জীবনচিত্র –নামঃ ডা. আবু বারেক মোহাম্মাদ নূরুল আলম
Dr. Abu Barek Mohammad Nurul Alam
-পিতার নামঃ মৌলানা মজিরুদ্দিন আহমেদ
-ভাইবোনের সংখ্যাঃ সাত ভাই ও ছয় বোন, নিজক্রম-ষষ্ঠ
-ধর্মঃ ইসলাম
-স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-ধনতলা, ইউনিয়ন-মুরশিদ হাট,
-ডাকঘর- সেতাবগঞ্জ, উপজেলা-বোচাগঞ্জ,
জেলা-দিনাজপুর
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ শাহবাজপুর, ডাকঘর-ঘোড়ামারা, উপজেলা-বোয়ালিয়া, জেলা-রাজশাহী
জন্মঃ ১৯২৯
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৫, সেতাবগঞ্জ এইচই স্কুল, দিনাজপুর
আইএসসি
এমবিবিএসঃ ১৯৬১, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
শখঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা
সমাজসেবাঃ সান্তাহার মসজিদ কমিটির সভাপতি থাকা অবস্থায় মসজিদ ও কবরস্থান, সংস্কারসহ অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত। দুস্থ পরিবারে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা
ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ
চাকরির বর্ণনাঃ সরকারি চাকরি, পাকিস্তান রেলওয়ে হাসপাতালের সহকারী সার্জন, সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতাল, নওগাঁ
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ২০ নভেম্বর ১৯৭১
মরদেহঃ পাওয়া যায়নি
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধ : সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম রেলওয়ে ভবন, বিএমএ, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২০০০ টাকা ও আবাসন ব্যবস্থা
স্ত্রীর নামঃ বেগম দিলরাস বানু
বিয়েঃ ২৪ অক্টোবর ১৯৬৩
সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও দুই কন্যা
মো. মেসবাউল আলমঃ স্নাতক, গ্যালাক্সি গ্রুপ, ২৫ গুলশান এভিনিউ, ঢাকা-১২১২
রহমত আরা জেসমিনঃ স্নাতক, গৃহিণী
জান্নাতুল ফেরদৌসঃ স্নাতক, গৃহিণী
তথ্য প্রদানকীরী
বেগম দিলরাস বানু
শহীদ চিকিৎসকের স্ত্রী
৬/২৪(উত্তরাংশ), হুমায়ুন রোড, ব্লক
বি, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
৮০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার স্বামী
শহীদ ডা. আবু বারেক মোহাম্মদ নূরুল আলম
বেগম দিলরাস বানু।
১৯৭১-এর মার্চ মাসের প্রথমার্ধ। ডা। এ বি এম নূরুল আলম তখন বগুড়া জেলার আদমদীঘি থানার সান্তাহারা রেলওয়ে হাসপাতালের সহকারী সার্জন। আন্দোলনে তিনিও মনেপ্ৰাণে সোচ্চার ছিলেন। সেই সময় নওগাঁ থেকে প্রতিদিন ছোট-বড় মিছিল সাস্তাহারে আসতো। একদিন লোকোসেডে অবাঙালিরা মিছিলের ওপর বোমা মারে; এতে অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার সাহেব তাদের আন্তরিকভাবে সুচিকিৎসা করেন এতে অবাঙালিরা ভাক্তার সাহেবের ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
একটা বাঙালি ছেলে একজন অবাঙালি কর্মকর্তার বাসায় কাজ করতো। সেই অবাঙালি কর্মকর্তা এমন এক জায়গায় বোমা রেখেছিল যেখানে কাজ করতে গিয়ে ছেলেটি বোমায় গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার সাহেব তার সুচিকিৎসা করেন এবং তাকে জরুরি ভিত্তিতে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে পাঠান। এভাবে ডাক্তার বাঙালিদের সেবা দিতে থাকেন। অবাঙালিরা আরো হিংস্র হয়ে ওঠে; বাঙালিদের মারতে শুরু করে; বহু বাড়িঘরে পেট্রোল দিয়ে আগুন দিতে থাকে। হাসপাতালেও আগুন দিতে আসে এবং বলে, ‘ডাক্তারের বন্দুক-রাইফেল আছে; থাক এখন আগুন দিব না। দেখি পরে কী করা যায়?’ এভাবে মাঝে মধ্যেই তারা হাসপাতাল আক্রমণ করতে আসে, আবার ফিরে যায়। হাসপাতালে কর্মচারী ও রোগীসহ প্রায় ৬০-৭০ জন ছিল। ডাক্তার তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি থাকতে আপনাদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না।’
২৫ মার্চ। ভয়াবহ কালরাত্রি। সান্তাহারের অবাঙালিরা হত্যালীলায় মেতে ওঠে। সে রাতে ডাক্তার হাসপাতালে কর্মচারী ও রোগীদের সাথে ছিলেন। খাওয়া ও নামাজের জন্য রাত ১২টার সময় বাসায় আসেন। এমন সময় এক কর্মচারী এসে খবর দেন নওগাঁ থেকে পুলিশসহ আরো কর্মকর্তার হাসপাতালে এসেছেন; ডাক্তার সাহেবকে ডাকছেন। তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করে জানান যে হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের প্রয়োজন। তখন তারা চারজন পুলিশ রাতে পাহারার জন্য নিয়োজিত করে। তারা ডাক্তারের বন্দুকও(লাইসেন্সকৃত)
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৮১
শহীদ ডা. আবু ব্যারেক মোহাম্মদ নূরুল আলম
চেক করেন। কর্মকর্তারা নওগাঁ চলে যান। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে অবাঙালিদের ধ্বংসলীলাও বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, পুলিশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পেরে ভয়ে পালিয়ে চলে যায়। কিন্তু ডাক্তার তখনও হাসপাতালে তার কর্তব্যে অবিচল।
আগের রাতের ভয়াবহতার রেশ পরদিন ২৬ মার্চের সকালেও কাটল না। অবাঙালিদের যুদ্ধংদেহী প্রস্তুতি দেখে বাঙালিরা যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকে। এমন সময় তার এক সহকর্মী ডাক্তার এসে খবর দিলেন যে তিনি সপরিবারে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আরও বললেন, ‘আপনি খুব সাবধানে থাকবেন, বিহারিরা আপনার ওপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। যে কোনো মুহুর্তে হামলা করতে পারে।’
এমতাবস্থায় ডাক্তার সাহেব তাঁর পরিবারবর্গ, সহকর্মী এবং রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে অবস্থান নেন। এই সময় বাইরে মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। আমরা হাসপাতালের কক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। ৬০-৭০ জন নারী, শিশু ও পুরুষ মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। কারো মুখে আর কোনো কথা নেই শুধু আল্লাহ, আল্লাহ…। মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে যেমন হয় ঠিক তেমনই অনুভব। এখনও মনে হলে ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে। এভাবে বিকেল পর্যন্ত বন্দিদশায়। বিকেল ৪-৫টার সময় একদল যুবক এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। আমরা হাসপাতালের কক্ষে চুপ করে বসে আছি; ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত কোনো শব্দ করছে না ভয়ে। এদিকে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে, ‘কে আছেন? দরজা খুলুন।’ কেউই দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না। তখন আমি একজন কর্মচারীকে দরজা খুলতে বললাম। দরজা খোলা মাত্র যুবক দল আমাদের সামনে এসে বললো, ‘আপনারা বাঙালি! এত বাঙালি কীভাবে বেঁচে আছেন! ডাক্তার সাহেব কোথায়? তাঁর জন্য আজ আপনারা বেঁচে গেছেন। আপনারা মালসন গ্রামের দিকে চলে যান।’ আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো; অবশ হয়ে যাওয়া শরীরে সম্বিৎ ফিরে এলো। ওরা আর কেউ না-গ্রামের সহজ-সরল যুবক। ওরা রানীনগর থানা থেকে অস্ত্ৰ নিয়ে সান্তাহারে আসে; অবাঙালিদের সাথে যুদ্ধ করে সান্তাহারে প্রবেশ করে এবং জীবন বাজি রেখে হাসপাতালে প্রবেশ করে। অনেকে নিহত ও আহত হয়। পরে ডাক্তার তাদের চিকিৎসা দেন।
ঐ রাতে আমরা মালসন গ্রামে রাত কাটাই। পরদিন ২৭ মার্চ নওগাঁ থেকে ডা. বারী আমাদের খোঁজে মালসন গ্রামে আসেন এবং নওগাঁয় তার বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতে চাইলেন। ডাক্তার সাহেব বলেন, ‘আমাদের যেতে হলে গাড়ি দরকার।’ কারণ আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। এ অবস্থায় চলাফেরা করায় খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তাই তিনি তার বন্ধু ডা. লুৎফর রহমানকে তার জিপগাড়ি পাঠানোর জন্য অনুরোধ করে একটা চিঠি দিলেন।
২৮ মার্চ ডা. বারী নওগাঁ থেকে সে জিপগাড়ি নিয়ে এসে আমাদের তার বাড়ি নওগাঁয় নিয়ে এলেন। সেখানে আমরা ১৫-২০ দিন ডা. বারীর বাড়িতে অবস্থান করি। পরে খবর আসে। পাক আর্মি আসছে। এই খবর পেয়ে নওগাঁর জনগণ আরো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। আমরাও দুবলহাটি রাজবাড়ী নামে পাশের এক গ্রামে যাই। এখানেও আমরা কয়েকদিন থাকার পর জানতে পারি দুবলহাটি রাজবাড়ীতে আর্মি ক্যাম্প হবে। একথা শুনে বিল অঞ্চলের হাইসাগাড়ী নামে এক গ্রামে আশ্রয় নিই। সেখানে থাকা অবস্থায় আমার ছোট মেয়ে জন্ম লাভ করে । এই হাইসাগাড়ী গ্রামে থেকেও গ্রামবাসী, আহত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর চিকিৎসা করতেন ওর বাবা।
ডা. রাব্বির পাঠানো খবরে জানতে পারি যে, অবাঙালিরা ডাক্তার সাহেবের নাম থানায় থানায় তালিকাভুক্ত করেছে, যেখানেই তাঁকে পাবে, সেখানেই তারা তাঁকে ধরবে। এ খবরে আমরা দিশেহারা হয়ে যাই । কোনো কুলকিনারা করে উঠতে পারছিলাম না। ডাক্তার সাহেব ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওখানকার লোকজন বললেন, ‘আপনি যেতে পারবেন না; থানায় থানায় আপনার নাম আছে। আপনি বিপদে পড়বেন। আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছেন, তাই আপনার বিপদ।’ তারা সাবধানে থাকার পরামর্শ দেন। গ্রামবাসীর অনুরোধে আমরা জুলাইয়ের শেষ দিকে আমার বাবার বাড়ি রাজশাহীর উদ্দেশে নদীপথে রওনা হই। আমরা নদীতে তিন দিন ছিলাম। রাজশাহীতে পৌঁছে দেখি বাড়িতে তেমন কেউ নেই। যারা আছেন তারা বললেন, ডাক্তারের নামে থানায় লিস্ট আছে; তাই টাউনে না থাকাই ভালো। তাই আমরা গ্রামের বাড়ি শাহবাজপুর চলে যাই এবং সেখানেই থাকতে থাকি। কিন্তু দেশমাতৃকার চরম দুঃসময়ের কথা ভেবে
৮২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকাষ
শহীদ ডা. আবু ব্যারেক মোহাম্মদ নূরুল আলম
ডাক্তার সাহেবের মান ছটফট করছিল। স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। তাঁর নিজের পরিবার না হয় এখানে নিরাপদেই আছে। কিন্তু তিনি নিজে তো দেশের জন্য কিছু করতে পারছেন না। অস্থিরচিত্তে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করতে থাকেন। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন এক লোক তাঁকে বললেন, ‘আপনি যদি যেতে চান ব্যবস্থা করে দেব; আপনি ডাক্তার; কিছু ওষুধপত্র আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন, পার করে দেব।’ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা, দেশের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি রাজশাহী শহরে গেলেন। সেখানে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনলেন। এমন সময় এক পুলিশ এসে বললো, ‘আপনি ডাক্তার! আপনাকে থানায় যেতে হবে।’ তিনি থানায় গেলেন। তাঁকে বলা হলো যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ আছে। তারা তাঁকে আটকে রাখলেন। ক’দিন পর তাঁকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে স্থানান্তর করা হয়। এ তথ্য আমরা জানতে পারি আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী কামরুজ্জামানের(৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেলহত্যার শিকার) পিতা হামিদ মিয়ার কাছ থেকে। তিনি সম্পর্কে দাদা হন। দাদা জোহা হলে যে কক্ষে বন্দি ছিলেন, ডাক্তার সাহেবকেও একই কক্ষে রাখা হয়েছিল।
প্রতি রাতেই দখলদার পাক আর্মির ঐ কক্ষ থেকে কাউকে না কাউকে ডেকে নিয়ে যেত। সেই যে তারা যেত আর ফিরত না। ২০ নভেম্বর রাত ১২টার পর ঐ কক্ষ থেকে ডাক্তার সাহেবের নাম ধরে ডাক পড়ে। তখন তিনি দাদার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকেন; আল্লাহর নাম নিতে থাকেন। দাদা তাঁকে সাত্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না। যাওয়ার মুহুর্তে দাদার কাছে তাঁর হাতঘড়ি, কলম, মানিব্যাগ দিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘দাদা আমি যাচ্ছি… আমার জন্য দোয়া করবেন…আমার জিনিসগুলো বাসায় পৌঁছে দেবেন।’
দেশ স্বাধীন হবে এমন আশা জানিয়ে চলে গেলেন।
অবাঙালিদের অত্যাচারে আমরা যখন সন্তাহার হাসপাতাল থেকে চলে আসছি তখন একজন কর্মচারী
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৮৩
শহীদ ডা. আবু বারেক মোহাম্মাদ নূরুল আলম
ডাক্তার সাহেবকে বলেছিল, ‘স্যার, আমরা কবে কাজে যোগদান করবো?’ তিনি বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা সবাই আবার কাজে যোগদান করবো।’ দেশ স্বাধীন হলো; সবাই কাজে যোগদান করলেন। ডাক্তার আর ফিরে এলেন না, আর কাজে যোগ দিতে পারলেন না। আমরা সংবাদপত্রে তার নিখোঁজে সংবাদ ছাপিয়ে ছিলাম। ৩৭ বছর কাটলো। কোনোই সংবাদ আজ পর্যন্ত পেলাম না।
১৯৫২ সালে ডা. এ বি এম নূরুল আলম ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের লাঠিচার্জ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পুলিশের লাঠির আঘাত তাঁর শরীরেও পড়ে ছিল। ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রাবাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হলে তিনি ছাত্রীদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
সংস্কৃতিমনা ছিলেন। মেডিকেল কলেজে নাটকে-অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। মানুষের সেবা মনপ্রাণ দিয়ে করতেন। অনেক গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন; অপারেশন করতেন। সমাজের উন্নতির কাজে তাঁর ছিল খুব আগ্ৰহ।
তিনি নেই-একথা ভাবতে আমার মনে কী যে ব্যথা লাগে তা ভাষায় বোঝানো যাবে না! স্বামী হারিয়ে ৩৭ বছর তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কী দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটালাম তা লিখে শেষ করা যাবে না। দেশ একজন চিকিৎসককে হারালো। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারালো। একজন বুদ্ধিমানকে হারালো। আর একটি পরিবারের মধ্যে ছেলেমেয়ের হারালো তাদের বাবাকে, স্ত্রী হারালো তার স্বামীকে… কী যে দুঃখ!
একটা মানুষ দেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন; তার মূল্য হিসেবে পেয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণঢালা ভালোবাসা, সংগ্রামী অভিনন্দন আর ২০০০ টাকার একটা চেক। তারপর আর কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
ঘ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪, ৯, ৩৫, ৩৯।
৮৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. আবু বিজরিস মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
নিহত নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ২২নং ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাকিম হাউস, ঢাকা
জন্মঃ ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৭ গ্রাম-চরভাগা, ডাকঘর/উপজেলা-সখিপুর, জেলা-শরীয়তপুর
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৬২, প্রথম বিভাগ, মতলব হাই স্কুল, কুমিল্লা
আইএসসিঃ ১৯৬৪, প্রথম বিভাগ, নটরডেম কলেজ, ঢাকা
এমবিবিএসঃ ১৯৭১. মেধা তালিকায় স্থান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
শখঃ শিকার, খেলাধুলা (ক্রিকেট খেলার সূত্রে পাকিস্তান সফর), সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাঃ তবলা, ব্যাঞ্জো, গিটার বাদন, অভিনয়
সমাজসেবাঃ স্কাউটিং
ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ ন্যাপের (ভাসানী) ছাত্র সংগঠন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস
চাকরির বর্ণনাঃ ইন্টার্নশিপ শুরুর প্রথম দিনেই নিহত
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ
নামঃ ডা. এহসানুল করিম; ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সংগঠনের নামঃ ইসলামী ছাত্র সংঘ
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ নটরডেম কলেজের কালভার্টের নিচের ড্রেনে
প্রাপ্তি তারিখঃ ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১
সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ ডা. কামরুজ্জামান
কবরস্থানঃ আজিমপুর কবরস্থান
স্মৃতিফলক স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ২৫০০ টাকা
বৈবাহিক অবস্থাঃ অবিবাহিত
তথ্য প্রদানকারী
মোমরাজ বেগম
শহীদ চিকিৎসকের বোন
৮১/বি (৩য় তলা), কাকরাইল
ঢাকা-১০০০
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৮৬
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ