আমার আব্বা
শহীদ ডা. আ খ ম গোলাম মোস্তফা
ডা. রোখসানা দিল আফরোজ কুহু
পয়লা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ায় আর ক্লাস হচ্ছিল না। তাই মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজের এম বি বি এস কন্ডেন্সড কোর্সের শেষ বর্ষের ছাত্র ডা. এ কে এম গোলাম মোস্তফা স্ত্রী-কন্যার কাছে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে লালখান বাজারের বাসায়। ৭ মার্চে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত ভাষণ রেডিওতে শুনে দারুণ উত্তেজিত তিনি। আগামী মে মাসে পরীক্ষা হয়ে গেলেই তার এম বি বি এস সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ‘দেশও স্বাধীন হয়ে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হবো প্রথম ব্যাচের ডাক্তার’-ব্যাকুল আশাবাদ ব্যক্ত করলেন স্ত্রীর কাছে। অত্যন্ত গুণী, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান। এরপর আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। সারা দেশের মানুষের মতো তিনিও বিভ্রান্ত, শোকার্ত ও ক্ষুব্ধ। ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ম্যাসাকার শুরু করলে আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি; ‘এবারে আর্মি নেমে গেছে শহরে, রোশেনা, আমরা বোধহয় বাঁচব না -স্ত্রীকে বললেন। ২৯ মার্চ রাতে পুলিশ লাইন দখল করে নিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রচুর বাঙালি পুলিশ শহীদ হন। এরপর পাকবাহিনীর নজর পড়ে লালখান বাজার এলাকার দিকে। তাদের কাছে খবর রয়েছে যে, লালখান বাজার এলাকার লোকজন বাঙালি পুলিশদের সহযোগিতা করেছিল। ৩০ মার্চ সকালবেলায় দেখা গেল আমাদের বাড়িতে এক ফোঁটাও পানি নেই; খাওয়ার পানির সঙ্কট। শোনা গেল একটু দূরেই হাইলেভেল রোডের মুখে ওয়াসা পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে। ওখানে গেলে যে কেউ পানি আনতে পারবে। ডা. গোলাম মোস্তফার মেজ ভায়রা (ব্যাংক অফ পাকিস্তানের চিফ অ্যাকাউন্টান্ট, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিকর্মী) কাজী আলী ইমাম সাহেব ভ্রাতুষ্পুত্র খোকন আর কাজের ছেলে রাজুকে সাথে নিয়ে পানি আনতে রওনা হলেন। এদিকে খবর এলো প্রতিবেশী রেলওয়ে অফিসার আর এন বাগচী সাহেব অসুস্থ। তাই ডাক্তার সাহেবকে একটু ডেকে পাঠিয়েছেন। রাস্তায় নেমেই ভায়রার সাথে দেখা হয়ে গেল। ডা. গোলাম মোস্তফার। তারা একসাথেই রওনা হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে একশ’ দেড়শ’ গজ এগোতেই হাতের বাঁ দিক থেকে ধোপা পুকুরের পাড় বেয়ে নেমে এলো পাক মিলিটারিরা। ডাক্তার সাহেব খোকন আর রাজুকে ইশারা করলেন পালিয়ে যেতে|
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৫৭
৫৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা
খোকন দোকানের পেছনে আর রাজু ড্রেনে লুকিয়ে পড়লো। কিন্তু বাকিরা পড়ে গেলেন পাকসেনাদের সামনে। পাকিস্তানিরা তাদের জিগ্যেস করলে, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ তাঁরা জানালেন, তাঁরা পানি আনতে যাচ্ছেন। তারা বলল, ‘ঠিক হ্যায়, যাইয়ে।’ কিন্তু পেছন ঘুরতেই পেছন থেকে দুটি গুলি কাজী আলী ইমাম সাহেবের দিকে ছুটে এলো। পিঠ দিয়ে ঢুকে সেগুলো বুক ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর ডাক্তার সাহেব? জানি না কী ছিল ঘটনার পর্যায়ক্রম। তাঁর বুকের ডান দিকে একটা গুলির চিহ্ন ছিল যেটা পিঠ ফুটো করে ঢুকে গিয়েছিল, বাইরে বেরোয়নি। গুলির প্রচণ্ড ধাক্কায় বোধহয় তিনি সজোরে আশপাশের ইটের ওপর পড়েছিলেন; তাই মাথাটা ফেটে গিয়েছিল। পেটের বাঁ দিকটা হায়েনারা বেয়নেট দিয়ে চিরে দিয়েছিল। চর্বি (ওমেনটাম) বেরিয়ে এসেছিল সেই কাটা দিয়ে। চিৎ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
খোকন বাসায় ফিরে এসে বহু প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল—‘আব্বুরা ওখানে পড়ে আছে।’ আলী ইমাম সাহেবের মা সালেমা খাতুনের পেছন পেছন বাড়ির মহিলারা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। ইতোমধ্যে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা আরো দু’চারজন পথচারী বেরিয়ে এসে তাদেরকে লাশ তুলে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। মাত্র ৯ দিন আগে যে বাড়িতে গৃহপ্ৰবেশের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সে বাড়ির বারান্দাতেই গৃহকর্তাদের চিরবিদায়ের জন্য শোয়ানো হলো। ঠিক তক্ষুনি আবার এসে হাজির হলো পাক হায়েনার দল। তারা বললো- ‘ফেক দো ড্রেন মে, এ মালাউনকা লাশ হ্যায়।’ কাজী আলী ইমাম সাহেবের বড় ভাই কাজী হাসান ইমাম সাহেব বেরিয়ে এসে বাড়ির সব পুরুষ সরিয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বোঝানোর চেষ্টা করেন। যে, ‘তারা হিন্দু নন, তাঁরা মুসলমান।’ তার বুকে বন্দুকের নল ঠেকালো তারা। সালেমা খাতুন ছুটে এসে তাঁদের পায়ে পড়লেন, ‘দু’জনকে নিয়েছো তোমরা। আর না।’ রোশেনা বেগমের মেজ বোন জরিনা বেগম ছুটে এসে সেই বন্দুকের নল নিজের বুকে টেনে নেন। এতক্ষণ কোরান শরীফ বুকে নিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে স্বামীর লাশের পাশে বসেছিলেন কাজী আলী ইমাম সাহেবের স্ত্রী মনি ইমাম। হঠাৎ তিনি কোরআন শরীফ খুলে পড়তে শুরু করলেন। চমকে উঠলো পাকিস্তানিরা, ‘কে? কে পড়ে কোরান? তোমরা কোরান পড়? তবে তোমরা হিন্দু নও? কিন্তু আমাদের তো জানানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সবাই হিন্দু।’ হাসান ইমাম সাহেব আবারও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তাঁরা সুন্নি মুসলমান। তখন তারা বলল, ‘ঠিক আছে, আমাদের ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু লাশ তোমরা আমাদের দিয়ে দাও।’ অনেক অনুনয়ের পর তারা এই মর্মে রাজি হয় যে ‘’কেবলমাত্র রাতের বেলা তোমরা নিজ বাড়িতেই দাফন করতে পার।’ আর্মিরা চলে যাওয়ার পর ছোট কুহুকে (ড. এ কে এম গোলাম মোস্তফার একমাত্র সন্তান) ডেকে এনে শেষবারের মতো তাঁর আব্বু(ড. এ কে এম গোলাম মোস্তফা) ও লাল আব্বুর (আলী ইমাম) চেহারা দেখানো হয়। ‘দেখে নে তোর আব্বুদের শেষবারের মতো, আর কোনোদিনও দেখতে পাবি না।’ অবোধ শিশুটি কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল।
সারাদিন সবাই মিলে লাশ দুটিকে ঘিরে বসে রইলেন। সন্ধ্যার পর শুরু হলো কবর খোঁড়ার পালা। চার বোন তাঁদের ফুপু (বড় ও মেজর শাশুড়ি) সালেমা খাতুনসহ বাড়ির সামনের বাগানে কবর খুঁড়তে গেলেন। এর মধ্যে মেজ ও ছোট সদ্য বিধবা ও একজন বৃদ্ধা। কাজ আর এগোয় না। হাসান ইমাম সাহেব কাজের ছেলেটিকে নিয়ে এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে। পালাক্রমে কোদাল ধরে ভোর নাগাদ তৈরি হলো জোড়া কবর। খুব সকালে জানাজা শেষে কবরস্থ করা হলো দেশের দুই সুসন্তানকে।
সেদিনের সেই ছোট কুহু আজ শুধু বোঝার চেষ্টা করে সেই মায়ের কষ্ট যাঁর সাদা থান তাঁর ছেলেদের কাফন হয়েছিল। সেই স্ত্রীদের কষ্ট যাঁদেরকে তাদের স্বামীর জন্য কবর খুঁড়তে হয়েছিল, আর সেই বড় ভাইটির কষ্ট, যাঁকে তাঁর ছোট ভাইদের জানাজায় ইমামতি করতে হয়েছিল। তাঁদের মতো করে সে কোনোদিনও বুঝতে পারবে না।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
গ. রণাঙ্গনে সুর্যসৈনিক; সম্পাদনাঃ সাখাওয়াত হোসেন মজনুঃ প্রকাশনাঃ মর্জিনা আখতার; প্রকাশকালঃ ১ জুন, ১৯৯২; পৃ. ২১৫ ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৫৯
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ