৩১ শ্রাবণ, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ১৭ আগষ্ট ১৯৭১
-আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে নৌ-পথে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জোরদার হয়। অবশ্য, ভারতীয় নৌবাহিনীর সাহায্য সহযোগিতা বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। অপারেশন জ্যাকপটে সফল হবার পর আজ নৌ-কমান্ডোর চাঁদপুরে মাইনের সাহায্য বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিপুল ক্ষতিসাধন করে। মোঃ বদিউল আলম এ অপারেশন নেতৃত্ব দেন।
-দেশ মাতৃকার প্রতি প্রবল প্রেমের পরিচয় দিয়েছেন আজকের দিনে সারদা পুলিশ একাডেমী অপারেশনের নেতা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবলী। তার ৬ জনের দল একাডেমীতে আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন দস্যু সেনা খতম করেন। পাকিস্তানী বাহিনী শিবলীকে হত্যা করে নির্মম, পৈচাশিক অত্যাচার করে। তবুও মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে কোনো তথ্য সে দেয়নি।
এ দিন কাদেরিয়া বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ টাঙ্গাইল জেলার সদর থানার ভাতকুড়ানগর জলপাই গ্রামে পাক-সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে আহত হয়ে ধরা পড়েন। সহযোদ্ধা বাকু শহীদ হন। উল্লেখ্য, ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান। কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ টাঙ্গাঈল জেলার বিভিন্ন সময়ে সম্মুহ যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকার জন্য ‘বীর বিক্রম” উপাধিতে ভূষিত।
-বিবিসে আজকের দিনের মুক্তিবাহিনীর নৌ অভিযানের কথা প্রচার করে।
-আন্তর্জাতিক জুরি কমিশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে তারবার্তা পাঠায় ৭১ –এর ১৭ আগষ্ট। কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল ম্যাকডারমেট স্বাক্ষরিত বার্তায় বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের জন্যে সমগ্র বিশ্ব শঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতন, ত্রাস, দুঃখকষ্ট যাতে বৃদ্ধি না পায় তার জন্যে প্রেসিডেন্টেকে নমনীয় হবার অনুরোধ জানিয়েছেন। (বিডি-২ পৃঃ৩০)
-মার্কিন আন্তঃ এজেন্সীর পাকিস্তানী শরণার্থী বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ফ্রাঙ্ক এ. কলেগ এদিন এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এতেত শরণার্থীদের মানবেতর দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়। সাহায্যকারী সংস্থা চার্চ ওয়ার্ন্ড সার্ভিস ২.৫ মিলিয়ন ডলারের নগত অর্থ সাহায্য, ১৮০০০ শরণার্থীদের বাসস্থানের জন্যে ৪৮০০০০০ ডলার ও খাদ্য সাহায্য দেবে কেয়ার। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি বলে তারা মেডিকেল টীম পাঠাচ্ছে। মেডিক্যাল মিশন সিসটার ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিবিরে চিকিৎসা কার্যক্রমন চালাচ্ছে। এছাড়া ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসেস, ম্যানোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি, লুদার্ন ওয়ার্ল্ড রিলিফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন রিলির অর্গানাইজেশন বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দিচ্ছে বলে জানানো হয়। (বিডি-১)
এ সময়ে সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙালী ও উপজাতির সংখ্যা মিলে জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৬ লক্ষ। সে ক্ষেত্রে এই রাজ্যে শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩.৪২ লাখ। এপ্রিল মাসে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা সহায়ক কমিটি। ত্রিপুরা অঞ্চলের যুব অভ্যর্থনা শিবিরগুলোর দায়িত্ব আওয়ামী লীগের এম এন এ/এম পিএ’র মধ্যে বন্টন করা হয়। যেমন বেলুনিয়ার দায়িত্ব ছিলেন শহিদউদ্দিন ইস্কান্দার এমপি এ, বেলতলীতে শ্রমিক নেতা আব্দুর রহমান, ছোট খোলার ছাত্রলীগ নেতা সিরাজউদ্দিন আব্দুল কুদ্দুস, রাজনগরে খাজা আহমদ এম এন এ ও তালেব আলী এমপিএ, পানাতোলায় বিসমিল্লাহ মিয়া ও মোহাম্মদ হানিফ এমপিএ, কাঁঠালিয়ায় জালালাউদ্দিন এমপিএ, শ্রীনগরে ক্যাপ্টেন (অবঃ) সুজাত আলী এনে, খেলাঘরে রাজা মিয়া এমপিএ ও এ হাকিম এমপিএ, হরিণায় প্রফেসর খোরশেদ আলম এমএনে, নরসিংদির এ হান্নান এমএনএ, এসও মান্নান এমপিএ ও খয়ের উদ্দিন এমপিএ, মোহনপুরে দেওয়ান আব্দুল আব্বাস এমপিএ ও গোকুলনগরে সফিরুদ্দিন এমপিএ। ত্রিপুরার মাটিতে পাকিস্তানী সেনাদের বেপারোয়া গোলাবর্ষণ এপ্রিল মাস থেকে প্রায় প্রতিদিন অব্যাহত থাকে।
সে কারণে আগরতলায় ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল অনেক। ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলে শ্রী মধুসূধন গুহ রায় (পিটিআই), সনৎ মুখার্জী (আকাশবাণী) অনিথ ভট্টচার্য (যুগান্তর) অমূল্য গাঙ্গুলী (ষ্টেটসম্যান), সত্যব্রত চক্রবর্তী, মনোচিৎ মিত্র, অসীমদেব রায় (আনন্দবাজার) তুষার পন্ডিত সুভাস চক্রবর্তী, কীরিট ভৌমিক, কেকে চাড্ডা (ইউএনআই)। এছাড়া আগরতলা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক সংবাদ’ ও সাপ্তাহিক সমাচার’ তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় দ’জন সাহসী ভারতীয় সাংবাদিক সুরঞ্জিৎ ঘোষাল (আনন্দবাজার) ও দীপক ব্যানার্জী (অমৃতবাজার) পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকসেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ত্রিপুরার উপর পাকবাহিনীর চাপ অব্যাহত রেখেছিল কৌশলগত কারণেই। পূর্বাঞ্চলে সেক্টরগুলো থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা দল ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাক্ষনবাড়িয়া, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ,চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকায় অপারেশন’ চালায়। তাছাড়া, আগরতলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। এখানেই এপ্রিল মাসে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সার্কিত হাউসে বসেই বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। শত শত আওয়ামী লীগ সাংসদ ও কর্মী এখানেই নীরেন ভট্টাচার্যের ঐতিহাসিক বাড়ি, পুরনো এম এন এ হোষ্টেল, শ্রীধর ভিলা, সুনন্দা ভট্টাচার্যের সরকারী আবাসন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ এবং ডাঃ মুজিত দেব রবীন্দ্র পল্লীর সরকারী আবাসনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সর্বজনাব খোন্দাকার মোশতাক আহমেদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আলহাজ জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, আব্দুল মালেক উকিল, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। এসেছিলেন ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মনি , আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, স্বপন চৌধুরী ও নূরে আলম সিদ্দিকী।
এসেছিলেন ঢাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীগণ, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহমদ, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, মমতাজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ। আর রয়েছে স্বাধীনতা বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিপ্লবী কর্মীবৃন্দ। এসেছিলেন বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি চেয়ারম্যান শ্রী মনি সিংহ, শ্রীমতি অনিমা সিংহ। কমরেড ফরহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, বিপ্লবী অনলবর্ষা বাগ্মী নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বজলুর রহমান (ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সংবাদ)। মোশাররফ হোসেন, পুলিনদঃ আবদুল্লাহ আল হারুন, মীর্জা আব মনসুর, শেখ ফজলুল করিম সেলিম শ্রমিক নেতা আবুল বাশার, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর আহমেদ, সিরাজুল হোসেন খান, মার্শাল সিরাজ, হায়দার আকবর খান রনো, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মান্নান ভূইয়া, ডাঃ ফরিদ হুদা, কামাল লোহানীসহ আরো অনেকে। আগরতলায় সমবেতহয়েছিলেন কর্ণেল (অবঃ) এমএজি ওসমানী (প্রধান সেনাপতি), কর্ণেল আব্দুর রব, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খোন্দকার, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর শফিউল্ল্যা, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর নূরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন ভূইয়া, ক্যাপ্টেন আমি আহমেদ চোধুরী। এক কথা, আগরতলা তখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী।
শ্রীলংকায় বাংলাদেশ সংহতি কমিটি পাক সরকারের কাছে প্রতিবাদলিপি পেশ করে। আন্তর্জাতিক বিচার আইন ও মানবিক আবেদন উপেক্ষা করে বাংলাদেশের জনগণের ওপর বর্বর নির্যাতন ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধ করে অবিলম্বে নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলা হয়। (সংবাদপত্র)
পাক সামরিক সরকার এদিন ১৬ জন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে নির্দেশ দেন সামরিক কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির হওয়ার। অভিযুক্তরা হলেন সর্বজনাবঃ আতোয়ার রহমান তালুকদার মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ, খালিদ আলী মিয়া, শাহ মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নাটোরের ২ নং সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হতে। এ ছাড়া ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান আক্কাস, আবু আহমদ আবজালুর রশীদ, কামরুজ্জামান, ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম, সুবোধ মিত্র খোন্দকার আবদুল আজিজ, সোহরাব হোসেন, এম, রওশন আলী, মোহাম্মদ মোহসীন, শফিউদ্দীনকে যশোর ৩ নং সেক্টরের উপ-সামরিক প্রশাসকের সামনে হাজি হতে নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যাথায় অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হবে। উল্লেখ্য, এই সাংসদগণ নওগাঁ, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী