২৮ শ্রাবণ, ১৩৭৮ শনিবার, ১৪ আগষ্ট ১৯৭১
এদিন শরণার্থী শিবিরগুলোতে বর্ষার জলে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ১৪ আগষ্ট ভয়াবহ আরো কিছু ঘটবে এই আশাংকায় ফরিদপুর এলাকার বহু শরণার্থী বনগাঁয় এসে পৌছায়। প্রতিদিন অঝরে বৃষ্টী হচ্ছিল। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরায় প্রাদুভার্ব ঘটে। মাগুড়া থেকে নির্বাচিত এমপি এ সৈয়দ আতর আলী কল্যাণীতে কলেরায় মারা যান। তাঁকে বাংলাদেশে সমাধিস্থ করা হয়। উল্লেখ্য, প্রত্যেক শরণার্থী শিবিরে ত্রান কার্য জোরদার করা হয়। এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে, কালী বিশ্বনাথ সেবা সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, বাংলাদেশ ভলেন্টার সার্ভিসেস, শ্যালভেশন আর্মি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী ডাক্তার নিয়ে গড়ে তোলা হয় চিকিৎসকদল। এ বিষয়ে ডাঃবদরুদ্দোজা চৌধুরী, ডাঃ টি হোসেন, ডাঃ আহমেদ আলী যথেষ্ট ভূমিকা বিশেশভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, ভারতের প্রাক্তন প্রধামন্ত্রী গুলজারী লাল নন্দা ও এম কে ভিমানীর বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি হরিয়ানা শাখার সক্রিয় সাহায্যের শিলং, তুরা, কল্যাণী, আগরতলায় যুদ্ধাহত মুক্তযোদ্ধাদের জন্য ৩০০ বেডের চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। (লেখক)
পাকিস্তানী আযাদী দিবস উপলক্ষে প্রতিটি সেক্টর গেরিলা আক্রমণের তীব্রতা তাই আজ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরিকল্পিত আক্রমণের বাইরেও অনেক হামলা হয়। শুধুমাত্র ১ নম্বর সেক্টরে ১০টির বেশি অপারেশন হয়েছিল পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী।
এ দিন পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানার গেরিলা দল নগরবাড়ি-পাবনা সড়কে পাক আর্মির ট্রাকের ওপর হামলা চালায়। অন্যত্র ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধারা দাশুড়িয়ার শান্তি কমিটির কুখ্যাত দালাল মওলানা আতাউর রহমান হত্যা করে। ২নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃরফিকুল ইসলাম, মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়ার মধ্যডাটের ব্রিজ ডাংগার সময়ে পাক সেনাদের সেলের টুকরায় আহত হন। তাঁর সাহসিকতার জন্য তিনি বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন।
-৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সংঘবদ্ধ আক্রমণ পরিলচালিত হয়েছে। ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধকে ৩টা দলে ভাগ করেন মেজর গিয়াস, আর কমান্ডার সুবেদার ইসমাইল, সুবেদার আমিরুজ্জামান, নায়েক সুবেদার আমানউল্লাহকে যথাক্রমে ৩ দলের অধিনায়ক চাঁপাইনবাবগঞ্জ টাউন হলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালে ৬ জনকে হত্যা ও ৭ জনকে আহত করে মুক্তিযোদ্ধারা। হরিপুর সেতুর ১২০ ফুট উড়িয়ে দেয়া হয়। বিচ্ছিন্ন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর মধ্যেকার একমাত্র সড়ক যোগাযোগ।
আগের দিন বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিসেনা, প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে ক্যাপ্টেন জিয়া ভারত থেকে আসেন। সুন্দরবন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধদের সম্মিলন হয়। ১০০০ জন মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে ভালোভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কতগুলো বিভাগ এবং উপবিভাগ খোলেন। (সংবাদপত্র)
শ্রীনগরের কাছে শুভপুরে এলএমজি, মেশিনগান, রকেট ল্যঞ্চারসহ পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে প্রচুর হতাহত করে। ছাগলনাইয়াতে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়, ফরিদপুরে ৯ জন, নোয়াখালীর বসুরহাটে ৩০ জন, কলারোয়াতে ২৫ জন, দালধরে ১ অফিসারসহ ২০ জন ছাতকের কাছে হেনাটিলা, কারবাললা জামাবাড়ি ৩ ট্রুপ, মুকুন্দপুরে ৪ ট্রুপ, চৌদ্দগ্রামে ৬ ট্রুপ উজ্জ্বলপুরে ১১ ট্রুপ, দাপুনিরে ১০ ট্রুপ, কামালপুরে ১৩ ঠাকুরগাঁ, কসবায় ৯, কালিগঞ্জে, রামগড়ে ৬, জমনিরহাট, চাঁদগাজি,বাগানবাজারে ৫, রংপুরে মডেল হাই স্কুলে ৭, ওমরাগাঁওয়ে ১০, মন্দভাগ, গোপালনগর ধুপ্টিলাতে ৩ পাকসেনা হত্যা ও বহু হতাহত হয়েছে। আফসার বাহিনী ভরাডুবাগ্রামে দালাল, রাজাকার, হত্যা ও রাইফেলসহ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। (স্বাঃ যুঃ দঃ)
১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস” উপলক্ষে এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজন করা হয় সিম্পোজিয়ামের। এতে সভাপতিত্ব করে পিডিপি নেতা নুরুল আমিন। বক্তব্য রাখেন জামায়াত নেতা গোলাম আযম, পশ্চিম পাকিস্তান পিডিপি’র সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, এ কি এম শফিকুল ইসলাম, আবদুল জাব্বার খদ্দর, পূর্ব পাকিস্তান পিডিপি’র সহ-সম্পাদক এ কে রফিকুল হোসেন প্রমুখ। বিকেলে শান্তি ও কল্যাণ পরিষদ পল্টন ময়দানে সভা করে মৌলভী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্ব। বক্তব্য রাখে পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল মওলানা নুরুজ্জামান, পাকিস্তান দরদী সংঘের প্রধান এটি সাদীম খাকসার নেতা হাফেজ মোহাম্মদ প্রমুখ। ফরীদ আহমদ সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ আমরা যে ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা দেখেছি তাঁর বীজ রোপন করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩ জুন। তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলন হলো ভারতের সুদূরপ্রবাসী ষড়যন্ত্রের পরিণতি।
জমিয়তে তালাবায়ে আরবিয়া আয়োজিত সভায় গোলাম আযম আজাদীর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘কখনও দেশ তার নিজের দেশের মানুষ দ্বারা শাসিত হলেই আজাদ হবে, আজাদীর এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
রাজশাহীতে শান্তি কমিটি আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডাঃ এম এ বারী, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আইনুদ্দিন, আফাজুদ্দিন প্রমুখ। অন্য এক সভায় বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলা বিভাগের ডীন ডঃ মকবুল হোসেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডাঃ ওবায়দুল হক, অর্থনীতি বিভাগের রশিদ খান, আইন বিভাগের ডঃ জিল্লুর রহমান, রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ শামসুদ্দিন মিয়া প্রমুখ।
ফরিদপুরে সভা ও মিছিল হয়, মওলানা মোবারক আলী, অধ্যাপক মহিউদ্দিন, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে। চট্টগ্রামে বক্তব্য রাখেন জেলা শান্তি কমিটির আহবায়ক ও প্রাক্তনমন্ত্রী মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, এস এ মান্নান, অধ্যক্ষ কাজী নাসিরউদ্দিন, এ এ করিম চৌধুরী, শাহ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ও প্রফেসর শামসুল হক এমপিএ। ময়মনসিংহ সভা হয় আলবদর বাহিনীড় প্রধান সংগঠক কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে। (সংগ্রাম/দৈঃপাঃ)
এ দিন পাকসেনারা আগরতাল থেকে ৮ মাইল দূরে বামুটিয়া জলিলপুর শরণার্থী শিবির ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৩ জনকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ৪ তরুণীকে ধরে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, রাজ্য সরকার এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের জানা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দাবী জানান।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী