জীবনচিত্র নামঃ ডা. আব্দুর রহমান
Dr. Abdur Rahman
ডাকনামঃ কমল
পিতার নামঃ আব্বাস আলী
পিতার পেশাঃ ব্যবসায়
মাতার নামঃ জেবুন্নেসা খাতুন
ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও দুই বোন
নিজক্ৰমঃ দ্বিতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ বাসা নং-১০, রোড নং-৬/১ গার্ডপাড়া,
ওয়ার্ড নং-৪, ডাকঘর/উপজেলা/জেলা- লালমনিরহাট
শহীদ ডা. আব্দুর রহমান
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি নং-এস-৪৭ সাহেবপাড়া, ওয়ার্ড নং-৩ ডাকঘর/উপজেলা/জেলা-লালমনিরহাট
জন্মঃ ১৯২০
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৪২, প্রথম বিভাগ, বীরভূম হাই স্কুল, বীরভূম, ভারত
আইএসসিঃ
এলএমএফঃ ১৯৪৬, তৃতীয় স্থান, ক্যামবেল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা, ভারত
শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারঃ ক্যামবেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্রেস্ট উপহার, ১৯৪৭
শখঃ ডাকটিকিট সংগ্ৰহ সমাজসেবাঃ রেডক্রস
চাকরির বর্ণনাঃ সরকারি চাকরি
রেসিডেন্ট সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন (আরএএস), রেলওয়ে হাসপাতাল, লালমনিরহাট,১৯৬২-৭০
রেসিডেন্ট সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন (আরএএস), পুরুনীয়া রেলওয়ে হাসপাতাল, ১৯৪৬-৫১
রেসিডেন্ট সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন (আরএএস), সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতাল, ১৯৫১-৫৩,
সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন, সৈয়দপুর কারখানা রেলওয়ে হাসপাতাল, ১৯৫৩-৬২
হত্যাকারীর পরিচিয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত হওয়ার তারিখঃ ৪ এপ্রিল, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্ৰাপ্তি স্থানঃ লালমনিরহাট রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ গণকবর
প্ৰাপ্তি তারিখঃ ১৯৮৮
সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ লছমী সুইপার, হাসপাতাল কর্মচারী (দ্রষ্টব্যঃ সাক্ষ্য-পৃ. ১০১)
কবরস্থানঃ লালমনিরহাট রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ গণকবর
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ শহীদ ডা. রহমান সড়ক, লালমনিরহাট। লালমনিরহাট শহীদ স্মৃতিসৌধ, বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ লুৎফুন্নেসা খাতুন
বিয়েঃ ১ জানুয়ারি, ১৯৪৬
সন্তান-সন্ততিঃ চার পুত্র ও দুই কন্যা
ডা. লতিফুর রহমানঃ এমবিবিএস, লন্ডন প্রবাসী
হামিদুর রহমানঃ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ
মাহবুবার রহমান লাবলুঃ বিএসসি, লালমনিরহাটে কর্মরত
হাবিবুর রহমানঃ বিএসসি ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ
আখতার জাহানঃ বিএ, ঢাকা
মমতাজ জাহানঃ বিএ, ঝিনাইদহ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ
হামিদুর রহমান (শহীদ চিকিৎসকের দ্বিতীয় পুত্র)
হাবিবুর রহমান (শহীদ চিকিৎসকের কনিষ্ঠ পুত্র)
তথ্য প্রদানকারী
মাহবুবার রহমান লাবলু
শহীদ চিকিৎসকের পুত্ৰ
বাসা নং-১০ রোড নং-৬/১ গার্ডপাড়া, ওয়ার্ড নং-৪, ভাকঘর/উপজেলা/জেলা-লালমনিরহাট
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৯৭
আমার বাবা
শহীদ ডা. আব্দুর রহমান
মাহবুবার রহমান লাবলু
সাঁইত্রিশ শ’ বছরের তুলনায় ৩৭ বছর অনেক কম সময়। কিন্তু এক থেকে সাঁইত্রিশ গুনলে খুব কম সময় নয় নিশ্চয়। উনিশশ একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির নয় মাসের সশস্ত্ৰ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্বের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ সৈনিক সংবলিত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করেছিল।
তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল আমাদের এই বাংলাদেশ। বেসামরিক ও সামরিক আমলারা বাঙালিদের শোষণ করেছে। উভয় আমলার একই সুর-বাঙালিকে শোষণ করো। কিন্তু এই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আহ্বান করবে কে? আহ্বান জানালো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বললেন, “শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও ‘বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা কর্মসূচি দিলেন তিনি। মুক্তি অর্জন করতে বাঙালি জনতা উচ্চারণ করল ‘জয় বাংলা’ মুক্তির বাণী। অর্থাৎ বাঙালির জয় হবেই।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর বাহিনীরা গণহত্যা শুরু করলে মধ্যরাতের পরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালিরা বসে ছিল না; তারাও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু বাংলাদেশের কতিপয় এলাকায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা কিছু কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। যেমন— সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, সান্তাহার, ঈশ্বরদী, লালমনিরহাট এগুলো ছিল রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং সব এলাকায় বিহারিদের প্রভাব ছিল বেশি, যারা কখনও বাঙালিদের স্বাধীনতা চায়নি। বাংলাদেশে থেকেও তারা পাকিস্তানিদের সহযোগী দোসর হিসেবে কাজ করে গেছে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে এদের ভূমিকার কাহিনী ছিল লোমহৰ্ষক, ভয়াবহ এবং পৈশাচিক।
লালমনিরহাটে আমি ছিলাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি ও ছাত্রলীগ সভাপতি। সে কারণে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা মুক্ত রেখেছিলাম এই এলাকা। কতিপয় অবাঙালি বিহারিদের সহযোগিতায় ৩ এপ্রিল পাকবাহিনী আমাদের প্রতিরোধ
৯৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. আব্দুর রহমান
ভেঙে লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটিতে প্রবেশ করে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে বহু বাঙালি নিজ দায়িত্বে গ্রামের দিকে সরে যায়। পরের দিন ভোর হতেই পাকবাহিনী শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে।
সেদিন ছিল ৪ এপ্রিল। আমার মতো অনেক রেলওয়ে বাঙালি কর্মচারীর জন্য এক লোমহর্ষক ভয়াবহ দিন। এদিন থেকে শুরু হয় লালমনিরহাট এলাকায় ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড। রেলওয়ে হাসপাতালে কিছু আহত বাঙালি ও অবাঙালি তখন চিকিৎসাধীন ছিল। পাক বর্বর বাহিনী তখন আনুমানিক সকাল ৯টার সময় হাসপাতাল এলাকা ঘিরে ফেলে আমার বাসা ছিল হাসপাতালের পাশেই, বাড়ি নং এম-৪৭। তখন কতিপয় বিহারি নির্দেশ করতে থাকে যে, ‘ইয়ে এক লিডারকা ঘর হায়।’ পাকবাহিনী বাসায় এসে আমার খোঁজ করতে থাকলে আমার বাবা শহীদ ডা. রহমান বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে আমার ছোট ভাই জগলু।
আমার পিতা যিনি চিরদিন মানবসেবা করে গেছেন তাকে তখুনি নির্মমভাবে গুলি করা হয়। গুলি খাওয়ার পর পিতা চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমি তো চিকিৎসক আমার কী অপরাধ।’ তখন তার মস্তক লক্ষ্য করে আবার গুলি করা হয়। পিতার সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় ছোট ভাই জগলুকে। আমার আর এক ভাই বাবলু এই হত্যাকাণ্ডের পর পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় বিহারিদের কারনে। করেকদিনের মধ্যে বিহারীরা তাঁকে আটক করে এবং পরে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেই কেবল তারা ক্ষান্ত হয়নি। ঘরের সবকিছু স্থানীয় অবাঙালিরা চোখের পলকে লুটে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় রেলওয়ে কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে গণহত্যা। হত্যা করা হয় রেলওয়ে হাসপাতালের বিধবা নার্স লতিফা হকের দুই নয়নমণি টুটু ও নুটুকে। মায়ের সামনে তাদের হত্যা করা হয়। গুলি করা হয় ক্যারেজ খালাসির সন্তান আবদুল্লাহকে। তবুও সে বেঁচে ছিল। কিন্তু অবাঙালিরা তাকে বাঁচাতে দেয়নি। রাতের বেলায় তাকে লোহার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে হত্যা করা হয়।
ম্যালেরিয়া খালাসি মণ্ডল পরিবারের ১১ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অসহায় পিতা সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। হত্যা করা হয়েছিল বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। হত্যা করা হয় ওয়াহেদ গার্ড সাহেবকে; স্ত্রী-পুত্রের সামনে।
এরপর রেলওয়ের বাঙালি কর্মচারীদের ওপর নেমে আসে আরও চরম দুর্ভোগ। অবাঙালিরা বাঙালি রেলওয়ে কর্মচারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে রেলওয়ে রিকশাস্ট্যান্ডে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত এবং বাঙালি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সর্বস্ব লুটপাট করতো।
অসুস্থ ফারুক বসন্তে আক্রান্ত ছিল; তাকে বিছানা থেকে তুলে এনে জবাই করা হয়। হত্যা করা হয় সাকীকে এবং বহু নাম জানা ও অজানা রেলওয়ে কর্মচারী এবং তার পরিবারের সদস্যদের।
এসব বাঙালি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কী অপরাধ ছিল? তারা চেয়েছিল এই বাংলার স্বাধীনতা। তারা রেলওয়ে মহল্লায় তুলেছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা।
অবাঙালিদের সঙ্গে বাস করে তারা বুঝতে শিখেছিল, পাকিস্তান নামক দেশটি আর কিছুই নয়, বাঙালিদের শোষণ করার একটি স্থান। বাঙালি কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে অপমানিত হতে হতো অবাঙালিদের হাতে।
পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অবাঙালিরা বাঙালিদের তালিকা তৈরি করে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত হত্যা করার জন্য।
মানুষের ইতিহাস মূলত সংগ্রামের। স্বাধীনতা অর্জনে ত্যাগ শব্দটির একক ভূমিকা| ত্যাগের ইতিহাস রেখে গেছে রেলওয়ে কর্মচারীরা। এজন্যই ইতিহাসে রেলওয়ে এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রাম অনন্য, ব্যতিক্রমধর্মী। ভিন্ন এর প্রেক্ষাপট, ভিন্ন এর ত্যাগের গরিমা।
রংপুরের পাটগ্রাম, ফুলবাড়ী অঞ্চলটি সম্পূর্ণ হানাদারমুক্ত ছিল। এখানে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে থানা, কোর্ট, হাটবাজারও চলেছে। আমি বালারহাট যুবক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেক্টরের চেয়ারম্যান ছিলেন মতিয়ার রহমান। আমরা দেখেছি শত শত যুবক সাপের কামড়ও খেয়েছে, তবুও তারা হতাশ হয়নি। চেয়েছে শুধু অস্ত্র আর ট্রেনিং। বালারহাট যুব ক্যাম্পে থাকাকালীন দেখেছি বহু রাজাকার। তৎকালীন ৬নং সেক্টেরের অধিনায়ক মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে বহু রাজাকারকে আটক করি। শুনেছি লালমনিরহাটের
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৯৯
শহীদ ডা. আব্দুর রহমান
ভয়াবহ কাহিনী। একজন মার হাত-পা বাঁধা, বিবস্ত্র-বিক্ষিত শরীর রক্তরঞ্জিত। আধাকাটা স্তন থেকে ছোট ছোত বাচ্চা উপুর হয়ে রক্ত চাটছে। চিৎকার চৌচির চারিদিকে। মা নিশ্চুপ, শিশুটি কাঁদছেই। শত শত মা জাগল না। সন্তানের কাছে নিষিদ্ধ হলো মায়ের দুধ।
আজ আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। তবু কেন বৃহৎ সংস্থা রেলওয়ের এই করুণ অবস্থা? মনে হয় টাইটানিক জাহাজের মতো বরফে ধাক্কা খেয়ে আস্তে আস্তে ডুবছে। রেলওয়ের শত শত মূল্যবান সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য আমরা কী করেছি? তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কি আমাদের দায়িত্ব ছিল না? কিছুটা হতাশা, কিছুটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিছুটা অহংবোধ আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটাচ্ছে বলেই আজ আমরা ভুলে যাই যে কত রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা এই অবস্থান।
আসুন আমরা কিছু একটি করি। খুঁজে বের করি সব ইতিহাস। সেসব শহীদের স্মৃতি ধরে রাখতে মনে হয় ব্যর্থ হয়েছি। তবুও আমরা লালমনিরহাটে তাদের স্মৃতি রক্ষা করার চেষ্টা করি। আনুমানিক ১৯৮৮ সালের দিকে লালমনিরহাট রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পাশে একটি রাস্তা তৈরি করার সময় কিছু গর্ত করে মাটি তোলা হয়। তখন সেখানে ঘড়ি, চশমা ও স্বর্ণালঙ্কার ও মানুষের কঙ্কাল ও খুলি পাওয়া যায়। তখন আমি কতিপয় সুইপারকে ডেকে জানতে পারি যে, বহু রেলওয়ে কর্মচারীর লাশ সেখানে পোঁতা হয়। পরে এক অনুষ্ঠানে এদের স্মৃতি রক্ষার প্রস্তাব করি। তৎকালীন ডিআরএম ইকবালউদ্দিন চৌধুরী সেসব রেল কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্মৃতি রক্ষার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্ৰহণ করেন। এলাকাটি গণকবর হিসেবে ঘিরে রাখা হয় এবং তিনি নিজ উদ্যোগে একটি সুন্দর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও শহীদদের নামের তালিকা করার ব্যবস্থা করেন। এই স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
১০০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
(যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ; সম্পাদনাঃ ডা. এম এ হাসান; প্রকাশনাঃ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার; প্রকাশকালঃ মে ২০০১; পৃ. ২৮৯ থেকে সঙ্কলিত)
১৯৭১ সালে আমি লালমনিরহাট স্টোর পাড়ার বাসিন্দা ছিলাম। একদিন সকাল সাতটায় ডিউটিতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি, সবাই পালাচ্ছে। আমার ছেলেমেয়েরা তখন বাড়িতে ছিল। আমি তখন মনে করলাম। এলাকার সবাই যখন পালিয়ে যাচ্ছে তখন অনেক গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি, পাঞ্জাবি সৈন্যরা পজিশন নিয়ে লাইন ধরে বসে আছে। এই অবস্থা আমি আমার বাসায় যেতে পারলাম না। পাশের একটা ড্রেনে ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সেখানেও গুলি হচ্ছিল। তখন বাড়িতে রেখে আসা আমার ছেলেমেয়েদের জন্য খুব চিন্তা হছিল। এরপর সেখান থেকে কোনোরকমে পালিয়ে আমি রেলওয়ে হাসপাতালে ঢুকে যাই। হাসপাতালে ঢুকে দেখি সেখানে ডা. রহমান ও অন্য একজন ডাক্তার তাদের চেম্বারে বসে আছে। তাদের দেখে আমি বলি, ‘স্যার, আপনারা চেম্বারে বসে আছেন, এদিকে, তো আর্মিরা শহরে ঢুকে গোলাগুলি শুরু করেছে।’ তাঁরা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই আর্মিরা গুলি করতে করতে হাসপাতালে ঢুকে পরে এবং ডাক্তারদের ডাক দেয়। তখন ডাক্তার রহমান চেম্বার থেকে বাইরে বের হওয়া মাত্রই আর্মিরা তাঁকে গুলি করে। গুলি লাগার সাথে সাথে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং ‘পানি! পানি!’ বলে কাতরাতে থাকেন। এরপর আর্মিরা তাঁকে আরেকটি গুলি করে। এ সময় তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি ছিল তাঁদের এবং হাস্পাতালের কর্মচারীদের লাইনে দাঁড় কড়িয়ে এক সাথে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমি সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে এসব দেখতে পাই। হানাদাররা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেখানে যাকে পাচ্ছিল সেখানেই গুলি করে হত্যা করছিল। স্থানীয় বিহারিরা তাঁদের এসব কাজে সহায়তা করে। তিনদিন ধরে তাঁরা এরকম হত্যাকান্ড চালায়।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসুত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
খ. যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ; সম্পাদনাঃ ডা. এম এ হাসান; প্রকাশনাঃ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার; প্রকাশকালঃ মে ২০০১; পৃ. ২৮৯।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ১০১
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ