৪ ভাদ্র, ১৯৭৮ শনিবার, ২১ আগষ্ট ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আজ প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রশাসনিক নির্দেশ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে বলা হয় যে, নীতি নির্ধারন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ে এককভাবে নিতে পারবে না। এজন্যে প্রধানমন্ত্রী বা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ( ৩খঃ পৃঃ ৯৩)
বাংলাদেশ সরকারের সাধারণ প্রশাসন বিভাগের অন্য এক নির্দেশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার সনৎকুমার সাহাকে সরকারের পরিকল্পনা সেলের অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিয়োগ দান করাক হয়। (৩ খঃ পৃঃ ৯৩)
এ দিন ইরাকের বাগদাদের পাকিস্তানী দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এ. এফ. এম. আবদুল ফাতেহ স্বপক্ষ ত্যাগ করেন। (সংবাদপত্র) উল্লেখ এ সময়ের মধ্যে যে ২০ জন বাঙ্গালী কূটনীতিক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন তাদের মধ্যে মিঃ ফতেহ সবচেয়ে উচ্চপদস্থ অফিসার। তার লন্ডন আগমনের সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ইরাক থেকে গোপনে লন্ডনে চলে এসেছিলেন। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার জন্য। পরবর্তীতে বিচারপতি চৌধুরী এক তার বার্তায় মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারকে মিঃ ফতেহর আনুগত্যের সংবাদ জানান।
বাংলাদেশের গনহত্তায় পাকিস্তানকে সহায়তা না করার জন্নে মার্কিন সরকরের প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি এদিন এক আবেদন জানায়। সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ. কে. র্য স্বাক্ষরিত এই পত্রে পাকিস্তানকে আর্থ-সামরিক সাহায্য বন্ধ ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের জন্যে চাপ প্রয়োগ এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের অনুরোধ জানানো হয়।
পাকিস্তানী শাসক ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের বিচার করবে এই খবরের প্রেক্ষিতে এ দিন জাতীয় সংসদ সদস্য বদরুন্নেসা আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণে বলেনঃ শেখ মুজিব আজ আর কোন ব্যাক্তি বিশেষের নাম নয়-শেখ মুজিব আজ বাংলার ইতিহাস। শোষণ ও পীড়নের রাজনীতিতে সেখ মুজিব এক আশ্চর্য প্রতিবাদ। তিনি তার পর্বত প্রমান অটল সাহস ও মনোবল নিয়ে সবকিছু বাঁধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে এককভাবে বাংলার ইতিহাসে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মতো ম্মহান নেতার কোন ক্ষতি আমরা সহ্য করব না।
দুই নম্বরের সেক্টরের মুক্তিবাহিনী গাজীপুর রেলসেতুর কাছে এক অ্যামবুশ পেতে পাকিস্তানী বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্টসহ ছ’জন সেনাকে খতম করে।
কানাডার টরেন্টোতে ১৯ থেকে ২১ আগষ্ট পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয় সম্মেলনে আগত ৯ জন প্রভাশালী মার্কিন নাগরিক একটা যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এই বিবৃতিতে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য মার্কিন সরকারের তীব্র নিন্দা করা হয়।
বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধের খবরঃ
* ঢাকা–কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টরের কানাশাতায় আজ আবার হামলা করেও মুক্তিবাহিনী, এতে ১ জন অফিসারসহ মৃত পাকিস্তানী সেনাসংখ্যা ১৫। নোয়াখালীর খেয়ার বাজার এবং লক্ষ্মীপুর
৩৭১
থেকে আজ পাকিস্তানী বাহিনীকে হটিয়ে দেয়া হয়। সেনাগাজিতে ২০ শত্রুসেনা, মৃধার বাজারে ৭, ৪ জন খান সেনা নিহত হয়।
উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীপুরে ১২ জন বীর সৈনিকের সমাধি ক্ষেত্র রয়েছে। এ সমাধিস্থলে সমাধিস্থ আছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অমর শহীদ লেঃ আজিজুল হক, সুবেদার আবুল হোসেন, হাবিলদার আব্দুল হালিম, হাবিলদার আবুল কাশেম, নায়েক আবুল হোসেন, ল্যান্স নায়েক নূরুল হক, সিপাহী আবেদ আলী, সিপাহী এনামুল হক, সিপাহী আবুল কাশেম, সিপাহী বুরহানউদ্দিন, সিপাহী রফিকুল ইসলাম ও সিপাহী আব্দুর রাজ্জাক। স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের নির্দেশে সাবসেক্টর কমান্ডার আইনউদ্দিন, গ্রুপ কমান্ডার নাজির হোসেনের নেতৃত্বে লতুয়ামুড়া, চন্ডিদ্বার, কসবা সদর ইত্যাদি অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করা হতো। (লেখক)।
* তাতার এলাকায় ১০ জন শত্রুসেনা হতো, অমলসিকে ৪ জন, চাঁদপুরে নদীপথে একটি খাদ্য বোঝাই লঞ্চ আটক করে মুক্তি বাহিনী। এই লঞ্চে ১২৫ টন খাদ্য এবং ৯ জন পাকসেনা ছিল। কামালপুর-বক্সিগঞ্জে টেলিফোন লাইনের অনেকটা তার তুলে ফেলা হয়। বড়লেখায় নিহত হয় ৩ রাজাকার। ব্রাহ্মণবাজারের ২০০ গজ টেলিফোন তার কেটে দেয়া হয়। টাঙ্গাইলে মারা যায় ২ জন শত্রু সেনা।
এ দিন টিক্কা খান সিদ্ধান্ত নেন আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনিতে পরিণত করার। রাজাকার অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের আনসার এ্যাক্ট বাতিল করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর এ্যাডজুট্যান্টদর পরিণত করা হয় রাজাকার এ্যাডজুট্যান্টে। ২১ আগষ্ট রাজাকার অর্ডিন্যান্সের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীকে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদেরকে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, অর্ডিন্যান্সের বিধান মতে প্রাদেশিক সরকার সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সকল রাজাকার অথবা নির্দিষ্টসংখ্যক রাজাকারকে প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীর অন্তভূক্তির আদেশ দিতে পারে। (সংগ্রাম)
সিলেটের বালাগঞ্জ থানায় ৩৫০ জন রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে বলে ঘোষণা করা হয় এদিন। এর আগেও ১৫০ জন রাজাকার সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছে। উল্লেখ্য থানা কমান্ডার আবদুল মোমিন চৌধুরীর নেতৃত্ব ১০ মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেফতার করে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ৫ জনকে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রী কমিটির এ দিনের বৈঠকে মাওলানা আবদুর রহিম জানান, হানাদার বাহিনীর তৎপরতা যথেষ্ট নয় তিনি বাঙালীদের ওপর ৬০ এবং ৭২ নং সামরিক বিধিকে আরো নির্মমভাবে প্রয়োগের সুপারিশ করেন। (আজাদ)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী