চট্টগ্রামে, কক্সবাজারে নাজেহাল খান সেনার বােমা ও গােলাবর্ষণ
নয়াদিল্লি, ৪ আগস্ট-পশ্চিম পাক-সেনারা মুক্তিফৌজের কাছে প্রবল বাধা পাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কয়েকদিন আগে পাক বিমান থেকে বােমা এবং নৌবহর থেকে গােলাগুলি বর্ষণ করা হয়। তেহরানের দৈনিক পত্রিকা কয়হান ইনটারন্যাশনাল-এ ‘আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে ওই খবর ছাপা হয়েছে। ওই পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদদাতা শ্রী আমির তাহেরি ওই আওয়ামি লীগ সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই যুদ্ধ এখন প্রচণ্ড আকারে।
ওই সদস্যের নাম অবশ্য তিনি প্রকাশ করেননি। ইংরাজীতে ‘এম-এস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই খবরে আরও প্রকাশ, লেঃ জেঃ টিক্কা খা শ্ৰীতাহেরির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, ‘পূর্ব বাংলার আইন ও শৃঙ্খলার অবস্থা মােটেই স্বাভাবিক নয়।’ তিনি আরও বলেন, বাধা আসছে চারদিক থেকেই’ এবং অন্তর্ঘাতমুলক কাজও চলছে। পাটের গাড়ির উপর আক্রমণ প্রায়ই ঘটছে। ফলে বর্তমানে সেনাবাহিনীর পাহারায় চট্টগ্রামে পাট পাঠানাে হচ্ছে। . জেঃ টিক্কা ঢাকায় বােমাবর্ষণের কথাও স্বীকার করেছেন এ খবর ইউ এন আই-এর। শিলং থেকে ইউ এন আই-এর খবর ঃ পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী গত পাঁচ দিনে পাক-সেনাদের অবস্থা সঙ্গীন করে তুলেছে। মুক্তিফৌজ গেরিলাদের আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ বিপর্যস্ত এবং শ্রীহট্টে একটি মালবাহী বিমান ভেঙ্গে অচল হয়ে গিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে এক বিশ্বস্তসূত্রে এই খবর পাওয়া যায়।
ওই সূত্রে আরও জানা যায় যে, গেরিলারা শ্রীহট্টে সামরিক বিমানবন্দরে ঝােপে-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে সাড়ে ৮ কোটি টাকা দামের একটি বিমানের উপর গুলি চালায়। বিমানটি সেই মাত্র রানওয়ে থেকে বড়জোর দু’শাে গজ উঁচুতে উঠেছিল। গেরিলা বাহিনী ময়মনসিংহ জেলায় ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট সামনা-সামনি লড়াই চালিয়ে বহু পাকসেনাদের হতাহত করেন। ছাত্রনেতা সিদ্দিকের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী সমগ্র টাঙ্গাইল মহকুমা নিজেদের কজার মধ্যে নিয়ে এসেছেন।
ময়মনসিংহ ও কিশােরগঞ্জের মধ্যেও রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। তাঁরা বৈদ্যুতিক লাইন নষ্ট করে দেওয়ায় শ্রীহট্ট শহরের অর্ধেক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গেরিলা বাহিনী ৩১ জুলাই প্রথম কামালপুরে সামনা-সামনি লড়াই শুরু করেন। তাঁরা ৪০ জন পাকসেনাকে খতম ও আরও ২০ জনকে মারাত্মক ভাবে আহত করেন। ওই রাত্রেই গেরিলারা বাহাদুরাবাদঘাটে জোর আঘাত হানে এবং পাক-সেনা ভরতি একটি ট্রেনের বগি আক্রমণ করে বহু পাকসেনাকে নিহত করেন। তাদের আক্রমণে দুটি রেল ইনজিন, বেশ কয়েকটি ওয়াগন এবং যাত্রিবাহী কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই একই গেরিলা বাহিনী দু’দিন বাদে ২ আগস্ট দিওয়ানগঞ্জ শহর আক্রমণ করেন। যেখানে পাকসেনারা ছিল সেই রেল স্টেশনটি চুরমার করে দিয়ে তারা পালিয়ে যান। রাজাকারদের দুটি শিক্ষাকেন্দ্র তারা ধ্বংস করে দেন। ওই আক্রমণ চালাবার সময় মুক্তিবাহিনীর দুজন জওয়ান আহত হন বলে জানা যায়। গেরিলা বাহিনী ৩৮ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গেরিলাদের আক্রমণে সুনামগঞ্জে পাক-সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার পাকসেনাদের ভারপ্রাপ্ত ক্যাপটেন মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার করে ঢাকায় পাঠানাে হয়েছে।
নির্জলা মিথ্যা
মুজিবনগর, ৪ আগস্ট-বাংলাদেশের সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেন জেনারেল ইয়াহিয়া আজ বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে বিশ্বের চোখে ধূলাে দেওয়ার জন্য নির্জলা মিথ্যা প্রচার আরম্ভ করেছেন।তেহরানের দৈনিক পত্র কয়হান ইন্টার ন্যাশনালে সম্প্রতি পাক প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ বেরিয়েছে তার প্রতি মুখপাত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এই কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট এই বিবৃতিতে বলেছেন প্রধানত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভােটের জোরে মুজিবর রহমান নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
মুখপাত্র বলেন প্রেসিডেন্ট সুবিধাজনক ভাবে ভুলে গিয়েছেন আওয়ামী লীগ শতকরা ৮২টি ভােট পেয়েছে। তার মধ্যে হিন্দুদের ভােটের সংখ্যা শতকরা ১৫টির বেশি নয়। যদি তর্কের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়াও যায় আওয়ামী লীগ হিন্দুদের সমস্ত ভােটই পেয়েছে তাহলেও বাকি শতকরা ৬৭টি ভােট কোত্থেকে এল? তিনি বলেন বিস্ময়ের বিষয় এই যে ব্যক্তি নির্বাচন স্বাধীন ও ন্যায়সঙ্গত হয়েছে বলে গর্ব করেছেন তিনিই এখন পৃথিবীকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন আওয়ামী লীগ ভয় দেখিয়ে অসদুপায়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেছে।’ মুখপাত্র বলেন বাংলাদেশের পাক সেনা যে অবর্ণনীয় অত্যাচার করছে তা ঢাকবার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই অপপ্রচারে নেমেছেন।
Reference:
৫ আগস্ট ১৯৭১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা