You dont have javascript enabled! Please enable it! ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক | মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক - সংগ্রামের নোটবুক

জীবনচিত্র       নামঃ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

Dr. Major A.K.M. Asadul Haq

ডাকনামঃ আসাদ

পিতার নামঃ মৌলভী সৈয়দ আহমেদ

পিতার পেশাঃ শিক্ষকতা

ভাইবোনের সংখ্যাঃ দুই ভাই ও তিন বোন, নিজক্রম-দ্বিতীয়

ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ তোফর আলী হাজী বাড়ি, ইউনিয়ন/

ডাকঘর-সন্তোষপুর, উপজেলা-সন্দ্বীপ, জেলা-চট্টগ্রাম

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ চট্টগ্রাম সামরিক হাসপাতাল কমান্ডিং অফিসারের বাসভবন, চট্টগ্রাম সেনানিবাস।

জন্মঃ ১ ডিসেম্বর ১৯২৮

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৪, কাঠঘর হাইস্কুল, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

আইএসসিঃ ১৯৪৬, চট্টগ্রাম কলেজ

এমবিবিএসঃ ১৯৫১-৫২, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (প্রথম ব্যাচ)

এফসিপিএসঃ কোয়েটা, পাকিস্তান

এফআরসিএসঃ ১৯৬২, রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস, ইংল্যান্ড

শখঃ বাগান করা, গাছ লাগানো, ঘুরে বেড়ানো

চাকরির বর্ণনাঃ

লেফটেন্যান্টঃ আর্মি মেডিকেল কোরের অধীনে বিভিন্ন সিএমএইচ, ১৯৫৩-১৯৫৬

ক্যাপ্টেনঃ কোয়েটা, পাকিস্তান, ১৯৫৬-১৯৫৮

ক্যাপ্টেনঃ এফতাবাদ, পাকিস্তান, ১৯৫৮-১৯৬০

মেজরঃ সিএমএইচ, যশোর, পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৬০-১৯৬৪

স্কোয়াড্রন লিডারঃ PAF Hospital, সারগোদা, পাকিস্তান, ১৯৬৪-১৯৬৫

মেজরঃ আজাদ কাশ্মির, পাকিস্তান, ১৯৬৬-১৯৬৮

মেজরঃ কমান্ডিং অফিসারঃ ৪৮, ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স, মুলতান, পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭০

মেজরঃ কমান্ডিং অফিসারঃ A.F.M.S.D. চট্টগ্রাম সেনানিবাস, ১৯৭০-১৯৭১

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি সদস্যঃ কর্নেল সিগরি

নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে নিখোঁজ; ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ নিহত মরদেহঃ পাওয়া যায়নি

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ আলাদাভাবে নেই। বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরুস্কারঃ পাননি

স্ত্রীর নামঃ মোমেনা হক

বিয়েঃ ৪ ১৯৪৬(আনুমানিক)

সন্তান-সন্ততিঃ তিন পুত্র, এক কন্যা

ফরিদা ইসলামঃ বিএ, মৃত্যু-মে ২০০৬

মো. আহসানুল হকঃ বিএসসি, আমেরিকা প্রবাসী

মেহবুব আলী হকঃ বিএ (অনার্স), এমএ (ইংরেজি)। সিনিয়র অফিসার, সোনালী ব্যাংক

ইউসুফ আলী হকঃ এমকম, ব্যবসায়

তথ্য প্রদানকারী

মেহবুব আলী হক

শহীদ চিকিৎসক পুত্র

‘বিচিত্রা’, ৫৬৫/এ, সিডিএ এভিন্যু,

পুর্ব নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম

 

অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম

শহীদ চিকিৎসকের জামাতা

বাড়ি নং-৯৯, জনতা হাউজিং

(আলাউদ্দিনের বাড়ি), মিরপুর-২, ঢাকা

 

১১৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

ফরিদা ইসলাম

 

দেশপ্রেমিক সাহসী যোদ্ধা, সুচিকিৎসক, সুঅভিভাবক এবং সর্বোপরি ভালো মানুষ-এসব কোনো বিশেষণই আমার বাবার জন্য অতিশয়োক্তি নয়। আমার এ স্মৃতিচারণমূলক লেখার মাধ্যমেই পাঠক আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে নিতে পারবেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজেই বাবার কাজকর্মে দেশপ্রেমের নমুনা উল্লেখ করবার মতো। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের রক্তঝরা দিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্ৰ বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত ভাষা শহীদদের লাশগুলো এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকে। আমার বাবা তখন ইন্টার্নি চিকিৎসক। লাশগুলো যদি সশস্ত্রবাহিনীর হস্তগত হয়ে যায় তবে হত্যাকাণ্ডের তথ্য ধামাচাপা দেয়ার একটি অপচেষ্টা হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে বাবা তার সহকর্মীদের দিয়ে লাশগুলো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেনযদিও তার এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি, তবু তিনি শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্ৰ বাহিনীর রোষানলে পতিত হন। সশস্ত্ৰ বাহিনী তার ডিএমসি হোস্টেল কক্ষ ঘেরাও করে ফেলে; তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হনগভীর রাতে আশ্রয় নেন। তার জেঠাত ভাই কমলাপুর নিবাসী মরহুম শামসুল হকের বাসায়। খবর পেয়ে পুলিশ সে বাসাও ঘেরাও করে ফেলে। কিন্তু বাবা কৌশলে টয়লেটের ভেতর দিয়ে পালিয়ে সে যাত্রায়ও রক্ষা পানএ ঘটনা আমি শুনেছি উল্লিখিত আমার জেঠা মরহুম শামসুল হকের নিজমুখ থেকে।

সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পর থেকেই বাঙালি অফিসারদের প্রতি অবাঙালি অফিসারদের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে বাবা খুবই সচেতন এবং প্রতিবাদী ছিলেন। বাঙালি অফিসারবৃন্দের নানাবিধ সমস্যায় তিনি সবসময় পাশে থাকবার চেষ্টা করতেন। পাশাপাশি দেশব্যাপী চলমান পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী গণআন্দোলন সম্পর্কে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে অজানা ছিল না। বাবার এই অকৃত্রিম বাঙালিতির কারণে তার সামরিক পদোন্নতি অনেকবার আটকে দেয়া হয়েছিল।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১১৭

 

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

 

১৯৬৮-৬৯-এর দিকে বাবা পাকিস্তানে মুলতান সেনানিবাসে কর্মরত। সপরিবারে আমরাও মুলতানে বাবার কাছে। মুলতান থেকেই আমি বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। বয়সের হিসেবে আমি তখন পরিণত। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ করে আমার আব্বাকে ঘিরে যাবতীয় স্মৃতি এখনও ছবির মতো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।

৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ উত্তাল আন্দোলনে কাঁপছে। এর মধ্যে বাবা বদলি হয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সিএমএইচে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন। ২৪ মার্চ ১৯৭১চারদিকে রটনা রয়েছে যে, যে কোনো মুহুর্তে মার্শল ল’ জারি হতে পারে।

এমতাবস্থায় বাঙালি সামরিক অফিসারবৃন্দ (মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট রাঙ্কের) একটি গোপন সভায় মিলিত হন। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) বাসভবনে। মেজর জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রামের মূল সেনানিবাসের বাইরে ষোলশহর এলাকার সেনানিবাসে কর্মরত। চট্টগ্রাম শহরের একটি হাউজিং সোসাইটিতে তাঁর বাসভবন (বর্তমান ‘প্রবর্ত সংঘের’ নিচে)ঐ বাসার গোপন সভায় বাবা সভাপতিত্ব করেন। বিস্তর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, যদি ২৫ মার্চ মার্শল ল’ জারি করা হয় বা বাঙালি হত্যার চেষ্টা করা হয় তবে সভায় উপস্থিত সব অফিসার মার্শাল ল’র বিরোধিতা করবেন এবং বাঙালি হত্যার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। এজন্য যদি তাদের কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হতে হয়, তবু তারা সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পিছপা হবেন না। ঐদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার সর্বশেষ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামেও তীব্ৰ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে; পথে পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। ফলে বাবা তার প্রাইভেট কারটি মেজর জিয়ার বাসায় রেখেই প্রায় ৬ কিমি পথ হেঁটে সেনানিবাসে ফেরত আসেন (পরবর্তীকালে বাবার হত্যার পর ঐ গাড়িটি অসংখ্য বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করা অবস্থায় পাওয়া যায়)।

২৬ মার্চ ১৯৭১রাত ১২টা ১ মিনিটে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা কোনো রকম পূর্বসঙ্কেত ছাড়াই ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের ওপর সশস্ত্ৰ আক্রমণ করে। তাৎক্ষণিকভাবে অগণিত বাঙালি সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। ঐ সঙ্কটময় মুহুর্তে লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং বাবা অতি দ্রুততার সাথে অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেনানিবাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিজেদের দখলে নিতে সফল হনএই যুদ্ধ রাত প্রায় ৪টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ৪টার একটু পর লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী স্বহস্তে মেশিনগান চালনারত অবস্থায় প্রতিপক্ষের মর্টারের গুলিতে নিহত হন। এতে বাঙালি সৈন্যদের মনোবল আকস্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই পশ্চাৎ দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির ট্যাঙ্কবাহিনী সর্বশক্তিতে বাঙালি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে আত্মসমৰ্পণ ছাড়া বাঙালি সৈন্যদের আর কোনো উপায় ছিল না।

এই প্রতিরোধ যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালি সৈন্যরা যেন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে এই সেনানিবাস থেকে বের হয়ে ষোলশহর সেনানিবাসে অবস্থানরত মেজর জিয়ার সাথে একত্র হওয়ার সুযোগ পান। এই সুযোগ সৃষ্টির জন্য লে. ক. এম আর চৌধুরী নিহত হওয়ার প্রাক্কালেই তৎকালীন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়াকে মেজর জিয়ার কাছে প্রেরণ করেন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বর্তমান অবস্থা অবহিত করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া ষোলশহর সেনানিবাসে গিয়ে মেজর জিয়াকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন এবং জানতে পারেন যে, মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরপোতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। সুবেদ আলী ভুঁইয়া তখন নিজে জিপ চালিয়ে আগ্রাবাদে গিয়ে মেজর জিয়াকে সংবাদ পৌঁছান ও তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ আলোচনার পর মেজর জিয়া ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে এসে তিনি, সুবেদ আলী ভুঁইয়া এবং তাঁদের অনুগত সৈন্যরা যুদ্ধ করে ষোলশহর সেনানিবাসটি পাঞ্জাবি সৈন্যদের দখলমুক্ত করেন।

এদিকে চট্টগ্রামের মূল সেনানিবাসে ভোর ছয়টায় বাঙালি অফিসারদের সপরিবারে সিএমএইচ মাঠে সমবেত করা হয়। আমার মা, আমি, বাকি দুই বোন ও এক ভাইসহ ঐ মাঠে বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি আর মৃত্যুর প্রহর গুনছি। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্নেল সিগরি (পাঞ্জাবি) মাঠে উপস্থিত বাঙালি সবাইকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু আরেক পশ্চিম পাকিস্তানি কর্নেল বেলায়েত (পাঠান) এ নির্দেশের বিরোধিতা করেন এবং সবাইকে বন্দি করে রাখার প্রস্তাব দেন। দু’জনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়। অবশেষে

 

১১৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

শহীদ ড. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

 

সিএমএইচের একটি সংক্রামক ব্যাধির ওয়ার্ড সম্পূর্ণ খালি করে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়।

২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে ঐ ওয়ার্ডে সম্পূর্ণ বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। খাবার দেয়া হতো না। মা সাথে করে কিছু চাল এনেছিলেন; সেই চাল আর ট্যাপের পানি খেয়ে বেঁচে রইলাম। জীবনধারণের সে কি দুঃসহ যন্ত্রণা!

১৭ এপ্রিল বিকেলে প্রথমবারের মতো খাবার দেয়ার পর বলা হয়, এগুলো আছরের আগেই খেয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তা বন্দিদের কেউই খেতে পারেনি। কারণ বিকেল ৪টার সময় বাবাসহ বেশ ক’জন সামরিক কর্মকর্তকে জরুরি তলব করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেননিবাবা, ডাঃ লে. ক. বদিউল আলমসহ আরো ক’জন লেফটেন্যান্ট, মেজর র্যাঙ্কের বাঙালি অফিসারকে তখনই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।

তাদের লাশগুলোর পর্যন্ত কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে বাবা যেমন মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র হয়েছিলেন, চিকিৎসক হিসেবেও তিনি অস্ত্রোপচারে দক্ষ ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে সার্জরিতে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। একজন সফল শল্যচিকিৎসক হিসেবে স্বনামধন্য ছিলেন। সামরিক বাহিনীতে Classified surgeon ছিলেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিসে গরিব দুস্থ রোগীদের বিনামুল্যে সেবাদান করতেন। পীড়িতের মুখে হাসি দেখতে পেলেই তাঁর নিজের মুখটা হাসিতে ভরে যেত।

বাবাকে ঘিরেই ছিল আমাদের পরিবারের আনন্দ-বেদনার কাব্য। তিনি পরিবারের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন। খুবই পত্নীবৎসল ছিলেন। সম্ভবত সেজন্যই বাবার মৃত্যুর পর আমার স্নেহময়ী মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। জীবদ্দশায় আর মানসিক সুস্থতা ফিরে পাননি।

আমার বিয়ের সাথেও বাবার শাহাদত বরণের ঘটনা জড়িয়ে আছে। বাবাকে হারিয়ে আমাদের পরিবার তখন দিশেহারা। তিন পুত্র ও বিবাহযোগ্যা আমাকে নিয়ে মা তখন অসহায়। আমার বাবা ও শ্বশুর (মরহুম মাওলানা সাইদুল হক) ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের সেই দুর্দশার সময় আমার শ্বশুর নিজের ছেলে (আমার স্বামী) রফিকুল ইসলামের সাথে আমার বিয়ের কথা বলেন। ও তখন ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত। সে অবস্থায়ই বাবার আহবানে ও আমাকে বিয়ে করে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে সংসারের বড় মেয়ে হিসেবে আমি ও বড় জামাতা হিসেবে আমার স্বামী পুরো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিই। আমার অসুস্থ মাও আমার সংসারেই ছিলেন। আমার চিকিৎসক স্বামী তার চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করেছিলেনশেষ পর্যন্ত তার কোলে মাথা রেখেই ২০০২ সালে আমার মা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

নিজের বিয়েবার্ষিকী উদযাপন করতে পারি না। কারণ সেদিন যে আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক শোকের দিন-শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমার বাবাও তো শহীদ চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরই একজন।

 

পাদটীকাঃ পারিবারিক সূত্র অনুযায়ী, ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত অবস্থায় তাঁকে লে. কর্নেল রাঙ্কে উন্নীত করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে শহীদদের সার্ভিস রেকর্ডের এতদবিষয়ক নথিপত্র বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয়নি। ফলে শহীদের স্ত্রীর প্রাপ্য পেনশন প্রদানের সময় শহীদের রাঙ্ক ‘মেজর’ হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১১৯

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

মেহবুব আলী হক

 

হত্যাকাণ্ডের পটভূমি

 

আমার পিতা শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ এম সি কোরের অধীন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল স্টোর ডিপোর (AFMSD) Commanding Officer পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তাঁর মরদেহ পর্যন্ত আমরা, তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেখতে পাইনি। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তায় প্রচণ্ডভাবে উদ্বুদ্ধ।

সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে তিনি নিজ বাঙালি জাতীয় স্বাতন্ত্র্যে ছিলেন আপোসহীনতাই বারবার তিনি চাকরিক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকের উত্তাল দিনগুলোতে সমমনা বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতেনএই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের (তৎকালীন মেজর জিয়া) Nasirabad Housing Society-র বাসায় বাঙালি অফিসারদের মিটিংয়ে যোগদান করেন। সেখান থেকে সেনানিবাসের বাসায় ফেরার পথে ষোলশহরে ২ নং গেটে ট্রেন দিয়ে ব্যারিকেড থাকার কারণে বাবা নিজ গাড়ি নিয়ে ফিরতে পারেননি। পরদিন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের বাসায় গাড়ি রেখে তিনি সেনানিবাসে ফিরে আসেন। তিনি তার সমমনা বাঙালি অফিসারদের এবং জওয়ানদের সতর্ক থাকতে এবং অস্ত্ৰ নিজ দায়িত্বে রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকসেনারা অতর্কিত আক্রমণ শুরু করলে আমরা আমাদের সেনানিবাসের বাসায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। পরদিন ২৬ মার্চ ভোরে ট্যাঙ্ক তাক করে আমাদের ও বেশ কয়েকজন বাঙালি সামরিক অফিসারকে পরিবারসহ ধরে তৎকালীন সিএমএইচের পেছনে টিলার ওপর অবস্থিত Isolation ward-এ বন্দি করে রাখে। পাক সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মাহবুব নামে একজন পাঞ্জাবি অফিসারের তত্ত্বাবধানে শিবির পরিচালিত হতোএখানে থাকা অবস্থায় তারা জানতে পারে যে, জিয়াউর রহমান সাহেবের সাথে আমার পিতার পূর্বেই যোগাযোগ ছিল; আরও জানতে পারে যে আমাদের

 

১২০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

গাড়িটা জিয়াউর রহমানের বাসায় আছে। এ তথ্য জানার পরে ১৭ এপ্রিল রাত ৮টার সময় আমার আব্বাসহ চারজন বাঙালি অফিসার, কর্নেল এস আই চৌধুরী (সিএমএইচের তৎকালীন প্রধান), মেজর ডা. রহমান এবং ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে তলব করে নিয়ে যায়।

আমরা তাদের আর দেখিনি। আব্বার মৃতদেহ পর্যন্ত পাইনি। এরপর আমরা আরো এক মাস বন্দি অবস্থায় খুব মানবেতর জীবনযাপন করেছি। পরে আমরা বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। পরবর্তীকালে বারবার যোগাযোগের পর আমাদের অক্টোবর ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সেনা হেডকোয়ার্টার থেকে বাবার শহীদ হওয়ার কথা নিশ্চিত করা হয়| আমার মা তখন থেকেই আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তিনিও বিগত ১৩.০২.০২ সালে পরলোকগমন করেন। জীবিত থাকাবস্থায় তাঁকে কখনো বিশ্বাস করানো যায়নি যে আমার আব্বা বেঁচে নেই; শহীদ হয়েছেন। কারণ আমরা তার মৃতদেহ পাইনি।

এ পর্যন্ত কোনো সরকার থেকেই সহযোগিতা পাইনি। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা ফলক নেই। মাঝে মধ্যে মনে হয় এ রকম কিছু থাকলেও তো আজকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের এগুলো দেখাতে পারতাম।

 

ব্যক্তিমানুষ, চিকিৎসক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে মূল্যায়ন

ডা: মেজর আসাদুল হক ছিলেন একজন বলিষ্ঠ, উন্নত চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী সৎ মানুষ। তাঁর চরিত্রে যেমন ছিল চারিত্রিক দৃঢ়তা তেমনি ছিল একটি কোমল মনএজন্য তিনি সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল, সদালাপী, ছোটদের প্রতি স্নেহপ্রবণ।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সৎ ও মিতব্যয়ী। চিকিৎসা পেশাকে তিনি ব্ৰত হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি শল্যচিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কর্মস্থানে তো নিষ্ঠাবান ছিলেনই, এর বাইরেও আর্ত মানবতার সেবা করতে

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১২১

 

শহীদ ডা. মেজর এ কে এম আসাদুল হক

 

সদাতৎপর থাকতেন। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেলে তাঁর অধিকাংশ সময় কাটতো গরিব-দুঃখী রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে। তাঁর গ্রামের বাড়ি অবস্থানকালে দ্বীপাঞ্চলের চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত রোগীদের কলরবে বাড়ির উঠান মুখরিত হয়ে উঠতো। শল্যচিকিৎসায় তাঁর দক্ষতা জরুরি তাৎক্ষণিক অস্ত্ৰোপচারে কাজে লাগাতেন। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরপর জরুরি ওষুধপত্রের বড় বড় চালান নিয়ে বিধ্বস্তপ্রায় সন্দ্বীপে তার নিজ গ্রাম সন্তোষপুরে গিয়ে ত্রাণসামগ্ৰী বিতরণে অংশ নেন এবং জরুরি চিকিৎসাসেবাও প্রদান করেন।

তিনি ছিলেন কঠোর দেশপ্রেমিক বাঙালি। পাঞ্জাবিদের বাঙালিবিদ্বেষ ও শোষণ তাঁকে পীড়া দিত। তিনি এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা হতেন না। এই প্রতিবাদ করার কারণে সামরিক বাহিনীর চাকরিজীবনে প্রমোশনের ক্ষেত্রে তাঁকে হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। আমরা বড় হওয়ার পর আম্মার কাছে শুনেছি ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের Aftabad-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় জনৈক সিনিয়র পাঞ্জাবি অফিসার কোনো এক ব্যাপারে All Bengaliees are bastard বলায় তিনি কোমর থেকে বেল্ট খুলে ওই অফিসারকে আঘাত করেছিলেন। এজন্য তাঁর পদোন্নতি আটকে গিয়েছিল।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান শহর থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আসেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন দুর্যোগ সামনে। তাই তাঁদের সমমনা বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। তখন প্রায় বিকেলেই দীর্ঘক্ষণ তিনি বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে মিটিংয়ে যোগ দিতেন। এসবকিছুই ধীরে ধীরে তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর প্রেক্ষাপট।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মারণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা/ ১৯৮৯ ইংরেজি ।

ঘ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯।

 

 

 

১২২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ