আমার স্বামী
শহীদ ডা. ক্যাপ্টেন আবুল কাশেম মো. ফারুক
মনোয়ার ফারুক
কথা ও কাব্য বা সাহিত্য প্রায়ই বলা হয় স্মৃতি রোমস্থন করে; সুখকর অনুভূতিতে মানবমন হয় আপুত। হ্যাঁ, কথাটা সত্যি-যদি সে স্মৃতির অন্তরালে ঘটনাপরম্পরা আবহমানকালে জাগতিক নিয়মে সাবলীল ক্রমবিকাশে সহজে সবকিছু সংগঠিত হয়। আর এর কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটলেই সে স্মৃতি হয় বিদগ্ধ, যার ক্রমবর্ধমান দহনে স্মৃতিকেন্দ্রিক সবাই তিলে তিলে নিঃশেষিত হয় সারাজীবন। আর এই অভাগাদের মধ্যে আমিও একজন।
আমার স্মৃতিসত্তায় আমার প্রিয়তম সেই ব্যক্তিটিকে আমি হারিয়েছি দেশমাতৃকার স্বাধীনতার প্রয়োজনে ১৯৭১ সালে। ভৈরবের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমার মরহুম বাবা জয়নুল আবেদীন অনেক ঘটা করে তাঁর জ্যেষ্ট কন্যাকে, মানে আমাকে, বিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের বিশিষ্ট ব্যাংক অফিসার মরহুম আবু তালেব ভুঁইয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র এ কে এম ফারুকের সাথে। আমার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী দাদা মরহুম হাজী মোজাফ্ফর আহমেদ সেদিন যে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, তাও আজ আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সদা এক অসহনীয় বেদনাদায়ক প্রতিবিম্ব তৈরি করছে অহরহ। বিয়ের দিনটি ছিল ৩১ অক্টোবর, ১৯৬৮। আমি তখন ভৈরবের হাজী আছমত কলেজে দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী। ছাত্রী হিসেবেও ভালো ছিলাম। কিন্তু দাদার ওপরে কথা বলবেন কে? আমার বিয়ে হয়ে গেল।
আমার প্রিয় ব্যক্তিটি তখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের এমবিবিএসের
শেষ পর্যায়ের ছাত্র। ডাক্তারি পাস করলো। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হেলথ সার্ভিসে চাকরি পেয়ে ফরিদপুর বদলি হলো। গেল না। এর আগে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে বিএসসি পড়ার সময়ই সে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন পেয়েও স্নেহময়ী মায়ের আবদার ও আপত্তির মুখে যোগদান করেনি। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর দানব তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে (এ.এম.সি.); নিয়োগ পাওয়ার সাথে সাথে যোগদান করলো। কী আনন্দ আমার! আমার স্বামী লে. এ কে এম ফারুক এ.এম.সি। কিন্তু এ সুখানুভূতি ছিল নিতান্তই সাময়িক।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৪৭
শহীদ ড. ক্যাপ্টেন আবুল কাশেম মো. ফারুক
তখন সে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ৪০তম ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে কর্মরত। চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। সে এক অভাবনীয় আতঙ্ক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের বিশ্বাস করছে না। আর বাঙালিরা তো মনে মনে যুদ্ধের প্রভৃতি নিয়েই ফেলেছিল। ইতোমধ্যে ২৭ মার্চ বাঙালি সেনাদের হাতে কর্নেল শাহানুর নিহত হলেন চট্টগ্রামের কুমিরায়। তারই প্রতিক্রিয় ও প্রতিশোধ হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাসেও বাঙালি-পাঞ্জাবি সম্পর্কের অবনতি ঘটল অতি দ্রুতগতিতে।
৩০ মার্চ ১৯৭১ সাল। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের আমাদের বাসায় আমি, আমার স্বামী ও আমাদেৱ ৬ মাসের ছেলে এ কে এম তারেক। শখ করে ও তার নাম রেখেছিল সোহাগ। সকালের নাশতা টেবিলে দেয়া। হঠাৎ একটি জলপাই রঙের জিপ এসে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সাথে ওকেও তুলে নিয়ে গেল। দুপুরের দিকে আমার সাথে তার শেষ কথা হয় টেলিফোনে। বললো, ‘ভালো থেকে, আমরা ভালো।’ মনে হলো তাঁদের বাকস্বাধীনতা ততক্ষণে শেষ। কিন্তু অসহায়ত্বের নির্মম কশাঘাতে আমরাও সেদিন বাকরুদ্ধ, নিৰ্বিকার৷ আমাদের বাসায় চারদিকে পাঞ্জাবি সেনারা প্রতিনিয়ত নজর রাখছে। কোথাও বেরুবার উপায় নেই। পরে জানলাম, ঐ দিনই বিকেল চারটার পরে কর্নেল ডা. জাহাঙ্গীর, মেজর খালেকসহ আরো অনেক বাঙালি অফিসারদের সাথে আমার প্রিয়তম স্বামী ডা. ক্যাপ্টেন এ কে এম ফারুককেও ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় এবং নিকটস্থ এক গণকবরে মাটি চাপা দেয়া হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচদিন পরে আমাকে, আমার ছয় মাসের শিশুপুত্র সোহাগকে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের পরিবার-পরিজনদের সাথে ময়নামতির ইস্পাহানী স্কুলে আটক রাখা হয়। পরবর্তীকালে মুক্তিসংগ্রামের তীব্ৰতা ক্ৰমান্বয়ে বেড়ে গেল। জুলাই মাসে অন্যান্য বাঙালি পরিবারের সাথে আমাকেও ছেড়ে দেয়া হয়। চারদিকে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞের বেহায়াপনায় তখন লিপ্ত। তাই কোথায় যাই, কেমন করে ঢাকা পৌঁছবো এসব ভাবতে ভাবতে দেখি আমার ছোট বোনের স্বামী খাদ্য বিভাগের অফিসার জনাব আবদুল হাকিম আগাম খবরের ভিত্তিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ময়নামতি চলে এসেছেন। তাই শত দুঃখেও কিছুটা স্বস্তির স্বাদ পেলাম। এরপরে কুমিল্লায় নিরাপদ না ভেবে, তাৎক্ষণিকভাবে হাকিমকে নিয়ে বাসে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ট্রেনে চড়ে ভৈরবে বাবার বাড়ি চলে এলাম। ট্রেনে অসংখ্য পাঞ্জাবি সেনা সবাইকে তল্লাশি চালিয়ে অনেককেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং হায়েনার দল হয়তো সবাইকেই হত্যা করেছিল। আমাকে প্রশ্ন করাতে আমার সাথের হাকিম তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে পাঞ্জাবি হায়েনাদের বুঝিয়ে বললে যে, ‘আমি ওদের মেডিকেল কোরের ডাক্তারের স্ত্রী, ডাক্তার ফিল্ডে গেছেন, তাই ফ্যামিলি বাড়ি পাঠাচ্ছেন।’ এভাবে ছলনার আশ্রয় নিয়ে কোনোরকমে সেদিন রেহাই পেয়েছিলাম।
সবচেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, ওর মৃত্যু সংবাদ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি জনতাম না। তাই প্রতিনিয়ত অপেক্ষায় থেকেছি ওর প্রত্যাশিত প্রত্যাগমনের আকাঙ্ক্ষায়…। ও আর আসেনি। এলো ওর প্রতিভূ। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই আমার আর এক পুত্র সন্তানের জন্ম হল। তাই কনিষ্ঠ পুত্রের নিরানন্দ জন্মদিনও সবাই ছিল ওদের বাবার নিরুদ্দেশের শোকে মুহ্যমান। আজ আমার দুই ছেলেই পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু জা ওরা পায়নি, তা আর পাওয়ার নয়। সৃটিকর্তার অমোঘ নিয়মে ওরা ওদের মুখে ‘আব্বু’ ডাক আর উচ্চারণ করতে পারেনি। আমার স্বামীর মৃত্যর সময় বড় ছেলে এ কে এম তারেক সোহাগ বয়স ছয় মাস, আর ছোট ছেলে এ কে এম আরিফ পরাগের জন্ম ওর মৃত্যুর পরে। সোহাগ আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এমকম (হিসাব বিজ্ঞান), বিকম(সম্মান) পড়াশোনা করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের(বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত আছে।
আর আমি? আমার চাচা ভৈরব কলেজের প্রবীণতম অধ্যাপক আতাউর রহমান ও আমার অনুজ অধ্যাপক আহমেদ আলীর অনুপ্রেরণা ও পীড়াপীড়িতে ভৈরব কলেজ থেকেয় পরবর্তীকালে কৃতিত্বের সাথেই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। তারপর ভৈরবের বিখ্যাত এমপি গার্লস হাইস্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পরে ১৯৮০ সালে আমি
৪৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৪৯
শহীদ ড. ক্যাপ্টেন আবুল কাশেম মো. ফারুক
পেট্রোণাংলার অঙ্গ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে সরাসরি অফিসার হিসেবে যোগদান করি। যথারীতি দু’বার পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে আমি সংস্থাপন বিভাগের ব্যবস্থাপক। ঢাকা সেনানিবাসে নিজস্ব বাড়িও হয়েছে এবং স্থায়ীভাবে আমি বাস করছি সেখানে।
কিন্তু আমার স্মৃতিসত্তায় দেদীপ্যমান আগুন আজও আমায় তিলে তিলে দগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত।
*(লেখিকা প্ৰয়াতঃ রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৮ম পর্যায়; ১৯৯৯ । (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. *স্মতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৫ম খণ্ড, প্রথম মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬; পৃ. ৩৩ ।
চ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৬৪ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।
জ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ পৌষ ১৪০০, জানুয়ারী ১৯৯৪; পৃ. ৮৪।
ঝ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ আগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ১৮ ।
জ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪৩ ।
ঝ. খুঁজে ফিরি-১৯৭১-এর পিতৃস্মৃতিহীন সন্তানদের কথা, সম্পাদনা; রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনীঃ পৃ. ৯৩ ৷
ঞ. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান; সম্পাদনাঃ এ এস এম সামছুল আরেফিন; প্রকাশনাঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯৫; পৃ. ৫৩৫ ।
৫০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ