শিরোনাম – রেসকোর্সর সম্বর্ধনা সভার মুজিব কর্তৃক জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবী
সূত্র – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখ – ২৪ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬৯
ঢাকার ইতিহাসে বৃহত্তম জনসভাঃ সংখ্যাসাম্য নয়- জনসংখ্যার ভিত্তিতে
প্রতিনিধিত্ব চাই
রেসকোর্সের গনসম্বর্ধনায় শেখ মুজিব
(স্টাফ রিপোর্টার)
গতকাল রবিবার রমনা রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের এক বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষনা করেন , আমি ছাত্রদের ১১ দফা শুধু সমর্থন ই করিনা এর জন্য আন্দোলন করে আমি পুনরায় কারাবরন করতে রাজী আছি । ……
জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষনা করেন যে কোনমতেই তাঁর দল সংখ্যাসাম্য মেনে নেবে না । সংখ্যাসাম্য যারা মানবে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঠাই নেই । …… সংখ্যাসাম্যের নামে পূর্ব পাকিস্তানকে ঠকান হয়েছে ।
তিনি সর্বস্তরে ও পর্যায়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবী করেন ।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত গনসম্বর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমান ভাষন দিচ্ছিলেন ।
তথাকথিত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার শেষে মুক্তির পর গতকালই তিনি প্রথম জনসভায় ভাষন দেন ।
এই গনসম্বর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক জনাব তোফায়েল আহমদ । সভায় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলায় অভিযুক্ত জনাব কে, এম , এস, রহমান সি,এস,পি, লিডিং সিম্যান জনাব সুলতানউদ্দিন , ষ্টয়ার্ড মুজিবর রহমান , জনাব এ, বি , খুরশীদ ও জনাব আলী রেজাসহ অন্যান্য অনেকে উপস্থিত ছিলেন ।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমি রাওয়ালপিন্ডি যাব এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের পক্ষ হতে তাদের দাবী তুলে ধরব । দেশ আমরা কারুর কাছে বিকিয়ে দেইনি । আমার ছয় দফার সাথে আমার দল ও জনগন আছে ।
ছাত্রদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন আপ্নারা নিশ্চিন্ত থাকুন । আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগনের দাবী আদায় করতে না পারি তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে যাব ।
আওয়ামী লীগ প্রধান শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলার উল্লেখ করে সকল ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব আদায়ের কথা বলেন । তিনি বলেন আমি সংখ্যা সাম্য মানি না ।
শেখ মুজিব বলেন ,জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন পার্লামেন্ট গঠন করতে হবে । বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল করা হবে না সংশোধন করা হবে পার্লামেন্ট ই তা নির্ধারণ করবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট প্রসঙ্গে তিনি বলেন , এক ইউনিট ভেঙ্গে ফেলার জন্য সেখানে একটা দাবি উঠেছে । তারা এক ইউনিট চায় না ।
তিনি বলেন , এ ব্যপারে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারনের ভোট নেয়া হোক তারা যদি এক ইউনিট না চায় তবে তা ভেঙ্গে দিতে হবে । এক ইউনিট ভেঙ্গে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকেও স্বায়ত্বশাসন প্রদানের তিনি দাবী জানান ।
শেখ মুজিব বলেন , পশ্চিম পাকিস্তানে প্রদেশগুলো নিয়ে একটা ফেডারেশন গঠন করতে হবে । জনমতের বিরুদ্ধে কোন কিছু চালিয়ে দেয়া চলবে না ।
চাকুরী , অর্থনীতি , শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন , রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত । ফলে সেখানকার লোক সব্রকম সুবিধা পাচ্ছে । দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ জন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হউয়া সত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারে বিভিন্ন চাকুরীতে পূর্ব পাকিস্তানীয় সংখ্যা শতকরা দশজনের কম । কেন্দ্রীয় সরকারের সকল অফিস আদালত শুধু রাজধানীতে ।তাই ব্যবসা বানিজ্যও সেখানে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে । ফলে এই প্রদেশে মূলধন গড়ে উঠছে না ।
দেশরক্ষা খাতের ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন এই খাতের শতকরা আশি ভাগ অর্থই পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় হয় । কারণ সামরিক সদর দফতর সেখানে অবস্থিত । তিনি বলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মজলুম এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নাই । ……
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে সংঘর্ষের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় অবস্থার উল্লেখ করে তিনি বলেন , এই অবস্থার অবসানের জন্যই লাহরে জাতীয় সম্মেলনে আমি দলের পক্ষ হতে ৬ – দফা দাবী পেশ করেছিলাম । তাতে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া হয়েছিল । আমরা দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন । আমরা কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব? আমরা চাই ন্যায্য অধিকার । …
তিনি বলেন , গুটিকয়েক ব্যবসায়ী , শিল্পপতি ও আমলার জন্য আমরা পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রাম করিনি । এ দেশের চাষী , মজুর , ছাত্র সকল মানুষের বাঁচার জন্য সংগ্রাম করেছিলাম । কিন্তু জালেমের পর জালেম এসেছে দেশে শাসন ক্ষমতায় । জনগন মুক্তি পায়নি । (?) ( লাইন মিসিং)
জগন্নাথ কলেজ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রভিন্সিয়ালাইজড করার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন এদেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করার জন্যই সরকার এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
কারখানার মালিকদের তিনি শ্রমিকের মুনাফার ভোগ প্রদানের আহবান জানান । তিনি বলেন , মালিকরা সব মুনাফ লুটেপুটে খেলে এমন দিন আসবে যখন কলকারখানা সবই বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে । শ্রমিক নির্যাতনের তিনি নিন্দা করেন ।
রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারে সরকারী নীতির তিনি তীব্র সমালোচনা করেন । বেতার কেন্দ্রসনূহকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন রবীন্দ্রনাথ বাংলার মানুষের কবি । তার গান রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে ।
শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে এরূপ কাজ হতে বিরত থাকার জন্য তিনি জনগণকে অনুরোধ জানান এবং সরকার কে উস্কানিমূলক কাজ হতে বিরত থাকতে বলেন । এ প্রসঙ্গে তিনি শহরের প্রতি মহল্লায় এবং মহকুমা ও জেলায় সংগ্রাম সমিতি গঠনের জন্য আহবান জানান ।
শত্রুর খপ্পরে না পরার জন্য তিনি সকলকে সতর্ক করে দেন । স্যান্ধ্য আইন ও সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানান । তিনি বলেন , আমাদের সংগ্রাম কমিটি মহল্লায় শান্তি বজায় রাখেন ।
শেখ মুজিব বলেন , পূর্ব বাংলায় হিন্দু , মুসলমান , বিহারী ও সকলেই আমরা শান্তিতে একত্রে বসবাস করব ।
পরিশেষে তিনি বলেন , বাংলার মাটিকে আমি ভালবাসি । বাংলার মাটিও আমাকে ভালবাসে । ১১ – দফার জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে তিনি তাঁর ৫০ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতা শেষ করেন ।