শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পল্টনের জনসমুদ্রে গৃহীত ছাত্রসমাজের প্রস্তাবাবলী | দৈনিক পাকিস্তান | ৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯ |
পল্টনে জনতার মহাসমুদ্রে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের
শপথনামা
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে গত রবিবার ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসমাবেশে গণমন উৎসারিত এক শপথধ্বনি কেবল বার বার আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া তোলে। সেই ধ্বনি ছিল ‘ডাঙ্গা আর গুলি জনতার হৃদয়বানী স্তব্ধ করিতে পারিবে না। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে নির্যাতনের পথে দাবাইয়া দেওয়া যাইবে না’। এই শপথনামা ছাত্রসমাজ জনতার পক্ষ হইতে জনতারই মহাসমুদ্রে উত্থাপন করিয়ানে অঙ্গীকারের দৃপ্ত আশ্বাসে।
দৈনিক সংবাদ, ফেব্রুয়ারী ১০, ১৯৬৯
গত (৯ই ফেব্রুয়ারী) সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসভায় প্রস্তাবাবলীঃ
শোক প্রস্তাব
অদ্যকার এই মহতী সমাবেশ গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিতেছে, শহীদ আসাদ, মতিউর, মিলন, আলমগীরসহ অন্যান্য বীর শহীদানের মহান স্মৃতি-যাহারা এদেশ হইতে স্বৈরাচারী ও একনায়কত্বের উচ্ছেদ করিয়া ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সর্বশ্রেনীর গনতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ছাত্রসমাজের ১-দফার সংগ্রামের আত্মাহুতি দিয়াছেন। এই মহতী সমাবেশ অমর শহীদানের প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা জানাইবার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় ঘোষণা করিতেছে যে, শাসক গোষ্ঠীর নিষ্ঠুর ও তীব্র আক্রমণে দেশবাসী ও ছাত্র সমাজ ভীত না হইয়া যে কোন মূল্যের বিনিময়ে গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থানের মহান পতাকা উড্ডীন রাখিবেই। গণঅভ্যুত্থানের শহীদবর্গের জন্য এই মহতী সমাবেশ সারা দেশ বিশেষতঃ সমগ্র পূর্ব বাংলার সকল জনগণের পক্ষ হইতে অন্তরের গভীর শোক প্রকাশ করিতেছে ।
শপথ প্রস্তাব
অদ্যকার এই মহতী সমাবেশ সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্র জনগণের পক্ষ বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণ করিতেছে যে, শতাধিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত সমগ্র পাকিস্তানের বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনগণের মহান গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকে যে কোন ত্যাগ ও মূল্যের বিনিময়ে অগ্রসর করিয়া লওলা হইবে। জনগণের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করিয়া সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় সাম্রজ্যবাদ, সামন্তবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদীদের স্বার্থে জনগণের ওপর নিরঙ্কুশ শোষণ নির্যাতন এবং পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের সরহাদ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সিন্ধু, বেলুচিস্তানের জনগণকে দমন ও নিপীড়ন চালাইবার জন্য দেশে যে অত্যাচার, স্বৈরাচারী ও একনায়কত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হইয়াছিল উহার চির অবসান ও উচ্ছেদ না ঘটা পর্যন্ত ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবেই। এই সমাবেশ ঘোষণা করিতেছে যে, স্বৈরাচারী একনায়কত্ববাদী আইয়ুব সরকারের অবসান ঘটাইয়া অবিলম্বে সারা পাকিস্তানের সকল জনগণের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম তথা প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন ভোটে পার্লামেন্টারী ফেডারেল সরকার কায়েম, সকল রাজবন্দীর মুক্তি, জরুরী আইন প্রত্যাহার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, ব্যাক্তি স্বাধীনতা কায়েম, সকল দমনমূলক আইন প্রত্যাহার করিয়া ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি, ব্যবসায়ী প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর জনগণের প্রাণের দাবী ও মুক্তির পথ ১১-দফা কায়েম না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। আজিকার এই সমাবেশ বর্তমানে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান ঘটাইয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রাম চালাইবার শপথ গ্রহণ করিতেছে।
রাজনৈতিক প্রস্তাব
এই মহতী সমাবেশ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর বিবেচনার পরে এই অভিমত ব্যক্ত করিতেছে যে, দেশের বর্তমান সংগ্রাম ও গনঅভ্যুত্থানের ফলেই আজ শাসকগোষ্ঠী জনগণ হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। জনগণের অভ্যুত্থান দমনের ক্ষমতা আজ সরকারের নাই। কেননা সমগ্র দেশবাসী আজ জীবন দিতে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত রহিয়াছেন। এই অবস্থার শাসক গোষ্ঠী গণদাবীর নিকট নতি স্বীকার করিয়া স্বৈরাচারী সরকারী কর্মকর্তাগণ কর্তৃক একদা দেশের বিকৃত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত গোল টেবিল আলোচনায় বসিবার প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছে। সরকার জরুরী আইন তুলিয়া দিতেও বাধ্য হইতেছেন। ইহা গনসংগ্রামের বিজয় এবং এইভাবেই আজ স্বৈরাচারী শাসন ধ্বসিয়া পড়িতে শুরু করিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে। জনগণকে পূর্ণ ঐক্য ও সংগ্রাম মজবুত এবং অব্যাহত রাখিতে হইবে। এই জন্য আমরা দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হইতে আহ্বান জানাইতেছি। কেননা রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্য গনসংগ্রামের আরও শক্তি যোগাইবে ও স্বৈরাচারের উচ্ছেদ তুরান্বিত করিবে এবং ছাত্র সমাজের ১১-দফা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আন্দোলনের ঐক্য রক্ষার্থে এই সমাবেশ গভীর আরোপ করিতেছে।
গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বশর্ত
এই সমাবেশ আরও ঘোষণা করিতেছে যে, আরও দাবী আদায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দলীয় নেতৃবর্গকে গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হইতে দেওয়া হইবে না। এই জন্য অবিলম্বে (ক) জরুরী আইনে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি তুরান্বিত করিতে হইবে। (খ) অবিলম্বে শেখ মুজিব, ওয়ালী খান, মনিসিংহ, তাজউদ্দীন, আব্দুল জব্বারসহ সকল নেতাকে মুক্তি দিতে হইবে। কেননা তাঁহারাই জনগণের দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কারারুদ্ধ হইয়াছে; (গ) নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। নিরাপত্তা বন্দীদের পক্ষে বাবু মহথ দে, সন্তোষ ব্যানার্জি গত ১০ বৎসর যাবৎ একটানা (সামরিক শাসনের সময় হইতে) নিরাপত্তা আইনে বন্দী রহিয়াছেন; (ঘ) দেশরক্ষা আইনে আটক ও রাজনৈতিক কারনে সাজাপ্রাপ্ত বেগম মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেমন ও মাহবুবুল হক দোলনসহ সকল ছাত্রবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। (ঙ) আগরতলা মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে; (চ) শ্রী খোকা (পৃঃ৫) রায়, সুখেন্দু দস্তিদার, অনিল মুখার্জী, মোঃ ফরহাদ, কাজী জাফর আহমেদ, নাসিম আলী, ফয়েজ উদ্দীন, আবদুস সাত্তার, সুনেন্দু কানুনগো, বরুণ রায় প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর হইতে হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরোয়ানা অবিলম্বে প্রত্যাহার করিতে হইবে। (ছ) সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দিতে হইবে। দেশ হইতে সকল দমনমূলক ব্যবস্থা ও সংখ্যালঘু অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালাকানুন অবিলম্বে বাতিলের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (জ) সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদ ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে এবং গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ঘোষণা করিতে হইবে। (ঝ) ছাত্রসমাজের শিক্ষা দাবী তথা ১১-দফার ১নং দাবী অবিলম্বে পূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। (ঞ) শ্রমিক-কৃষক-চাকুরিজীবিদের বেতন বৃদ্ধিসহ সকল জরুরী দাবীসমূহ পূরন করিতে হইবে। এই সমাবেশ এই আশু পূরণের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার ঘোষণা করিতেছে।
অন্যান্য প্রস্তাব
পূর্ব বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মহান দিবস শহীদানের রক্তস্মৃতি বিজড়িত ২১শে ফেব্রুয়ারীতে সমাগত। এই দিবসকে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী ছুটি ঘোষণার জন্য এই সমাবেশ জোর দাবী করিতেছি। অন্যথায় জাতীয় ছুটি দিবস হিসাবে ইহাকে উদযাপন করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আবেদন জানাইতেছে।
২১শে ফেব্রুয়ারী সূর্যোদয় হইতে মধ্যাহ্ন (১২টা পর্যন্ত) সকল যানবাহনের চাকা বন্ধ রাখার এবং অফিস-আদালত, হাট-বাজার, দোকান-পাট সকল কিছু সূর্যাস্ত পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য সর্বসাধারণের প্রতি অনুরোধ করা হইতেছে। ঐদিন সকল স্থানে কালো পতাকা উত্তলন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠানের জন্যও আহ্বান জানান হইয়াছে।
অফিসারদের শাস্তি ও নিহত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ
সাম্প্রতিক আন্দোলনে ছাত্রশিক্ষক-শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী সাধারণ নাগরিক নারী ও কিশোরদের উপর অকথ্য নির্যাতন অশোভন আচরণের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট অফিসারদের শাস্তি প্রদান করিতে হইবে।
এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের পদত্যাগ দাবী করিতেছে।
নাম পরিবর্তন
এই সভা আইয়ুব নগরের নাম শেরে বাংলা নগর, আইয়ুব গেট শহীদ আসাদুজ্জামান গেট এবং আইয়ুব চিলড্রেনস পার্কের নাম শহীদ মতিউর রহমান পার্ক রাখার প্রস্তাব করিতেছে।
২৪শে জানুয়ারী ১১-দফা দিবস
এই সভা প্রতি বৎসর ২৪শে জানুয়ারি ১১-দফা দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে।
এই সভা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রতীকস্বরূপ সকল বিরোধী মনোভাবাপন্ন মৌলিক গণতন্ত্রী, এম, এন, এ ও এম, পি, এ-দের পদত্যাগ করার আহ্বান জানাইতেছেন।