You dont have javascript enabled! Please enable it! ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী | মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক - সংগ্রামের নোটবুক

জীবনচিত্র    নামঃ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

Dr. Ayesha Bedora Choudhury

ডাকনামঃ ডোরা

পিতার নামঃ ইমাদউদ্দিন চৌধুরী

পিতার পেশাঃ সরকারি চাকরি, ভারত সরকার

মাতার নামঃ কানিজ ফাতেমা মাহমুদ

ভাইবোনের সংখ্যাঃ তিন ভাই ও তিন বোন, নিজক্রম-প্রথম ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ বাড়ি নং- ৬৬৭, সড়ক নং- ৩২(পুরাতন),

বাড়ি নং- ২৪, সড়ক নং- ১১(নতুন), ধানমন্ডি, ঢাকা

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ সড়ক ২৮(পুরাতন), ধানমণ্ডি, ঢাকা

জন্মঃ ৬ এপ্রিল, ১৯৩৫কলকাতা, ভারত

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৯, প্রথম বিভাগ, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, কলকাতা

আইএসসিঃ ১৯৫১, প্রথম বিভাগ, ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, কলকাতা

এমবিবিএসঃ ১৯৫৬, দুটি গোন্ড মেডেল, ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা

শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারঃ দুটি গোল্ড মেডেল(মেডিকেল), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

শখঃ বই পড়া, কবিতা আবৃত্তি, গান শোনা

চাকরির বর্ণনাঃ

গোয়াহাটি সরকারি হাসপাতাল, আসাম, ভারত, ১৯৬৪ যোগদান

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

মেডিকেল অফিসার, স্টেট ব্যাংক, ঢাকা, যোগদানের তারিখ জানা নেই, মৃত্যু অবধি এখানে ছিলেন

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা

কমিউনিস্ট পার্টি (ভারত), সক্রিয় সমর্থক ও সহযোগিতা, ১৯৪৯-৫৬

কমিউনিস্ট পার্টি (ভারতে ও পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে), সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডে গৃহবন্দি হিসেবে যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ছিলেন, সেই বাড়িতে অবস্থানরত পাকসেনারা।

নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

মরদেহঃ

প্রাপ্তি স্থানঃ রোড নং ১৮, ধানমণ্ডি

প্রাপ্তি তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ খালা, খালু, নানি ও ভ্রাতৃবধূর সামনেই মৃত্যুবরণ করেন

কবরস্থানঃ আজিমপুর কবরস্থান(পুরান), ঢাকা

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বি.এম.এ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি

স্বামীঃ প্রকৌশলী ড. আবুল বাশার

বিয়েঃ ১৯৬৮ সাল

সন্তান-সন্ততিঃ দুই কন্যা

ডা. মোনালিসাঃ এমডি, ইউএসএ, নিউইয়র্কে (আমেরিকা) হাসপাতালে চিকিৎসক

ডা. বেলারোসাঃ এমডি, ইউএসএ, বোস্টনে (আমেরিকা) হাসপাতালে চিকিৎসক

 

তথ্য প্রদানকারী

কানিজ ফাতেমা মহসিনা

শহীদ চিকিৎসকের খালা

বাড়ি নং-৬৬৭, সড়ক নং-৩২ (পুরাতন) এবং বাড়ি

নং-২৪, সড়ক নং-১১(নতুন), ধানমন্ডি, ঢাকা

 

১১০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

আমার বোনঝি

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

কে এফ মোহসীনা

 

 

আয়েশা বেদোরা চৌধুরী ডোরা তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। মেধাবী কর্তব্যপরায়ণ মেয়েটি পরিবারের জন্য একটা বিরাট আশ্রয় ছিল। ডোরাবিহীন বিশ বছর পর আজও তাই তার স্মৃতি কিছু মাত্র মলিন হয়ে যায়নি। বরং আনন্দ-বেদনায় ডোরার অনুপস্থিতিই আজ বড় বেশি বাজে।

ডোরাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৫৩ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতার বৈঠকখানা রোডের আমার পৈতৃক বাড়িতে। সেদিন আমার বড় বোনের ঘর আলো করে জন্ম নিল ডোরা। পিতা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী (১৯৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন) ও মা কানিজ ফাতেমা মাহমুদার (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে) প্রথম সন্তান ডোরা। কোঁকড়া চুলের মাথা দুলিয়ে বড় হতে থাকে। সাদামাটা বেশভূষা আর অতি অমায়িক ব্যবহার ছিল ওর প্রকৃতি। পরিচিত সবার প্রতি ডোরার অনুভূতি সদা জাগ্রত। মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে গোন্ড মেডেল পেয়ে এমবিবিএস পাস করে ভারতের আসাম সরকারের অধীনে চাকরি নেয় ডোরা। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কিছুদিন এবং এরপর ঢাকাস্থ স্টেট ব্যাংকের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ নেয়। এ সময়ই ১৯৬৮ সালে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড. আবুল বাশারের সঙ্গে ডোরার বিয়ে হয়। একটু দেরিতে হলেও ডোরা আর বাশার তাদের দু’জনের সংসার সাজিয়ে নেয় মিন্টো রোডের স্টেট ব্যাংকের কোয়ার্টারে। ড. বাশার তখন আইসিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় চাকরিরত। ডোরা আর বাশারের কোলজুড়ে এলো তাঁদের দুই কন্যা মোনালিসা (জন্ম-১৯৬৯) আর বেলারোসা (জন্ম-১৯৭০)লিসা, রোসাকে ঘিরে ওদের অনেক আশা। লিসা-রোসার গুটি গুটি পায়ের লাফালাফি আর আধো আধো মুখের বুলি ডোরার প্রতিটি বিকেল ভরিয়ে তুলতো হাসি আর আনন্দে।

দেশের অবস্থা তখন উত্তপ্ত। পথে পথে মিছিল-মিটিং। দুর্বার জনতা ফুঁসে উঠতে চায় ক্ষণে ক্ষণে। সবার মতো ডোরার চোখেও বাংলাদেশের স্বপ্ন। ডোরার জন্ম একটি রাজনৈতিক পরিবারে। আমার বাবা অর্থাৎ ডোরার নানা

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১১১

 

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

 

সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। তাই রাজনীতিসচেতন ডোরা মনে-প্ৰাণে এবং কাজেও মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। যুদ্ধের সময় ডোরা ওর মাকে নিয়ে ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের একটা বাড়িতে থাকত।

‘৭১-এর মার্চের শুরু থেকেই সবাই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তের প্রত্যাশায় ছিল। তবে সেই চরম মুহুর্ত যে কীভাবে আসবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছিল না। পঁচিশে মার্চের রাতে শেষ মিটিংটা করে বাড়ি ফিরল আমার দুই ছেলে হায়দার আকবর খান রনো এবং হায়দার আনোয়ার খান জুনো। রাত গভীর হতেই অস্ত্রের দুমদাম শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

এরপর বাড়িতে বিরতিহীনভাবে ফোন আসতে থাকল। শুনলাম পাকিস্তান আর্মি ঢাকা শহরে ট্যাঙ্ক নিয়ে নেমে গেছে। ফোনে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই রনো, জুনোকে বাড়িতে না থাকার কথা বলছে। উদ্‌ভ্ৰান্তের মতো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা-কিছু না জানিয়েই। এর একদিন পর ২৭ মার্চ অস্ত্ৰ জমা দেয়ার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করার ফাঁকে রনো-জুনো বাড়িতে এলো। এই সময় জাহানারা ইমামের টগবগে তরুণ ছেলে রুমী এসে এক রকম বিদায় জানিয়েই ওদের দু’জনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু খানিক বাদেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাযজ্ঞ দেখে বিহ্বল হয়ে ফিরল ওরা। ঘরে বসে আমরা যা ভেবেছি, পরিবেশ তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর, পরিস্থিতি অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও নির্দয়। বাড়ি ছেড়ে আমরা সবাই মে মাস পর্যন্ত শিবপুরে কাটালাম। ওখানকার মানুষের সাধ্যাতিরিক্ত সহযোগিতা পেয়েছি আমরা।

আমাদের পরিবারের কম বয়সী ছেলেদের নিয়েই তখন ভয় ছিল বেশি। আমরা অনেকেই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অধিক নিরাপত্তার আশায় ইন্দিরা রোডে আমার মেজো ভাইয়ের বাড়িতে উঠে এসেছি। সেই বাড়িও সুখানিবাস নয়। বিকেল হলেই ছেলেদের হাতে একটা করে পানির বোতল আর সঙ্গে রুটি বা বিস্কুট দিয়ে রাতের মতো পাঁচিল টপকে আশপাশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। কেননা, একই বাড়িতে বেশি অল্প-বয়সী ছেলে রাখা মানেই নিশ্চিত বিপদ। খবর পেলেই পাক, জিপ বা ট্রাকের শব্দের আমাদের হৃদকম্পন যেত থেমে। আমরা দুই ছেলে তো ২৭ মার্চ হতেই ধাকার বাইরে। ডোরার ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে দিলীর চৌধুরী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে) ও সেকেদার চৌধুরী (বর্তমানে ফ্রান্সে) মানিকগঞ্জে এবং বাবর চৌধুরী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে) কুমিল্লায় আত্মীয়দের বাড়িতে পালিয়ে যায়। ডোরার ছোট দুই বোন নীলুফার চৌধুরী (বর্তমানে দিল্লি) ও রাবেয়া চৌধুরী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে) কেউই তখন এ দেশে ছিল না। এর মাঝে অক্টোবর মাসে আমি ইন্দিরা রোড থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে এলে সেদিনই দখলদার বাহিনী বাড়ি ঘেরাও করে। অস্ত্রশস্ত্র এবং স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেরাই ওদের প্রধান লক্ষ্য। বাইরে দাঁড় করানো ট্রাকে চোখ-হাত বাঁধা কচি বয়সের ছেলেদের দেখে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে উঠেছিলাম সেদিনঢাকায় বহু আগে থেকেই পাক আর্মির জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ওদের দেয়াল চিরে বাঙালি দামাল ছেলেদের অপারেশনও চলছে মাঝে মধ্যে।

বাড়ি বসে আমরা মধ্যবয়সীরা তখন সারাক্ষণ নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি আর স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দিন গুনছি। সন্ধ্যা হলে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ যেন পরের দিনের জন্য অফুরন্ত সাহস আর শক্তি নিয়ে হাজির হতো। বাঙালি গেরিলাদের বিজয়ের টুকরো খবর সবচেয়ে উদ্দীপিত করত। ডোরা কিন্তু আমাদের মতো ভেবে ভেবেই সময় কাটায়নি। ডোরা ওর মহৎ পেশাকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নিবেদন করেছিল। ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিত। তাদের সেবা করত। আমার ছোট ছেলে হায়দার আনোয়ার খান জুনো তখন ঢাকার অদূরে শিবপুর এলাকায় যুদ্ধরত। জুনো গোপনে ডোরার বাসায় যেত। কখনও কখনও থাকত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে যেত।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১অনেক রক্ত ঝরিয়ে যেদিন পাক আর্মিরা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হলো সেদিন ডোরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে হানাদার বাহিনীর মাথা হেট করা আত্মসমৰ্পণ দেখতে চেয়েছিল। সেটাই ডোরার শেষ ইচ্ছে। পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের ঘোষণা শোনার সাথে সাথে ডোরা ওর মা ও মেয়েদের নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। ওর বাঁধন ছাড়া ইচ্ছেতেই আমি, আমার স্বামী হাতেম আলী খান, আমার ছোট পুত্রবধু মাহবুবা

১১২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১১৩

 

শহীদ ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী

 

রাশিদা চপল, আমার মা অর্থাৎ ডোরার নানি ও ড্রাইভার মনির আহমদ ডোরার টয়োটা গাড়িতে করে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখব বলে রওনা হলাম। ডোরা দুঃখ করে বলেছিল, আহা! যারা এই স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন তারা তো আজি আনন্দ করতে পারছেন না। ডোরা মনেও ভাবেনি আমাদের কাঁদাবে বলে মৃত্যু তখন ওর জন্য সন্নিকটে অপেক্ষা করছে। ধানমণ্ডি ১৮ নম্বরের যে বাড়িতে বেগম শেখ মুজিবুর রহমান তার দুই কন্যাসহ বন্দি ছিলেন সে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবস্থানরত দখলদার বাহিনী গাড়ির ওপর গুলি চালায়। গুলিতে ডোরা ও ড্রাইভার মনির আহমদ সাথে সাথে মারা যান। ডোরার মাথাটা ওর নানির কোলে আস্তে করে ঢলে পড়ে। আমি আর চপল আহত হই।

দুটি ফুটফুটে শিশু কন্যাকে অসহায় করে ডোরা মারা গেল। ঢাকা তখন আনন্দে মুখর, উত্তেজিত। আবার একই সঙ্গে অস্ত্ৰ জমা দিয়ে যাওয়ার সময় পাক আর্মিদের গুলিবর্ষণে অসংখ্য উল্লসিত মানুষ গুলিবদ্ধ হয়। সেদিন হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ১৬ তারিখের পাশবিকতায় ঢাকার কিছু কিছু রাস্তা, ফুটপাত, হাসপাতাল, সিঁড়ি, করিডোর আরেকবার রক্তে লাল হয়েছিল। চপল মাথায় ও আমি হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ডোরা ফিরল জীবন দান করে শহীদ নাম নিয়ে। শহীদ ডোরার লাশ আমার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির ভেতরের বারান্দায় শোয়ানো ছিল। শহরে তখন ব্ল্যাক আউট। সারারাত ডোরার পোষা কুকুর মৃত ডোরার পাশে ঠায় বসেছিলকুকুরটাকে সেদিন সরানো যায়নি মোটেও। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর বেগম সুফিয়া কামাল, মিসেস সায়েম (প্রেসিডেন্ট সায়েমের স্ত্রী) এবং মিসেস হাফিজ এলেন। ডোরাকে ওনারা গোসল করালেন। ডোরার মাথায় গুলি লেগে যে এক গোছা চুল উড়ে গিয়েছিল সে গোছাটা সযত্নে তুলে রাখা হলো। যে মেয়েটা আগের দিন বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেশের মানুষের সাথে আনন্দ ভাগ নিতে চেয়েছিল, পরের দিন তাঁর লাশ কবরস্থানে নেয়ার মানুষ ছিল না। গাড়ির ছাদের ওপর দড়ি দিয়ে বেঁধে ডোরাকে আজিমপুর গোরস্তানে নেয়া হলো| পরিজনদের অতি প্রিয় একটি প্রাণবন্ত, সম্ভাবনাময় প্রাণের যবনিকাপাত ঘটল।

‘দাড়িয়ে আছে তুমি আমার গানের ওপারে’-এই গানটি ডোরার খুব প্রিয় ছিল। শেষবারের মতো গানটি শুনে রেকর্ডটি রেকর্ডপ্লেয়ারের মধ্যে রেখেই ডোরা বের হয়েছিল। ডোরা কবিতাও ভালোবাসতো। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। ডোরার দুই মেয়ে লিসা-রোসা আজ অনেক বড় হয়েছে। ওরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে কি না জানি না; কবিতা ভালোবাসে কি না জিগ্যেস করিনি। কিন্তু ওরা দু’জনেই মায়ের মতো ডাক্তার। লিসারোসা খুব ভালো ফলাফল করে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত। ওদের বাবা আর নানি ওদের আগলে রেখেছেন। ওরা দুটি বোন মায়ের অসম্পূর্ণ কাজ পূর্ণ করবে বলে, বাবার সব শূন্যতা ভরিয়ে তুলবে বলে আর নানির চোখের পানি মুছিয়ে দেবে বলে পণ করেছে।

(*প্রকৌশলী ইফতেখার কাজল সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা থেকে সম্পাদিত)

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৬১৮, ৭০৭ ।

ঘ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬; পৃ. ৩৬

ঙ. *মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৩২

চ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ৪৩।

ছ. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান; সম্পাদনাঃ এ এস এম সামছুল আরেফিন; প্রকাশনাঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯৫; পৃ. ৫৪৫।

 

১১৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ