You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম

সূত্র তারিখ
ন্যাপের বিশেষ অধিবেশনে মওলানা ভাসানী কর্তৃক আন্দোলনের কর্মসূচী পেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পুস্তিকা ৩০ নভেম্বর, ১৯৬৭

রংপুরে অনুষ্ঠিত ন্যাপের বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষে

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অভিভাষণ, রংপুর শহর, ৩০শে নভেম্বর, ১৯৬৭ সাল

সমাগত কাউন্সিলার বন্ধুগণ,

এক কঠিন রোগ ভোগের পর আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত হইতে পারিয়া আমি সত্যিই আনন্দিত। অসহ্য যন্ত্রণাময় সেই দিনগুলিতে বার বার এই কথাই আমার মনে হইয়াছিল হয়ত আর একবার শেষবারের মত আপনাদের সাথে মিলিত হইতে পারিব না। কিন্তু পরম করুনাময় আল্লাহতালার অপার দোয়া এবং আমার প্রতি আপনাদের অসীম ভালবাসা এবারও আমাকে মৃত্যুর পথ-যাত্রা হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছে। জানি না আবার ভবিষ্যতে এমনি একটা মহতী সমাবেশে আমি আপনাদের সহিত মিলিত হইতে পারিব কিনা। দেশবাসীর প্রতি আপনাদের প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতি অবিচল আস্থা নিয়াই হয়ত এই শেষবারের মত আপনাদের সামনে আমি হাজির হইয়াছি।  আপনাদের অকুন্ঠ দেশপ্রেমের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ সালাম আপনারা গ্রহণ করুন।

বন্ধুগণ!

আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এক গভীর সংকটময় মুহূর্তে আপনারা আজ এখানে সমবেত হইয়াছেন। আমাদের সংকট যতই গভীর এবং ব্যাপক হউক না কেন, জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অন্তদৃষ্টি এবং বিশ্বজোড়া পরিসরে সুপ্রসারিত স্বচ্ছ দৃষ্টি লইয়া আন্তর্জাতিক প্রতিটি সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ করিয়া আপনাদের কর্তব্য নির্ধারণে আপনারা যে সক্ষম এই বিশ্বাস আমার আছে। আপনাদের সুগভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা রাখিয়াই আজ আমি আপনাদের সামনে কয়েকটি কথা উপস্থিত করিতে চাই।

 

 

এক সর্বগ্রাসী গভীর সংকট

আমাদের দেশ আজ এক বর্ণনাতীত সর্বগ্রাসী সংকটে নিমজ্জিত। স্বাধীনতা লাভের পর বিগত বিশটি বছর ধরিয়া একটানা ক্রমবর্ধমান গতিতে সংকট বৃদ্ধি পাইয়া স্তূপীকৃত সংকট দেশবাসীকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়াছে।

কৃষককুলের অবস্থা

সংকটগ্রস্ত দুস্থ জনতার কথা উল্লেখ করিতে হইলে সর্বপ্রথম উল্লেখ করিতে হয় আমাদের শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত কৃষক সমাজের কথা। দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৮২ জন লইয়া যে কৃষক সমাজ, তার জীবনে বিগত ২০ বছর কি আনিয়াছে? মনে পড়ে সামরিক শাসনামলের গোড়ার দিকে এই প্রদেশের জনৈক গভর্নরের তেজগাঁও বিমানবন্দরের একটি কথা। করাচী থেকে প্রত্যাগত গভর্নর বাহাদুর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জওয়াবে গ্রীবা উন্নত করিয়া দিগন্তের সবুজ বনানীর দিকে তাকাইয়া বলিয়াছিলেনঃ

“চারিদিকে আমি দেখিতেছি এক প্রাচুর্যের সমারোহ”। সামরিক শাসকদের কয়েদখানায় বন্দী অবস্থায় থাকিয়া সেদিন এই কথাগুলিই সেই গভর্নরকে ডাকিয়া বলিতে ইচ্ছা হইয়াছিলঃ

হে গভর্নর বাহাদুর এ দেশের কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতী মানুষের রক্ত নিংড়াইয়া বিমানবন্দরের যে অনুপম প্রাসাদ গড়িয়া উঠিয়াছে তার শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত লাউঞ্জে দাঁড়াইয়া কৃষকের সৃষ্ট দিগন্ত প্রসারিত শ্যামল বনানীর শ্যামলিমাই তুমি দেখিয়াছ। তুমি দেখ নাই তার অন্তরালের নিরন্ন বিবস্ত্র আর তিলে তিলে মৃত্যুপথযাত্রী শীর্ণ কৃষকেরা শোষণ জর্জর পান্ডুর চেহারা। যাহারা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছে নয়নাভিরাম প্রাচুর্যের সমারোহ তাহাদের দিকে একবার ফিরিয়া তাকাইবার প্রয়োজনীয়তাও তোমরা অনুভব কর নাই। তোমাদের আরাম-আয়েশ আর বিলাস বাসনের স্বার্থে তোমরা শোষক গোষ্ঠী এ দেশের কৃষককুলের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছ ৯৩ কোটি টাকার ঋণের বোঝা। তোমাদের শিল্পপতি গোষ্ঠী বিগত ২০টি বছর ধরিয়া এদেশের কৃষক-শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে গড়িয়া তুলিয়াছে বিরাট বিরাট পুঁজি আর মুনাফার পাহাড়। কৃষককে তোমরা দাও নাই তার অর্থকরী ফসল-পাট, তামাক আর কুসাইয়ের মূল্য। কৃষকের দীর্ঘকালের দাবী পাটের ন্যায্যমূল্য ৪০ টাকার দাবীকে তোমরা প্রহসনে পরিণত করিয়াছ। বাহ্যিক লোক দেখানো কায়দায় তোমরা পাটের তথাকথিত সর্বনিম্ন মূল্য ২৬ টাকা থেকে ২৮ টাকা ধার্য্য করিয়াছ কিন্তু ঐ নির্ধারিত মূল্যে পাট ক্রয়ের জন্য কলকারখানার মালিক আর বড় বড় ব্যবসায়ীদের বাধ্য করার কোন ব্যবস্থা তোমরা কর নাই। তোমরা সুকৌশলে কৃষক সমাজকে ১৫/১৬ টাকা মূল্যে পাট বিক্রয় করিতে বাধ্য করিয়া একচেটিয়া ধনিক গোষ্ঠীর সস্তা দরে পাট ক্রয়ের সুযোগ করিয়া দিয়াছো।

অন্যদিকে তোমরা দিনের পর দিন জমির খাজনা-ট্যাক্স বৃদ্ধি করিয়া টাকা প্রতি তের আনা দশ পাই অতিরিক্ত করের বোঝা চাপাইয়া দিয়া তোমাদের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিলাস ব্যসনের সুবন্দোস্ত করিয়াছ। চলতি সনেও তোমরা একর প্রতি ৫০ পয়সা জমির খাজনা বৃদ্ধি করিয়াছ। তারপরেও তোমাদের শোষণ লিপ্সার কমতির কোন লক্ষণ আমরা দেখি না। তোমাদের রাজস্ব মন্ত্রী এই সেদিনও বলিয়াছেন যে, এ দেশের জমির খাজনা নাকি অন্য দেশের তুলনায় কম। তোমরা এ দেশের কৃষক সমাজের ঘাড়ে আরও ট্যাক্স খাজনার বোঝা চাপাইতে চাও। কী ধৃষ্টতা! কী দুঃসাহস তোমাদের। ৪০/৫০ টাকা মণ দরে চাউল কিনিয়া খাইবার ক্ষমতা যখন দেশের শতকরা ৯২টি কৃষক পরিবারের নাই তখন তাদের প্রাসাচ্ছাদনের কথা তোমরা একবারও ভাব না। তোমরা তোমাদের লগ্নির টাকা আদায়ের জন্য কৃষকদের উপর যখন লক্ষ লক্ষ সার্টিফিকেট জারি কর এমনকি তাদের বিরুদ্ধে বডি-ওয়ারেন্ট পর্যন্ত জারি করিতে তোমরা দ্বিধা কর না। তখন কি তোমরা মুহূর্তের জন্যও ভাবিয়া দেখিয়াছ যে তোমাদের জীবনের প্রাচুর্যের সমারোহ সৃষ্টি যে কৃষক সমাজ, সেই কৃষক সমাজ আজ তিলে তিলে মৃত্যুর পথে চলিয়াছে।

বন্ধুগণ! আমি জানি কৃষক জীবনের এই দুরাবস্থার চিত্র আজ শোষক গোষ্ঠীর সামনে তুলিয়া ধরা নিরর্থক। তাই আমাদের কৃষককুলের সমস্যাবলী আমি আপনাদের সামনেই উপস্থিত করা সঙ্গত মনে করি।

ন্যাপের দৃষ্টিতে আইয়ুব সরকারঃ

ন্যাপের দৃষ্টিতে আইয়ুব সরকার হইতেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট বড় বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শ্রেণী-একনায়ক সরকার, একই শ্রেণী স্বার্থের প্রতিরক্ষক সরকার। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বেশি বড় বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদ এই ত্রিশক্তি এক এবং অবিভাজ্য। এই তিন শক্তির শাসনের অবসানের মধ্য দিয়াই আমাদের দেশের জনগন তাহাদের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করিতে পারে।

আজিকাল মূল রাজনৈতিক প্রশ্নঃ

বন্ধুগণ, দেশী প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠী ও তাহাদের সহযোগী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আমাদের গণতান্ত্রিক মহলের কিছুটা মোহমুক্তি ঘটিলেও আজিকার কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাহাদের বিভ্রান্ত কাটে নাই।

দেশের গণতন্ত্রকামীদের যে অংশ পূর্বে মার্কিন সাম্রজ্যবাদীদের বন্ধু মনে করিতেন বর্তমানে তাহারা সাম্রজ্যবাদ সম্পর্কে কিছুটা নিরপেক্ষতার ভাব দেখান। এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ক্ষেত্রে মার্কিন বিরোধিতার প্রসঙ্গটি অবতারণা করিয়া তাহারা মার্কিনদের বিরাগভাজন হইতে চান না। তাই তাহারা প্রস্তাব করেন- আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাক তারপর সাম্রজ্যবাদ বিরোধিতার প্রসঙ্গটি বিবেচনা করা যাইবে। কাজেই প্রশ্ন দেখা দিয়াছে- কোন কাজটি আগে করিতে হইবে? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, না সাম্রাজ্যবাদের বিতাড়ন?

আমার মতে প্রশ্নটিকে এইভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায় না। গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং সাম্রজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এক এবং অবিভাজ্য। কেননা আমি ইতিপূর্বেই আলোচনাতে দেখাইয়াছি যে আমাদের দেশের মার্কিন সাম্রজ্যবাদী স্বার্থ এবং দেশী বড় পুঁজি ও সামন্তবাদী স্বার্থ একই সূত্রে গ্রথিত। দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আঁতাতকে যেমন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা যায় না তেমনি এই আঁতাতের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামকে ও দুই অংশে ভাগ করা যায় না। ইহাদের একটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে গেলে সেই সংগ্রামে অপরটিও জড়িত হইয়া পড়িতে বাধ্য। অতএব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এক এবং অবিভেজ্য।

আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নেঃ

ন্যাপের সাথে মতপার্থক্যের উল্লেখ করিতে যাইয়া আমাদের বন্ধুরা বলিয়াছেনঃ

  “বিভেদপন্থী গ্রুপটি ৬-দফা আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়া প্রকারন্তরে স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বিরোধিতা করিয়াছে।”

বন্ধুদের এই অভিযোগে হাসি সম্বরণ করা সত্যি কঠিন। পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগনের স্বাধিকারসহ পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সাম্রজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্র নীতির দাবীতে যে ন্যাপের জন্ম সেই ন্যাপ স্বায়ত্তশাসন দাবীর বিরোধিতা করিতেছে, ইহার চাইতে হাস্যকর কথা আর কি হইতে পারে? তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের বন্ধুদের ন্যায় ন্যাপ দেশের জনসংখ্যার শতকরা ১ ভাগেরও কম উদীয়মান বাঙ্গালী বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিফলন যে ৬- দফা, তাহাকে “জাতীয় মুক্তিসনদ” হিসাবে আখ্যায়িত করিয়া স্বায়ত্তশাসনের নামে জনতাকে বিভ্রান্ত করিতে চায় নাই। স্বায়ত্তশাসন বলিতে ন্যাপ দেশের কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত তথা শতকরা ৯৮জন মেহনতী মানুষের স্বায়ত্তশাসনই বুঝিয়াছে এবং তার ১৪-দফা কর্মসূচী মারফত দেশবাসীর সামনে তাহাদের করণীয় তুলিয়া ধরিয়াছে।

আমাদের বন্ধুরা বলিয়াছেন যে, “তাহারা মনে করেন ৬-দফা কর্মসূচী লাহোর প্রস্তাব ও ২১-দফা কর্মসূচীর ১৯ দফার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ।” বেশ ভাল কথা। এক্ষেত্রে তাহাদের উদ্দেশ্যে এক প্রশ্ন করিতে চাই। ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যখন ১৪-দফা কর্মসূচী গৃহীত হয় তখন তাহারা উক্ত ১৪-দফা কর্মসূচীকে লাহোর প্রস্তাব ও ২১-দফা কর্মসূচীর ১৯নং দফার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ মনে করিয়াই উহার সহিত একমত হইয়াছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁহারা এই ১৪-দফার মধ্যে কি কি অসঙ্গতি আবিষ্কার করিলেন? এবং কেনই বা আজও সে সম্পর্কে তাঁহারা নীরব রহিলেন?

বন্ধুগণ! আসল কথা হইতেছে এই যে, আমাদের বন্ধুরা হইতেছেন উদীয়মান বাঙ্গালী বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিভূ। পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সহিত আমাদের বাঙ্গালী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দকে “৬-দফার” নামে স্বায়ত্তশাসনের লেবাস পরাইয়া তাঁহারা হাজির করিয়াছেন। আমার সুস্পষ্ট অভিমত হইতেছে- কয়েকজন অবাঙ্গালী আদমজী দাউদের স্থলে কয়েকজন বাঙ্গালী আদমজী দাউদ সৃষ্টিই যদি ৬-দফার লক্ষ্য হইয়া থাকে তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষ কোনদিনই তার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতে যাইবে না। কেননা, যে ৬-দফা কর্মসূচীতে বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা মেহনতী মানুষের অধিকারের কোন স্বীকৃতি নাই স্বায়ত্তশাসনের নামে সেই ৬-দফা ভিত্তিক তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অনিবার্যভাবেই উদীয়মান বাঙ্গালী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর হাতে বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা মেহনতী মানুষের উপর শোষণ-পীড়ণ চালাইবার অধিকারে পর্যবসিত হইতে বাধ্য। কাজেই আজ প্রশ্ন উঠেঃ কোন নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন তথা জনগনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জিত হইবে।

নেতৃত্বের প্রশ্নঃ

বন্ধুগণ! এই প্রসঙ্গে ন্যাপের এই অংশের ভুল উপলব্ধির প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার মনে করি। প্রশ্নটি হইতেছে নেতৃত্বের প্রশ্ন। অর্থাৎ গণতন্ত্রের সংগ্রাম কোন নেতৃত্বে পরিচালিত হইবে।

আমার সমগ্র পর্যালোচনা থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে যে মূল রাজনৈতিক কাজটি বাহির হইয়া আসে তাহা হইতেছে দেশে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার কাজ। বর্তমান সরকারের পরিবর্তে এইরুপ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশের বর্তমান সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বড় পুঁজির কবলিত অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করিয়া পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষি জনগণের স্বায়ত্তশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং তাহাদের জীবনযাত্রার গণতান্ত্রিক বিকাশের পথকে উন্মুক্ত করিতে পারি।

সংগ্রামী বন্ধুগণ! আপনারা সকলেই স্বীকার করিবেন যে ইহা একটি অত্যন্ত সুকঠিন কাজ। ইহার জন্য প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক সজাগ, সচেতন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পোড়-খাওয়া অবিচল নেতৃত্ব। আমাদের বিগত দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে আমরা সুস্পষ্ট দেখিয়াছি যে ন্যাপ ব্যাতীত আমাদের দেশের বর্তমান অন্য সব রাজনৈতিক দলই সেই নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। তার প্রধান কারণ ঐ সমস্ত দলের নেতৃত্বে আসিয়াছে দোদুল্যচিত্ত দুর্বল বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী ও সামন্তবাদী শ্রেণী হইতে। অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই দুর্বল নেতৃত্ব দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নিকট নতি স্বীকার করিয়া বৃহত্তর জনস্বার্থকে বিসর্জন দিয়াছে। আমি তাই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজিকার দিনে আমাদের ন্যাপই একমাত্র রাজনৈতিক দল যে দল কৃষক-শ্রমিক তথা সর্বহারা মেহনতী মানুষের মুক্তির কর্মসূচী গ্রহণ করিয়াছে। ন্যাপ তাই তার কর্মসূচীকে বাতিল করিয়া অপর কোন কর্মসূচী গ্রহণ করিয়া তার লেজুড়বৃত্তি করিতে পারে না। 

ইদানীং আমাদের বন্ধুরা মরিয়া হইয়া উঠিয়াছেন এবং আমাদের সংগঠনের নিয়ম-শৃঙ্খলা অমান্য করিয়া ন্যাপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় মাতিয়াছেন। আপনাদের নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা ন্যাপের সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও বড় বুর্জোয়াবিরোধী গণতন্ত্রের সংগ্রামী পতাকাকে সমুন্নত রাখুন এবং বিভেদপন্থীদের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করিয়া ন্যাপের ঐক্য-সংহতি রক্ষা করুন। এবং এই পতাকাতলে সকল শোষিত মানুষকে সমবেত করিয়া বর্তমান স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর অপসারন এবং তাহার পৃষ্ঠপোষক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিতাড়নের সংগ্রামকে অগ্রাসর করিয়া নিন।

জয় আপনাদের অবশ্যম্ভাবী।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জিন্দাবাদ

পাকিস্তান জিন্দাবাদ

স্বৈরাচারী নিপাক যাউক

সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হউক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!