You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম

সূত্র তারিখ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক জনগণের সার্বভৌমত্ব নির্বাচন ও পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত দৈনিক ইত্তেফাক ১৪ মার্চ, ১৯৬৯

মৌলিক গণতন্ত্র ভিত্তিক স্বৈরাতন্ত্রী ব্যবস্থার প্রবর্তক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্তৃক জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার

বয়স্ক ভোটাধিকার ভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত

রাওয়ালপিন্ডি, ১৩, মার্চ-চারদিন একটানাভাবে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্তৃক বয়স্ক ভোটাধিকার ও পার্লামেন্টারী সরকার প্রতিষ্ঠার দাবী মানিয়া নেওয়ার মধ্য অদ্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার গোল টেবিল বৈঠকে কোন সিদ্ধান্তে পৌছুতে সক্ষম হয় নাই।

এদিকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন যে, জনগণের অবশিষ্ঠ দাবী প্রতিষ্ঠার জন্যই আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে।

স্বভাববতই প্রেসিডেন্ট এখন বয়স্ক নির্বাচন ও পার্লামেন্টারী সরকার বিধান শাসনতন্ত্রে সংযোজনের উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করবেন। প্রেসিডেন্ট তাঁহার বক্তৃতায় শান্তিপূর্ণ ও শাসনতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের ঐতিহ্য সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। গোলটেবিল বৈঠক আলোচনার সমাপ্ত টানিয়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রশ্নটি বিলের আকারে পেশের পূর্বে বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বিষয় ভিত্তিতে অক্ষুন্ন রাখিয়া ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য জাতীয় পরিষদের প্রতি আহবান জানাইতে পারেন।

প্রেসিডেন্ট বলেন যে, অমীমাংসিত প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সমাধাওন করিলেই সব চাইতে ভাল হইবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আইয়ুবেরপত্র

         রাওয়ালপিন্ডি, ২৫শে মার্চঃ গতকল্য (২৪শে মার্চ) প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান প্রধান সেনাপতি জেনারেল এ,এম,ইয়াহিয়া খানের নিকট নিম্নোক্ত পত্র লিখেনঃ

প্রেসিডেন্ট হাউস

২৪শে মার্চ, ১৯৬৯

         প্রিয় জেনারে ইয়াহিয়া,

         অতীব দুঃখের সহিত আমাকে সিদ্ধান্তে আসিতে হইয়াছে যে, দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমানে উদ্বেগজনক মাত্রায় অবস্থার যদি অবনতি ঘটিতে থাকে, তাহা হইলে দেশের অর্থনৈতিক জীবন্ধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজার রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।

         এমতাবস্থায়, ক্ষমতার আসন হইতে নামিয়া যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর দেখিতেছি না।

         তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করিয়া সাব্যস্ত করিয়াছি; কেননা সামরিক বাহিনীই দেশের আজিকার কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।

পূর্ব বাংলার জনতার নিকট কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি কর্তৃক স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচী পেশ

বিপ্লবী জনতা!

পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, এক কথায় সমগ্র জনগণের জীবন এক সর্বগ্রাসী সংকটের আগুন জ্বালিতেছে। পূর্ব বাংলার জনগনের উপর এক নিষ্ঠুর জাতিগত নিপীড়ন চলিতেছে। সংকটের এই আগুন পূর্ব বাংলার জনতার ধমনীতে ধমনীতে বিদ্রোহের বহ্নিশিখা জ্বালাইয়া দিয়াছে। পূর্ব বাংলা জনগণ আজ মুক্তি চায়। মুক্তি চায় অনাহার, বুভুক্ষা, দুঃখ-দারিদ্র্য, বন্যা, বেকারত্ব ও জাতিগত নিপীড়নের অভিশাপ হইতে। কিন্তু কোন পথে আসিবে তাহাদের মুক্তি? সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বৃহৎ পুঁজির প্রতিভূ এককেন্দ্রীক স্বৈরাচারী সমরবাদী শাসক গোষ্ঠীকে পূর্ব বাংলার বুক হইতে উচ্ছেদ করিয়া একমাত্র ‘স্বাধীন, সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার শোষিত, বঞ্চিত জন্তার মুক্তি সম্ভব। “স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা” কায়েম করিতে হইলে গ্রাম বাংলায় জোতদার, মহাজন ও শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কৃষকের গেরিলা যুদ্ধ শুরু করিয়া, সামন্তশ্রেণীকে উৎখাতের মাধ্যমে গ্রামঞ্চলে মুক্ত এলাকা গঠনের মাধ্যমে। গ্রামে এইভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে জন্তার সশস্ত্র্য বাহিনী গড়িয়া তুলিতে হইবে, গ্রাম দিয়া শহর ঘেরাও করিতে হইবে এবং শাসক গোষ্ঠীকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করিতে হইবে। শহরের শ্রমিক, মুটে-মজুর, রিকসাওয়ালা, স্কুটারওয়ালা, বাস্তুহারা, বস্তিবাসী, অফিসের কেরানী, পিয়ন, আর্দালী, দোকানদার, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী ও শহরের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত করিয়া রাখা, যাহাতে গ্রাম বাংলার কৃষকের গেরিলা যুদ্ধ প্রচন্ড গতিতে অগ্রসর হইয়া যাইতে পারে।

বিপ্লবী সাথীরা!

পূর্বা বাংলার জনতা সেই পথেই আগাইয়া চলিতেছে। ১৯৬৮-৬৯ সালের বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থান, গ্রাম বাংলার সিলেটের হাওর করাইয়া, খুলনার বাহিরদিয়ার কৃষি বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলি তাহারই নির্ভুল প্রমাণ। শ্যাম্পুর-পোস্তগোলা, খুলনা, সিদ্ধিরগঞ্জ, টঙ্গি, চট্টগ্রাম ও আদমজীতে শ্রমিক শ্রেণী নিজের ও শাসকগোষ্ঠীর রক্তে স্নান করিয়া তাহারই জ্বলন্ত স্বাক্ষর রাখিয়াছে।

আজ তাই “কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির” পক্ষ হইতে আমরা জনতার বিপ্লবী চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা রাখিয়া “স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা” কর্মসূচী আপনাদের নিকট পেশ করিতেছি। আসুন, মহান চীন, ভিয়েতনাম, পশ্চিম বাংলার নকশাবাড়ী, প্যালেস্টাইনের আরবদের মুক্তি সংগ্রাম হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া আমরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে উক্ত কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করি। আসুন মহান মাও সেতুঙের শিক্ষাকে আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি ও গ্রহণ করি “ বন্দুকের নলই সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস”। জয় আমাদের অনিবার্য। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম হইবেই। *

*এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেনন।

পূর্ব বাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেকর্মসূচী

জনগণতান্ত্রিক শিক্ষাসংস্কৃতির রূপরেখা

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাঃ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হইবে সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সামান্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি বৃহৎপুঁজি বিরোধী শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও পেটিবুর্জোয়া শ্রেনীর অন্যান্য অংশ এবং দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেনীসমূহের যৌথ একনায়কত্ব-শ্রমিক নেতৃত্বে ইহা পরিচালিত হইবে-ইহা হইবে “পূর্ব বাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র”।

         রাজনৈতিক কাঠামোঃ রাজনৈতিক কাঠামো গড়িয়া উঠিবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিয়তার নীতির ভিত্তিতে। রূপরেখা হইবে নিম্নরূপঃ

         (১) কেন্দ্র হইতে একেবারে নিম্নপর্য্যায় পর্য্যন্ত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট দ্বারা নির্বাচিত গণপরিষদসমূহ (—————–) থাকিবে যেমন, জাতীয় গণপরিষদ, জিলা গণপরিষদ, থানা গণপরিষদ, ইউনিয়ন গণপরিষদ। জাতীয় গণপরিষদ হইবে, “পূর্ব বাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের” সর্বোচ্চ সংস্থা এবং ইউনিয়ন গণপরিষদ হইবে নিম্নতর সংস্থা।

         (২) এই গণপরিষদগুলির নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকিবে। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর পুনর্বার নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকিবে। তাহা ছাড়া নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারিত করিয়া নতুন প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার জনগণের থাকিবে।

         (৪) গণপরিষদসমূহে নির্বাচনের ভিত্তি হইবে শ্রেণী ও পেশাভিত্তিক। সকল বিপ্লবী শ্রেণিগুলি যাহাতে তাহাদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমানুপাতিক হারে (———-) প্রতিনিধিত্ব করিতে পারে সেই জন্য নারী, পুরুষ এবং সকল ধর্ম, জাতি, পেশা ও শিক্ষা নির্বিশেষে একটি সত্যিকার সার্বজনীন ও সমভোটাধিকার ব্যবস্থা (———–) প্রবর্তন করা হইবে।

         (৫) এইভাবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে “পূর্ব বাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের” সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ জাতীয় সরকার গঠিত হইবে। এই জাতীয় সরকারের সহিত নীচের পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারী সংস্থাসমূহের সম্পর্ক হইবে নিম্নরূপঃ (ক) বিভিন্ন নিম্নতর সংস্থাসমূহ তাহাদের নিজেদের স্বার্থে স্বেচ্ছায় জাতীয় সরকারকে যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভিত্তিতে প্রদান করিবে, ইহা তাহাই পালন করিবে। (খ) নিম্নতর সংস্থাগুলি কর্তৃক স্বেচ্ছায় প্রদত্ত ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার যে নির্দ্দেশাবলী প্রদান করিবে, নিম্নতর সংস্থাগুলি তাহা মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকিবেঃ ইহাই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতি। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির মাধ্যমে পরিচালিত একটি সরকারই জনগণের বিভিন্ন বিপ্লবী অংশের মতামতের সার্থক প্রতিনিধিত্ব করিতে পারে এবং বিপ্লবের শত্রুদের সম্পূর্ন কার্য্যকরীভাবে প্রতিহত করিতে পারে। (গ) জাতীয় সরকার ব্যতীত অন্যান্য নিম্নতর সংস্থাগুলির পারষ্পারিক সম্পর্ক ও এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হইবে।

        

গণতান্ত্রিক অধিকারঃ

(১)নারী, পুরুষ এবং সকল ধর্ম, জাতি, বর্ণ, পেশা ও শিক্ষা নির্বিশেষে সকল বিপ্লবী শ্রেণীসমূহের যথা শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত, ছোট ও মাঝারী ব্যবসায়ী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সকল রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থাকিবে। কিন্তু জনগণের শত্রু সাম্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলামুৎসুদ্দি বৃহৎ পুঁজিপতিদের তাহাদের সহযোগী প্রতি বিপ্লবীদের কোন রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থাকিবে না।

(২) জনগণের বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও প্রকাশনার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতা, প্রদান করা হইবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-মুৎসুদ্দি বৃহৎ  পুঁজির পক্ষেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশ ও সংগঠিত করিবার অধিকার দেওয়া হইবে না।

(৩) যে সকল ব্যক্তি বিপ্লবের বিরোধিতা করিয়াছিল অথাবা বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল অথবা কোন সময়ে জনগণের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাইয়াছিল, সেই সকল ব্যক্তিদের সারা জীবনের জন্য অথবা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইবে। অপরাধের তারতম্য বিবেচনা করিয়া তাহাদের সম্পত্তি সম্পূর্ন অথাবা আংশিক বাজেয়াপ্ত, মৃত্যুদন্ড, কারাদন্ড কঠোর পরিশ্রমমূল্ক কাজ করিতে বাধ্য করা প্রভৃতি শাস্তি প্রদান করা হইবে। যাহাদের অপরাধ অপেক্ষাকৃত লঘু তাহাদের কম শাস্তি প্রদান করা হইবে এবং মার্কসবাদী পদ্ধতিতে তাহাতে চরিত্র সংশোধনের ( যেমন জনগণের সাথে মিশিয়া উৎপাদনমূলক শারীরিক পরিশ্রমে বাধ্য করা) প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হইবে। এই সব কিছুই নির্ধারিত হইবে স্থানীয়ভাবে জনগণের নির্ধারিত প্রকাশ গণ-আদালত দ্বারা।

ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ

         (১) রাষ্ট্র মানুষের নিজ নিজ ধর্ম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করিবে।

         (২) বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, কিয়াং ইত্যাদি এবং ধর্মীয় গবেষণাগারগুলি যাহাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হইবে পারে সেইজন্যে রাষ্ট্র ইহা তত্বাবধানে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করিবে এবং তাহা স্থানীয় ভিত্তিতে স্ব স্ব ধর্মের আগ্রহী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হইবে।

প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থাঃ

         (১) প্রশাসন ও বিচার বিভাগ হইতে আমলাতন্ত্রের সম্পূর্ন উচ্ছেদ সাধন করা হবে।

         (২) সরকার বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ ঐ পর্যায়ের গণপরিষদ কর্তৃক নির্বাচিত হইবে।

         (৩) বর্তমান সকল প্রকারের আইন বাতিল ঘোষণা করিয়া জনগণতান্ত্রিক সমাদ ব্যবস্থার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হইবে।

         (৪) বিচার পদ্ধতি হিবে সহজ, সরল ও জনগণের আয়ত্বধীন। বিচারসমূহ অনুষ্ঠিত হইবে প্রকশ্যভাবে ও স্থানীয় জনগণের মতামত সাপেক্ষে।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ

         (১) জাতীয় সরকারের অধীন সশস্ত্র গণফৌজ থাকিবে-ইহা দেশের ভিতরের ও বাহিরের প্রতি বিপ্লবী আক্রমণকে প্রতিহত করিবে এবং জনগণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কাজে অংশ গ্রহণ করিবে।

         (২) বিপ্লবের মধ্য দিয়া যে গণফৌজ গড়িয়া উঠিবে, বিপ্লবোত্ত্র যুগে তাহাই রাষ্ট্রীয় গণফৌজ হিসাবে পরিগণিত হইবে। এই গণফৌজ মূলতঃ ভূমিহীন ও গরীব কৃষক ও শ্রমিক যুবকদের লইয়া গড়িয়া উঠিবে।

         (৩) জাতীয় গণপরিষদের এই গণফৌজ পরিচালনার ব্যাপারে পূর্ণ অধিকার থাকিবে।

         (৪) এই সশস্ত্র গণফৌজ ছাড়াও সমগ্র অস্ত্রের শিক্ষা প্রদান করা হইবে এবং গণমিলিশিয়া গঠণ করা হইবে।

         (৫) গণফৌজ সম্পর্কে সমালোচনা ও সুপারিশ করিবার পূর্ণ অধিকার জনগণের থাকিবে।

         (৬) গণফৌজের সদস্যদেরো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিবার ও নিজস্ব পেশাগত সংগঠন করিবার এবং নির্বাচনের অংশগ্রহণ করিবার অধিকার থাকিবে। গণপরিষদসমূহে তাহাতের প্রতিনিধিত্ব থাকিবে।

         (৭) গণফৌজের বিভিন্ন পদ ও স্তরের সৈনিকদের পারষ্পারিকদের সম্পর্কে হইবে সাথী সুলভ ও ভ্রাতৃত্বমূলক-আমলাতান্ত্রিক নয়।

সংখ্যালঘু জাতিসংক্রান্ত নীতিঃ

         (১) পূর্ব বাংলার বসবাসকারী বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির পৃথক সত্তাকে স্বীকার করা হইবে। তাহাদের অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র উৎসাহ ও সাহায্যদান করিবে। সংখ্যালঘু জাতিসমূহের নিজ নিজ কথ্য ও লিখিত ভাষা ব্যবহারের অধিকার থাকিবে। তাহাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিল্পকলা বিকাশের এবং তাহাদের আচার ব্যবহার সঙ্গরক্ষণ বা পরিবর্তনের অধিকার দেওয়া হইবে।

         (২) ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত পূর্ব বাংলার স্থায়ীভাবে বসবাসকারী অবাঙ্গালীদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের পূর্ণ অধিকার প্রদান করা হইবে।

         (৪) যে সমস্ত অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতিরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সমস্ত অঞ্চলে তাহাদের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হইবে-এই স্বায়ত্ত্বশাসন জনগণতান্ত্রিক পূর্বা বাংলার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হইবে।

         (৪) জাতীয় পরিষদ ও জাতীয় সরকারে সংখ্যালঘু জাতিদের প্রতিনিধিত্ব থাকিবে।

 

পররাষ্ট্র নীতিঃ

         (১) শ্রমিক শ্রেনীর আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতির ভিত্তিতে সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বিশেষ করিয়া গণচীনের সহিত বন্ধুত্ব, পারষ্পারিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।

         (২) দুনিয়ার সমস্ত নিপীড়িত জনগণ ও নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সকল প্রকার সমর্থন ও সাহায্য প্রদান করা।

         (৩) পরষ্পরের ভূখন্ডের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের মর্য্যাদা রক্ষা করা; পরষ্পরকে আক্রমণ না করা; পরষ্পরের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা; সমানাধিকারের ভিত্তিতে পারষ্পরিক সুযোগ প্রদান ও শান্তি পূর্ণ সহ অবস্থান- এই পঞ্চশীলা নীতির ভিত্তিতে ভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থার রাষ্ট্রগুলির সহিত শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধনীতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করা।

         (৪) সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে দৃঢ়তার সহিত বিরোধিতা ও প্রতিহত করা।

         (৫) সম্প্রসারণবাদী ভারত ও ইসরাইলসহ সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়ানক রাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক বিরোধিতা করা।

         (৬) কোন প্রকয়ার সামরিক চুক্তিতে জড়িত না হওয়া; পূর্ব বাংলার মাটিতে কোন প্রকার বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী সামরিক অস্তিত্ব না রাখা; সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পূর্বতন এককেন্দ্রীক শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সম্পাদিত সকল প্রকার সামরিক ও অসম অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল করা।

         (৭) কোনরূপ রাজনৈতিক শর্ত জড়িত না থাকিলে যে কোন দেশের কারিগরী ও অর্থনৈতিক সাহায্য গ্রহণ করা।

         জনগণতান্ত্রিক অর্থনীতি রূপরেখাঃ

         সমাজতন্ত্রের অর্থনীতির লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে জনগণতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা হবে। এই জনগণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ  ও আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে। এর রূপরেখা হবে নিম্নরূপঃ

রাষ্ট্রীয় মালিকানাঃ

 

        (১) সকল সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা, সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদী ঋণ অস্বীকার করা, সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।

         (২) সকল বৃহৎ পুঁজি, যারা চরিত্র আমলা-মুৎসুদ্দি এবং যা পূর্ব বাংলার ক্ষেতে সম্পূর্ণ বিজাতীয় তা বাজেয়াপ্ত করা।

         (৩) যারা প্রতিবিপ্লবী ও বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাঁদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।

         (৪) জোতদার, মহাজন, দুর্নীতিবাজ, আমলা ও তাঁদের দালালদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। (জোতদারের বাজেয়াপ্তিত জমি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে)

         (৫) সকল ব্যাংক ও বীমা কোম্পানী রাষ্ট্রায়ত্ব  করা হবে এবং রাষ্ট্র নিজেই তা পরিচালনা করবে।

         (৬) সকল প্রাকৃতিক সম্পদ রাষ্ট্রের সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হবে, মধ্যস্বত্ব প্রথা বিলোপ করে রাষ্ট্র নিজেই এর রক্ষা করবে, বরং নিজের তত্ত্বাবধানে সম্পদ আহরণ করবে।

         (৭) রেলওয়ে, জাহাজ বিমান কোম্পানী, অস্ত্রের কারখানা, বিদ্যুৎ শিল্প ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকবে।

         (৮) যে সকল শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে আছে, তা পুরোপুরি রাষ্ট্রের মালিকানায় রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে থাকবে।

         (৯) পাটশিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ব করা হবে এবং নিজের মালিকানায় তা পরিচালনা করবে।

কৃষিনীতিঃ

         (১) “খোদ কৃষকের হাতে জমি”এই নীতির ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হবে। বিপ্লবের পর সমস্ত জমি পুনরায় জরিপ করে বর্তমানে জমি রেকর্ড ও খতিয়ানের ব্যাপারে যে সমস্ত ভুলভ্রান্তি রয়েছে রাষ্ট্র তা দূর করার ব্যবস্থা  করবে।

         (২) জোতদারী প্রথার উচ্ছেদ সাধন করা হবে। জোতদার ও তাঁদের দালালদের সমস্ত জমি ও চাষের যন্ত্রপাতি রাষ্ট্র দখল করবে এবং তা বিনামূল্যে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করবে।

         (৩) সরকারের সকল খাস জমি রাষ্ট্র দখল করবে এবং গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করবে।

         (৪) কৃষকদের মধ্যে বন্টনকৃত জমির প্রতি তাঁদের স্বত্বাধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে।

         (৫) সকল প্রকার বর্গা প্রথা বিলোপসাধন করা হবে। রাষ্ট্রকর্তৃক নির্ধারিত দৈনিক মজুরী দিয়ে ক্ষেতমজুর নিয়োগ করা যাবে। কিন্তু চাষের যন্ত্রপাতি ও কৃষি উৎপাদনে আবশ্যকীয় অন্যান্য সামগ্রী জমির মালিককে বহন করতে হবে।

         (৬) স্থানীয় পরিস্থিতি সাপেক্ষে জমির মালিকদের পরিবার প্রতি সর্বোচ্চ জমি সংরক্ষণের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। ধনী কৃষকদের কাছ থেকে এলাকা অনুযায়ী রাষ্ট্র নির্দিষ্ট উচ্চতম সীমার অতিরিক্ত জমি ক্রয়ের ব্যবস্থা করবে।

         (৭) খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যমানের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে ক্ষেতমজুরদের বাঁচার উপযোগী নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করা হবে।

         (৮) অকৃষক বিধবা (এই অকৃষক বিধবা বলতে কোন কৃষক পরিবারের বিধবাকে বুঝাবে না)। শিক্ষক, কুটিরশিল্পী, ছোট দোকানদার প্রবভৃতির হাতে বর্তমানে যে জমি আছে সেই সম্পর্কে জনগণতান্ত্রিক রাষ্টের নীতি হবেঃ

                           (ক) মুক্ত এলাকায় যদি এদের অবস্থান হয় (যেখানে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষকের বিপ্লবী সরকার              প্রতিষ্ঠিত হয়েছে) সেই এলাকায় অথবা সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সুসম্পন্ন হওয়ার পর                          তাঁদের কাছে থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিয়ে রষ্ট্র জমি ক্রয় করে নিবে এবং গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের কাছে               বিতরণ করবে। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জীবন ধারণের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান অথবা তারা যে পেশায়                            নিযুক্ত রয়েছেন তাতে তারা পরিবারের ভরণ-পোষণের উপযোগী আয় যাতে করতে পারেন রাষ্ট্র অবশ্যই তার             ব্যবস্থা করবে।

                           (খ) জনগণতান্ত্রিক বিপ্লন সুসম্পন্ন হওয়ার আগে অকৃষক বিধবা, শিক্ষক কুটির শিল্প, ছোট                     দোকানদার, শহরে কার্যরত শ্রমিক, স্বল্পআয়ভোগী ব্যক্তিদের জমি যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থাতেই                         থাকবে। কিন্তু বর্গাপ্রথার মাধ্যমে জমি চাষাবাদ করতে দেওয়া হবে না- উপযুক্ত মজুরী দিয়ে ক্ষেতমজুর                           নিয়োগ করে জমি চাষ করা যাবে।

         (৯) (ক) খাজনা প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপসাধন করা হলে খাজনার পরিবর্তে উৎপাদনের উপর কৃষি আয়কর প্রথা চালু করা হবে। ফসল না হলে অথবা উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণে না হলে আয়কর দিতে হবে না। ফসল  উৎপাদনের পর কৃষকদের সাধারণভাবে খাওয়া-পরার পর যা থাকবে, তার উপর আয়কর ধার্য করা হবে। কৃষকদের আয়কর ফসলে নেওয়া হবে। এই আয়কর ধার্য্য করবে মূলতঃ কৃষক প্রতিনিধি সম্বায়ে গঠিত ইউনিয়ন গণপরিষদ।

         (খ) গরীব ও মাঝারি কৃষকের সকল বকেয়া খাজনা ও সুদসহ ঋণ মওকুফ করা হবে।

         (গ) নদী শিকস্তি জমির জন্য কোন আয়কর দিতে হবে না এবং এর উপর কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে না বা নদী-নালা জমি-জমা ও ভিটামাটি হতে উচ্ছেদপ্রাপ্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

         (১০) (ক) হাট-বাজার, ঘাট, বন, পাহাড়, বিল প্রভৃতিতে যে ইজারাদারী, মহালদারী ও কন্ট্রাক্ট প্রথা চালু রয়েছে এবং মধ্যস্বত্ব ভোগ করার যে অধিকার বর্তমান ব্যক্তি বিশেষকে দেওয়ার বিধান প্রচলিত রয়েছে তা বিলোপ করা হবে।

        

         (খ) হাট-বাজারে জনসাধারণের খুচরা বেচা-কেনার উপর তোলা কর বিলুপ্তপ করা হবে। রাষ্ট্র নিজেই তা সংরক্ষণ করবে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা তা পরিচালনার ব্যবস্থা করবে। হাট-বাজার যথাযথ সংরক্ষণ ও উহার উন্নয়ন সাধনের জন্য পাইকারী ব্যবসায়ের উপর কর ধার্য্য করা হবে।

         (গ) বন, পাহাড়, বিল্, হাওর, নদী সহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদ রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। যারা নিজের হাতে শ্রমকাজ করবেন, রাষ্ট্র তাঁদের সামান্য করের বিনিময়ে বন-পাহাড়ে, বাঁশ, ছন, গাছ, কাঠ কাটার এবং বিলে ও জলাশয়ে মাছ ধরার অনুমতি প্রদান করবে।

         (১১) (ক) রাষ্ট্র সকল প্রকার মহাজনী বাতিল করবে। মহাজনদের সকল সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হবে।

         (খ) রাষ্ট্র কৃষকদের প্রয়োজনসাপেক্ষে চাষের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দ্রব্যসামগ্রী যথা গরু, বীজ, সার, আধুনিক চাষের যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য বিনা সুদে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান করবে।

         (১২) রাষ্ট্র কৃষকদের জীবনধারনের মানোন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সামগ্রিক স্বার্থে আধুনিক যান্ত্রিক চাষ ও যৌথ সমবায় প্রথা প্রবর্তনের জন্য তাঁহাদের উৎসাহিত করবে যাতে কৃষকেরা নিজেরা স্বেচ্ছামূলকভাবে এই পদ গ্রহণ করে। কৃষকেরা স্বেছায় যৌথ সমবায় প্রথার রাজী হলে তাঁদের রাষ্ট্রের পক্ষ হতে সস্তা দামে সকল প্রকার সামগ্রী সরবরাহ করা হবে। খাস জমি বন্টনের ব্যাপারে যোউথ সমবায় অংশগ্রহণকারী কৃষককে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই সুস্ত যৌথ সমবায় অবশ্যই কৃষকদের নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হবে-রাষ্ট্র এই ব্যাপারে কোন রকমের হস্তক্ষেপ করবে না।

         (১৩) কৃষকদের ফসলের জন্য প্রকৃতির উপর যাতে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে না হয় সেইজন্য রাষ্ট্রের পক্ষ হতে আধুনিক জলসেচের ব্যবস্থা করা হবে।

         (১৪) বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিকে বিপ্লবোত্তর অবস্থায় রাষ্ট্র প্রথম ও প্রধান বিষন বলে গণ্য করবে। বিশের সকল দেশ বিশেষ করে গণচীনের সাহায্য নিয়ে আমাদের দেশের অফুরন্ত জনশক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে পূর্ব বাংলার বন্যা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করা হবে।

         (১৫) কৃষকেরা তাঁদের অর্থকরী ফসল যেমন পাট, ইক্ষু, তামাক প্রভৃতির ন্যায্য দাম যাতে পাইতে পারে, রাষ্ট্র তার নিশ্চয়তা বিধান করবে। বিশেষ করে কৃষক পাতের ন্যায্য দাম যাতে পেতে পারে সেইজন্য রাষ্ট্র সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পাট ক্রয় করে তাঁদের প্রতিনিধি হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তা প্রদর্শন করবে, পাট কেনাবেচার ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাপ্ত পূর্ণ মূল্য রাষ্ট্র কৃষককে প্রদান করবে। দেশের শিল্পে ব্যবহার্য্য পাটের মুল্যও নির্ধারিত হবে এই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাপ্ত পূর্ণ পাটের মূল্যের সাথে সংগতি রেখেই। এইভাবে কৃষকের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

         (১৬) শিল্পে ব্যবহার্য্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যাপারে রাষ্ট্র সকল রকমের উৎসাহ ও সাহায্য প্রদান করবে।

শিল্পনীতিঃ

         (১) জনগণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের চরিত্র হবে সমাজতান্ত্রিক এবং তা সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে। কিন্তু জনগণের জীবিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এমন বক্তিগণ মালিকানায়া প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও পুঁজিবাদী উতপাদনে রাষ্ট্রা বাঁধা প্রদান করবেন না

        

         (২) রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ও পরিচালনায় মূল ও ভারী শিল্প গড়া হবে।

         (৩) বিদ্যুৎশক্তি, কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কল-কব্জা নির্মানের ব্যাপারে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে।

         (৪) বিলাসদ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহ করা হবে।

         (৫) (ক) ক্ষুদ্র শিল্প, যথা- তাঁত ও লবণ শিল্প সংরক্ষণ করার জন্য রাষ্ট্র যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (খ) পূর্ব বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত ও বয়ন শিল্প যাতে রক্ষা পেতে পারে ও উন্নত শিল্পে পরিণত হতে পারে,

         সেইজন্য রাষ্ট্র তাঁতীদের নিয়ন্ত্রিত স্বল্পমূল্যে সূতা সরবরাহ করবে। (গ) পূর্ব বাংলার লবণশিল্প ও ক্ষুদে লবণ উৎপাদকেরা যাতে রক্ষা পেতে পারে সেইজন্য রাষ্ট্র লবণ কর বাতিল করবে এবং বিদেশ হতে লবণ আমদানী নিষিদ্ধ করবে। লবণ চাষীরা যদি জোতদারের জমিতে লবণ চাষ করে তাহলে উক্ত জোতদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে লবণ চাষীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। জোতদার নয় এমন জমির মালিকদের জমিও উপযুক্ত মূল্যে রাষ্ট্র কিনে নিবে এবং লবণ চাষীদের মাঝে বিতরণ করবে। এইভাবে লবণ উৎপাদনের উপযোগী জমির উপর প্রকৃত লবণ চাষীর স্বত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হবে। লবণ চাষীরা যাতে যৌথ সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সেইজন্য রাষ্ট্র তাঁদের উৎসাহ প্রদান করবে।

         (৬) বনজ শিল্প সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।।

         (৭) পূর্ব বাংলার খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উপর রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করবে। পূর্ব বাংলার ভূগর্ভে কয়লা, তেল, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হওয়ার যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে রাষ্ট্র ব্যাপক অনুসন্ধান, পরীক্ষা ও খননকার্য্যের মাধ্যমে তা আহরণের সব রকমের ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।

         (৮) নদী-নালা, খাল-হাওর-বিলের দেশ পূর্ব বাংলার মৎস্য শিল্প গড়ে তোলায় জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশেষভাবে যত্নবান হবে। এই জন্য মাছ ধরা ও মাছ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে তা দূর করা হবে এবং একে পুর্ব বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও লাভজনক শিল্পে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্র নিম্নোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করবেঃ

         (ক) মৎস্য চাষের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। কৃত্রিম উপায়ে মতস্য প্রজননের ব্যবস্থা করা হবে।

         (খ) নতী-নালা, খাল-বিল ও হাওড়ে জেলেদের মাছ ধরা র জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ হতে মাছ ধরার যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী স্বল্পমূল্যে তাদের কাছে সরবরাহ করা হবে “জাল যার জল তার” এই নীতির ভিত্তিতে ইজারাদারী প্রতাহ ও জলকর গ্রহণ প্রত্যাহার করা হবে।

         (গ) বড় বড় নদী, গভীর সমুদ্রে রাষ্ট্র নিজেই সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা মাছ ধরার ব্যবস্থা করবে।

         (ঘ) মৎস্য সুংরক্ষণের জন্য কোলড স্টোরেজ ও দেশী-বিদেশী বাজারে চলালন দেওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

         (ঙ) আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য যাতে বিদেশে রপ্তানী হতে পারে তার উপর রাষ্ট্র বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করবে ও মৎস্য রপ্তানী ব্যবসাকে রাষ্ট্রায়ত্ব করা হবে।

         (৯) বিদ্যুৎ শক্তির উন্নয়ঙ্কল্পে আণবিক প্রকল্প নির্মাণ করা হবে।

         (১০) জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও গ্যাস শিল্পের উন্নয়ন করা হবে।

         (১১) সমস্ত শহর ও গ্রামাঞ্চলকে বৈদ্যুতিকরণ করা হবে।

শ্রমনীতিঃ

         শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের এবং ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নেতা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে শ্রমনীতি নির্ধারিত হবে। এর রূপরেখা হবেঃ

         (১) রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পরিপূর্ণ অধিকার থাকবে।

         (২) পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালনা ও ধর্মঘট করার অধিকার থাকবে।

         (৩) উভয় পক্ষের আলাপ আলোচনা ও জনগণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যস্থতায় শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার বিরোধগুলো মীমাংস করা হবে।

         (৪) রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমুহ শ্রমিক কর্মচারী ও রাষ্ট্র যৌথভাবে পরিচালনা করবে। রাষ্ট্র ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি যৌথভাবে শ্রমিকদের স্বার্থ, শিল্পের সম্প্রসারণ ও দেশের সার্বিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে শ্রমিকদের বেতন এবং আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করবে।

         (৫) সকল শ্রমিকদের জন্য বিনা ভাড়ায় পারিবারিক বাসস্থান, বিনা খরচে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ও বিনা পয়সায় আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমিক কর্মচারীদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য রাষ্ট্র বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। মহিলা শ্রমিকদের জন্য প্রসবকালীন সবেতন ছুটি ও প্রসূতি ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

         (৬) রোগ-ব্যাধি, কর্মক্ষমতা লোপ, বার্ধক্য ও অবসর গ্রহণকালে শ্রমিক কর্মচারীদের যত্ন, সাহায্য দান ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বৃদ্ধ বয়সে পেনশন, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ ও ভাতা প্রদান করা হবে।

         (৭) খাদ্য দ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের সাথে সমতা বিধান করে শ্রমিক কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করা হবে। এই নিম্নতম মজুরী এমন হবে যাতে শুধু শ্রমিকেরা নিজেরাই নয়, বরং তাঁদের পরিবার পরিজনসহ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাত্রা চালাতে পারে।

         (৮) একই সুযোগ সুবিধাসহ বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যতীত শ্রমিক ছাঁটাই করা চলবে না। শ্রমিকদের চাকরী হতে বরখাস্ত করা চলবে না, তবে শ্রমিকেরা কোন প্রকার অপরাধ করলে তার জন্য তাঁদের সংশোধনের দায়িত্ব শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গ্রহণ করবে।

         (৯) ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের অংশ গ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে।

         (১০) সকল প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নিম্ন বেতনের ব্যবধান হ্রাস করা হবে। সকল পর্যায়ের সরকারী কর্মচারীদের বেতনের ব্যবধানও হ্রাস করা হবে।

শিল্পে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রসঙ্গেঃ

         (১) রাষ্ট্র ব্যক্তিগত মালিকানায় শিল্প প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা, পুঁজির বিকাশ ও পুঁজিবাদী উৎপাদনের স্বাধীনতা প্রদান করবে, কিন্তু তা যাতে জনগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

         (২) ক্ষুদ্র শিল্প ও হস্ত শিল্প পুনঃনির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে এবং এই উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য শিল্প ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট পুঁজিপতিদের উৎসাহিত করা হবে।

         (৩) এই সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বহির্ভূত অথবা ঐ পরিকল্পনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন শিকপ বা ব্যবসায়ের অনুমতি দেবে না।

         (৪) দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহ দান ও সংরক্ষণের অনুকূল শুল্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

         (৫) এই সমস্ত শিল্পের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের অংশ গ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ করা হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!