You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমার আব্বা

শহীদ ডা. মেজর আ খ আমিরুল ইসলাম

ডা. রুখসানা শাহীন

 

আব্বা এ কে আমিরুল ইসলাম। পিতামহ মো. শমসের আলী। ময়মনসিংহের শহরতলি কলপায় এক মধ্যবিত্ত সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে আব্বার জন্ম। ময়মনসিংহেই আব্বার লেখাপড়া ও সামাজিকরণ শুরু হয়। ময়মনসিংহে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা শেষে ১৯৪৯ সালে আব্বা তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে আব্বা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আম্মার নাম লতিফা খাতুন। আব্বা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর)প্রেষণে কর্মরত থাকায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাসভবনে না থেকে রিকুইজুশনে শহরের পাঁচলাইশে ‘শুকতারা’ নামক বাসায় আমাদের থাকতে হতো(বর্তমানে ‘শুকতারা’ বাসাটি চিটাগাং পলি ক্লিনিকে রুপান্তরিত হয়েছে)এসময় আব্বা সেনাবাহিনীতে মেডিকেল কোরে ‘মেজর’ পদে পদায়িত ছিলেন। চাকরির ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালে আব্বাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান হতে বদলি করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে ইপিআরে নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই আব্বা চট্টগ্রামে সামরিক ও বেসামরিক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। সম্ভবত আব্বা কর্তৃক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনীয়ভাবে চিকিৎসা প্রদানের কথা অবাঙালি পাকসেনা সদস্যরা জেনে যায়। ১৯৭১ সালে আমি নবম শ্রেণীতে চট্টগ্রামে পড়তাম। তখন আমার বয়স ১৩ বছর। ছোট দুই বোনও চট্টগ্রামেই পড়াশোনায় ছিল। ৪ এপ্রিল ১৯৭১-এর পূর্বাহ্নে আমাদের বাসায় পাকসেনারা আক্রমণ চালায়। চট্টগ্রামে চাকরি করার সুবাদে সেদিন ওয়াদুদ মামাসহ তাঁর পরিবার এবং আঙুর চাচা আমাদের বাসায়ই ছিলেন। পাকসেনাদের আক্রমণে আমাদের সবার চোখের সামনে আব্বা, মামা ও আরদালি জয়নাল নিহত হন(ইন্নালিল্লাহে্‌ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। এ অবস্থায় আম্মা ও আমরা তিন বোন এবং ওয়াদুদ মামার পরিবারের সবাই হতভম্ব হয়ে যাই। ওয়াদুদ মামি উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি মহিলা। আমরাও উর্দু জানতাম। কিন্তু আমাদের কারও মুখে

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ৫৩

শহীদ ডা. মেজর আবুল খায়ের আমিরুল ইসলাম

 

পাকসেনাদের বলার মতো কোনো কথাই বের হয়নি। শুধু আব্বা পাকসেনাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘তুমলোগ কিউ? হাম তোমহারে অফিসারকে সাথ বাত করেঙ্গে (তোমরা কেন? আমি তোমাদের অফিসারের সাথে কথা বলবো)।’ এরপরও গর্জে ওঠে ওদের ধারণকৃত অস্ত্ৰ। মৃত্যুর নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। আঙুর চাচা অক্ষত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পাকসেনারা আমাদের সবাইকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার রহস্যে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হওয়ায় আমরা বেঁচে যাই। জনা যায় যে, নিহত সবাইকে আরো অনেকের সাথে ‘শুকতারা’র পেছনে গণ কবর দেয়া হয়। তখন নিকট আত্মীয়দের অনেকেই তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার মধ্যে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মামি সিদ্ধান্ত নেন, উনি তার তিন ছেলেকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবেন। আম্মা আমাদের তিন বোনকে নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। উপায়ান্তর না দেখে, স্থানীয় কিছু বেসামরিক অবাঙালি ও বাঙালিদের সহযোগিতায় সমুদ্রযোগে মামিসহ আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাই। উদ্দেশ্য ছিল শোকাহত অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত আমাদের পরিচিত নিকট আত্মীয়দের সহযোগিতা পাওয়া। সত্যিই সেদিন নিকট আত্মীয়দের সহযোগিতা পেলাম।

এরপর দেশ স্বাধীন হলোজন্ম নিল নবগঠিত বাংলাদেশ। মামি তার তিন ছেলেসহ পাকিস্তানে রয়ে গেলেনআমরা স্বদেশ বাংলাদেশে ফিরলাম। দেশের অনেক কিছুই অপরিচিত লাগল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নিকট আত্মীয়দের নিবিড় সহযোগিতায় সুখ-দুঃখের মাঝে দিন কেটে গেল। দেখতে দেখতে অনেক সময় পার হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ১৯৯১ সালে আম্মাও চিরবিদায় নিলেন। আমরা তিন বোন উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে দেশে-বিদেশে কর্মরত আছি। উপরন্তু আমরা তিন বোনই বৈবাহিকতার আবদ্ধে বর্তমানে নিজেদের পারিবারিক জীবনে ব্যস্ত আছি।

পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দানা বেঁধে ওঠে। সেনাবাহিনীতে আব্বার সহকর্মীদের অনেকেই পরবর্তী সময় উচ্চতর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তাঁদের অনেকেই বর্তমানে জীবিত আছেন। মনে হয়, আব্বা জীবিত থাকলে তিনিও হয়তো তেমনই উচ্চপদ হতে অবসর গ্ৰহণ করতেন। আজ যদি আব্বা-আম্মা থাকতেন, তাঁদের আমরা আমাদের সুখী জীবনের ছোঁয়া দিতে পারতাম। আবার মনে পড়ে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের কথা, যারা আমার আব্বার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কখনও ভাবি, সেনাসদস্যদের দোষ দিয়েই-বা লাভ কী? আব্বার মৃত্যু ছিল নিয়তির পরিহাস। পরিশেষে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সবার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি। সবাই যেন বেহেশতবাসী হন।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্র:

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কাৰ্য্যালয় বিএমএ ভবনে (তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

খ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মরণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা, ১৯৮৯ খ্রি.।

গ. সেই রাজাকার; প্রকাশনাঃ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, জনকণ্ঠ প্রকাশনী; প্রকাশকালঃ ৪ জুলাই ২০০১; পৃ. ২৮৫ ।

ঘ. নারীর ’৭১ ও যুদ্ধ-পরবর্তী কথ্য কাহিনী; প্রকাশনাঃ আইন ও সালিশ কেন্দ্র ।

৫৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!