১৯ শ্রাবণ, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ৫ আগষ্ট ১৯৭১
তেহরান টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা ১৫ ভাগ ছিল হিন্দু ধর্মালম্বীদের ভোট। তাই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছে এটা বলা যাবে না। (হিঃ টাঃ)
ঢাকা থেকে ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা ক্লারা হলিংওয়ার্থ জানিয়েছেন, চার মাসে সেনাবাহিনীর অবস্থান, কাজের ধারা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তরুণদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, আর লোকজন প্রাণের মায়ায় ঘর-বাড়ি ছেরে চলে যাচ্ছে দূ-দূরান্তে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। ক্লারা আরো জানান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। গেরিলা আক্রমণ, বিস্ফোরণসহ সব ধরনের অপারেশনে পাকিস্তানী বাহিনী প্রায় নাস্তানাবুদ।
৮ নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ সাইফুদ্দিন আহমেদ এ দিন চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুরহুদা থানার নাটুদা বাগোয়ানের নিকট রতনপুরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার জন্য শহীদ খালেদ সাইফুদ্দিন আহমেদ “বীর বিক্রম” উপাধিতে ভূষিত হন
পাকিস্তানী নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদের আর পাকিস্তানী সরকারের কুটনীতিক, লন্ডনের কর্মরত অডিট এবং একাউন্টসের পরিচালক মোঃ আকবর লতিফুল মতিন প্যারিসে কর্মরত মোশাররফ হোসেন এবং মিঃ শওকত আলী পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেন বাঙালী স্বাধীনতার দাবিতে একাত্ম ঘোষণা করে।
সাতকানিয়া কলেজ এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জন শত্রু সেনা, ৭ নম্বর সেক্টরের গোদাগড়ি হাইস্কুল ঘাঁটিতে ৩ জন রাজাকার, দক্ষিণ কুমিল্লায় ৩ জন পাকসেনা হত্যা ও ২ জনকে আহত করা হয়।
৭ নম্বর সেক্টরে শিতলাই ব্রিজ ঢাকা-কুমিল্লা-চিটাগাং সেক্টরের মেহবাজারে ব্রিজ ধ্বংস ময়মনসিংহ ন্যাশনাল ও জনতা মিলে বিস্ফোরণসহ নানা অপারেশনে এদিন মুক্তিযোদ্ধারা তৎপর ছিল।
-জামাতে ইসলামীর রংপুর জেলা সেক্রেটারী মওলানা কাজী নজমুল হুদা সৈয়দপুর, নীলফামারী, ডোমার, জলঢাকা, পীরগাছা, গান্ধা এলাকায় রাজাকারদের কর্মতৎপরতা পরিদর্শন করে জানায়, জেলায় ৬ হাজারেরও বেশি রাজাকার সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে দুস্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তাছাড়া মুজাহিদ বাহিনীর মাধ্যমেও অনেকে দেশের সেবা করেছে। উল্লেখ্য, রাজাকারদের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে আরো ছিলেন জামায়াত নেতা মুখলেছুর রহমান, জবান উদ্দিন আহমদ প্রিন্সিপাল রুহুল ইসলাম এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর এ আর খান। (সংগ্রাম)
-হানাদাররা জামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে ৯৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এবং আটক করে ৫ জনকে।
-পূর্ব বাংলার প্রথম গভর্ণর স্যার ফ্রেড্রিক বার্ণ জানান, পাকিস্তানের সংহতি জন্যে প্রয়োজন ছিল সামরিক হস্তক্ষেপের। তিনি আরো বলনে “আমি আরও বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের শত্রুরা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সরলপ্রাণ লোকদের বিপথে পরিচালিত করে এবং বিদেশী শক্তির ক্রীড়ানকে পরিণত হয়।” (দৈঃ পাঃ)
-এদিন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি তেহরান দৈনিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন ইয়াহিয়া খান বলেছেন যে, শেখ মুজিব সংখ্যালঘুদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ঐ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন। মুখপাত্র বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে ৮২ শতাংশ ভোট পেয়েছে সেখেত্রে সংখ্যালঘুদের ভোটদাতার সংখ্যা ১৬ শতাংশের মত। তিনি ইয়াহিয়া খানের এ ধরনের বক্তব্য দূরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করে। (বিডি-১ পৃঃ ৩৪০)
শ্বেতপত্র
-এদিন পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রথমবারের মত পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ৭০ পৃষ্ঠায় ইংরেজীতে White Paper “শ্বেতপত্র” প্রকাশ করে। এই দলিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালীরা সব কিছুর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করা হয়। ‘শ্বেতপত্রে’ বলা হয় সংবিধানে প্রণয়ন সম্পর্কে আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জন্য প্রকারন্তে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অনুপ্রবেশের পর তাঁরা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করে। শ্বেতপত্রের পরিশিষ্টে বলা হয়, চট্টগ্রাম এলাকা পাঁচ দিনে বিদ্রোহীদের দখলে থাকাকালে ১০ থেকে ১২ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। তাছাড়া, বগুরা ও খুলনায় যথাক্রমে ২০ হাজার ও ৮ হাজার বিহারী হত্যা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে ‘শ্বেতপত্র” (সংক্ষিপ্ত বিবরণী) বাংলায় প্রকাশ করে যা পরিশিষ্ট-১২-তে দেয়া হল।
-কিসিং কনটেম্পরারী আরকাইডস’ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইংরেজীতে প্রকাশিত শ্বেতপত্রের আণীত অভিযোগগুলো খন্ডন করে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম সহকারী রাজনীতিবিদ ডঃ কামাল হোসেন ১৯৭৪ সাল ইংরেজীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাসঃ দলিলপত্র’ এ স্মৃতিচারণ মূলক বক্তব্য প্রকাশিত হয়। তিনি পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে “শ্বেতপত্র” এ উত্থাপতি অভিযোগ আদৌ সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য, মার্চ ১৫-মার্চ ২৫, ১৯৭১ তারিখের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের যে আলোচনা হয় ডঃ কামাল হোসেন তাঁর সাক্ষ্য। সেকালে অজানা তথ্যের উদঘাটনের জন্য বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ ডঃ কামাল হোসেনের ইংরেজী স্মৃতিচারণের প্রাসঙ্কি অংশ পরিশিষ্টকে-১২ (ক) দেয়া হ’ল।
-মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র’ ‘শ্বেতপত্র’ কে ডাহা মিথ্যার দলিল বলে চিহ্নিত করে। এ প্রসঙ্গে ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক পত্রিকা (১৩ আগষ্টের সংখ্যা) ‘জল্লাদের শ্বেতপত্র’ শিরোণামে প্রথম সম্পাদকীয়তে পাক সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী