্প ব্যয়ে দ্রুত ও সহজ উপায়ে ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 

ব্যক্তি-স্বাধীনতা

পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিককে তাহার সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হইবে, যাহাতে সে স্বীয় প্রতিভা বিকাশের পূর্ণ সুযোগ লাভ করিতে পারে এবং জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ করিতে পারে ও সমাজের বৃহত্তম কল্যাণে সাধণ করিতে পারে। মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ও প্রচারপত্র মুদ্রণ ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, সমবেত হইবার ও সংগঠন করিবার পূর্ণ সাহিনতা এবং দেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা থাকিতে হইবে, উপযুক্ত ও আইন সঙ্গত কারন ব্যাতীত কাহাকেও গ্রেফতার করা বিনা বিচারে কাহাকেও আটক ক্রাখা চলিবে না

         একমাত্র যুদ্ধকালীন সময় ব্যাতীত অন্য কোন সময়ে এই সকল অধিকার খর্ব করা হইবে না। ‘জরুরী অবস্থার’ অজুহাতে অন্যায়ভাবে কোন নাগরিকের অধিকার খর্ব করা চলিবে না।

         সর্বোপরি আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলিম, বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক বিভেদ ও বিদ্বেষের সম্পূর্ণ বিরোধী। আওয়ামীলীগ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ও মত নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকারে বিশ্বাস, ইহা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত।

বিচার বিভাগ

বিচার বিভাগ হইতে সম্পূর্ণরূপে পৃথক থাকিবে। শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা বিধান থাকিবে। বিচার বিভাগের যোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, ও স্বাধীনটার উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করিতে হইবে।

শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবঃ    

         ইহা পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে, আওয়ামী লীগ নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এবং ইহা প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংগঠনের সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইবে। এখানে বিশেষভাবে কতিপয় প্রস্তাবের উল্লেখ করা যাইতেছে- যেগুলিকে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে :

  • পাকিস্তান হইবে একটি “ফেডারেশন” বা যুক্তরাষ্ট্র। এই ব্যবস্থা যৌক্তিকতা বা অপরিহার্যতা সম্বন্ধে আলোচনা অবকাশ নাই, ইহা সর্বজন স্বীকৃত সত্য। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এই উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে। সরকার হইবে ‘পার্লামেন্ট’ ধরনের, যাহাতে প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ময়াধ্যমে গঠিত আইন সভা সার্বভৌম। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন সভায় আসন সংখ্যা জন সংখ্যার ভিক্তিতে নির্ধারিত হইবে।
  • যুক্তরাষ্ট্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা দুইটি বিষয়ে সীমাবধ্য থাকিবে, -যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকিবে নিরঙ্কুশ।
  • সমগ্র দেশের জন্য দুইটি পৃথক অবাধে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা চালু থাকিবে।

অথবা

  • বিশেষ ব্যবস্থা শর্তাধীনে মুদ্রা ও অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয় রুপে গৃহীত হইতে পারে। এই ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কর্তকতাধীন “ষ্টেট ব্যাংক” –এর পরিচালনার অধিনে দুই আঞ্চলে দুইটি “রিজার্ভ ব্যাংক” থাকিবে। এই অঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকগুলি আঞ্চলিক সরকারের অর্থনৈতিক ব্যাপারে পরামর্শ দান করিবে এবং যাহাতে এক অঞ্চল হইতে অন্য অঞ্চলে অবাধে অর্থ ও মূলধন পাচার হইতে না পারে তাহার কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করিবে।
  • শাসন সম্বন্ধীয় কার্য নির্বাহের সুবিধার জন্য এবং নানা প্রকার জতিলতা এড়াইবার জন্য কর ও শুল্ক ধার্যের দায়িত্বে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির উপরই ন্যস্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কোন ক্ষমতা অর্পণের প্রয়োজন নাই। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির রাজস্বের একটি স্বীকৃতি অংশ শাসনতন্ত্রিক ব্যবস্থানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অবশ্য প্রাপ্য হইবে। অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির আয়ের একটি অংশ স্বয়ংক্রিয় নিয়মে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব তহবিলে জমা হইবে।
  • যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রতিটি অঙ্গ রাষ্ট্র বহির্বানিজ্যের পৃথক হিসাবে রক্ষা করিতে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকিবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিই মিটাইবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সহিত রাখিয়া অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বানিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্বীয় স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সাম্পাদনের ক্ষমতা দান করিতে হইবে।
  • আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসন তন্ত্রের রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা অঞ্চলের সেনাবাহিনী গথন ও রয়াখার ক্ষমতা দিতে হইবে।

শাসনতন্ত্রে কার্যকরী এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হইবে যাহাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সামরিক ও বেসামরিক চাকুরিতে উভয় অঞ্চলের লোক সংখ্যা অনুপাতে নিযুক্ত হইতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্বাধীন সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা ও বিভাগ সমউহ এমনভাবে স্থাপন করিতে হইবে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ব্যয়, বিনিয়োগ ও নির্মাণকার্য এমন ভাবে পরিচালিত হইবে যাহাতে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের লোক জনসংখ্যার অনুপারে সমান সুযোগ ও সুবিধা লাভ করিতে পারে।

অর্থনৈতিক আদর্শ

     আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বরতমান শোষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত হইতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ই সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠান কল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামীলীগের চুরান্ত লক্ষ্য।

শিল্পঃ

     যুগ যুগ ধরিয়া নির্মম শোঁশোঁের ফলে পাকিস্তান সামগ্রিকভাবে অনুন্নত অবস্থায় রহিয়া গিয়াছে। দেশের মানোন্নয়নের জন্য ইহার প্রাকৃতিক ও কৃষিজ সম্পদের ব্যবহার দ্বারা সুষম ভাবেদেশকে শিল্পায়িত করা আওয়ামী লীগের আশু লক্ষ। শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে কোন প্রকার একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করা হইবে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান সমুহের মূলধন সরবরাহ ও অন্য সকল ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হইবে। ভৌগলিক অবস্থা ভুমির পরিমান ও জনসংখ্যা এবং প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর শিপ্লায়িত করা ব্যাপক পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহন করিতে হইবে।

     মুল, ভারী, ও বৃহৎ শিল্প, যথাঃ খনিজ শিল্প, ইস্পাত শিল্প, সমত শিল্প, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক শিল্প, -জাতীয়করন করিতে হইবে এবং ইহাদের পরিচালনার ভার রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর নেস্ত করিতে হইবে,

     ব্যাংক, বীমা, গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন ও যোগাযোগ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠান সমূহ জাতীয়করণ করা হইবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রত্তাধীনে পরিচালিত হইবে।

     পাকিস্তান, বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মত জনবহুল কৃষি প্রধান দেশে কুটির শিল্প প্রসারের প্রয়োজনীয়তা, উপযোগিতা ও সাফল্য অনস্বীকার্য। সহজ অর্থনীতির খাতিরে কুটির শিল্পকে সর্ব প্রকার সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে। দেশের সকল অঞ্চলে উহার বহুল প্রসারের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বর্তমানে চলিত ও ক্ষেয়মান কুটির শিল্পকে টিকাইয়া রাখার জন্য সর্ব প্রকার সাহায্য প্রদান ও ব্যবস্থা গ্রহন করিতে হইবে এবং নুতন ও প্রয়োজনীয় কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।

কৃষিঃ

     কৃষি উন্নয়নের জন্য যে সকল স্বভাবজাত উৎপাদনের প্রয়োজন পাকিস্তান, বিশেষ ভাবে পূর্ব পাকিস্তান সেই সকল উপাদানে সমৃদ্ধ। কিন্তু স্বভাবজাত প্রাচুর্যের মধ্য এই দেশের কৃষক সমাজ কঠিন দারিদ্রের নিষ্পেষণে জর্জরিত ও মুমূর্ষ। এই বেদনাদায়ক অবস্থার প্রতিকারের জন্য কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সভ্য পর্যায়ে আনয়নের উদ্দেশ্যে এক ব্যাপক ও বহুমুখী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগৌণ কার্যকরী করিতে হইবে।

     পূর্ব পাকিস্তানের ভুমি প্রাকৃতিক সম্পদে ঐশ্বর্যবান। এই ভুমি আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সমবায় পদ্ধতিতে দেশে যৌথ চাষাবাদের প্রচলন করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কৃষকের জমির পরিমাণ এত অল্প এবং তাহাও এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত যে, সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ ব্যতীত এখানে কৃষির উন্নয়নের কোন উপায় নাই। অতিসত্বর দেশের সর্বত্র যৌথ খামার সৃষ্টি করিতে হইবে। কৃষি ব্যাংকের, সমবায় ব্যাংকের এবং অন্যান্য কৃষি ঋণের টাকা ক্রিসকের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ না করিয়া সমবায় পদ্ধতিতে পরিচালিত কৃষির জন্য উহা ব্যয় করা উচিত। ইহার ফলে কৃষকদের প্রধান সমস্যার মূলধন সমস্যার সমাধান অনেকাংশে সম্ভব হইবে।

     সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার ফলে আধিনিক চাষ ও জলসেচের যন্ত্রপাতি ক্রয়, উন্নত বীজ সংগ্রহ এবং উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা সহজ হইবে।

     আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার যন্ত্রপাতি পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তুত করিবার জন্য কারখানা স্থাপন করিতে হইবে। উন্নত ধরনের বীজ সরবরাহের, জমিতে সার প্রদানের ও সেচ ব্যবস্থার এবং গাবাদি পশুর উন্নতির সর্ব প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করিতে হইবে। বিভিন্ন পোকা-মাকড় ও রোগের ফলে শস্যাদির ব্যাপর ক্ষতির উপযুক্ত প্রতিরোধের ব্যবস্থা কার্য্যকরী করিয়া তুলিতে হইবে।

     সরকার কর্তৃক পর্যাপ্ত সংখ্যক আদর্শ খামার প্রচলিত করিয়া কৃষকদিগকে কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষি উন্নয়নের আধুনিক পন্থা প্রদর্শন করিতে হইবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!