You dont have javascript enabled! Please enable it!

শহীদ ডা. আতিকুর রহমান

গ্রামে চাকরির পাশাপাশি মানুষের সেবা করে দিন চলে যাচ্ছিল। তিনি কোনোদিন তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি। নিজের আপনজন যদি অন্যায় করতো তিনি তাদের কঠোরভাবে শাস্তি দিতেন। তিনি অন্যায়ভাবে টাকা-পয়সা উপার্জন করেননি। তিনি অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে ফিরিয়ে দিতেন। যার জন্য নিখোঁজ হওয়ার পর ব্যাংকে তাঁর সঞ্চয় ছিল মাত্র ৮০ টাকা। বাস্তব যে কত কঠিন ও নির্মম তা আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর বুঝতে পেরেছি।

যা হোক, গ্রামে ভালো স্কুল না থাকায় স্ত্রীর ইচ্ছায় সন্তানদের তাদের নানার বাড়িতে পড়াশোনার জন্য পাঠান। কিন্তু সন্তানদের ছেড়ে থাকতে না পেরে তিনি চাকরিই ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৯৭০ সালে প্র্যাকটিসের পাশাপাশি মিটফোর্ড হাসপাতালে এমবিবিএস পড়া শুরু করেন; ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক দীনতার জন্য শুরুটা দেরি হয়ে গেল। এখানেও তাঁর সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তাঁর ডিগ্রি নেয়া আর সম্ভব হলো না। পড়াশোনার পাশাপাশি প্র্যাকটিশ ও খণ্ডকালীন চাকরি করতে হয়েছে সংসারের জন্য। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে বাসায় এসে অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করেছেন; তাতে তাঁর কোনো বিরক্তি ছিল না। সারারাত জেগে কাটাতে হতো; তা সত্ত্বেও তিনি সন্তানদের কোনোদিন ডাকতেন না তাদের অসুবিধা হবে বলে।

শুধু স্ত্রী ও সন্তানদের কথা ভাবতেন না, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও চেনাজানা সবার কথা ভাবতেন। তার এক বন্ধু ছিল যিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। তাঁর ওপর হুলিয়া ছিল; তিনি তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কারণ সে ছিল তার বাল্যকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা তখন বেশ ছোট। আমার বড় চাচা অসুস্থ হয়ে ঈদের আগে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর জন্য আমাদের বাসায় কোনো ঈদ উদযাপন হয়নই। তখন খুব রাগ হয়েছিল; আমরা নানুবাড়িতে চলে যাই। তখন তো বুঝতে পারিনি এর ভেতরে কতটা আন্তরিকতা ছিল, যা বর্তমানে দেখা যায় না। কারো অসুস্থতার সংবাদ পেলে তিনি ছুটে যেতেন। আমরা যখন ফরিদপুরে ছিলাম তখন ওখানকার অনেকজনকে ঢাকায় চাকরি দিয়েছিলেন। যতদিন চাকরি পায়নি ততদিন নিজের বাসায় রেখেছিলেন। এই রকম অনেক ঘটনা আছে যা লিখলে হয়তো আমার লেখা শেষ হবে না।

আব্বুকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেদিনের ঘটনা। আমার চাচার বাসায় এক মেয়ে কাজ করতো; ওর ছোট বোনের লিভার সিরোসিস হয়েছিল। এই অসুখের তো কোনো চিকিৎসা ছিল না। তাই আব্বু যখনই দেখতে যেতেন ফল খাবার জন্য টাকা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আর্মিরা ধরে নেয়ার কিছুক্ষণ আগে সেই অসুস্থ মেয়েটিকে কোলে করে তার বাবা আব্বুর চেম্বারে যায়; তখন মেয়েটির খুব কষ্ট হচ্ছিল। আব্বু মেয়েটির বাবাকে টাকা দেন যাতে রিকশা করে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। ঐ রাতে মেয়েটি মারা যায়। ফরিদপুরের নড়িয়ায় থাকা অবস্থায় প্রচণ্ড ঝড় হয়। অনেক মানুষ আহত-নিহত হয়। এত বেশি মানুষ আহত হয়েছিল যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁর একার পক্ষে চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি তার বাড়ি ও ডিসপেনসারির পাশেই এক হিন্দু বাড়িতে অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন; সেখানে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে আহতদের চিকিৎসা করেছিলেন।

তাঁর মৃত্যুর ৩৭ বছর পরেও তাঁর সম্বন্ধে কাউকে কোনো কটুক্তি করতে শোনা যায়নি। এখনও সবাই তাঁকে শ্ৰদ্ধা করে চোখের জল ফেলেআমি মনে করবো এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পাওনা। এটাই আমাদের সৰ্বঅহঙ্কার। এই যে সম্মান আমার আব্বু পাচ্ছেন সেটা সবার ভাগ্যে জোটে না। কারণ মৃত্যুর পর মানুষের মন থেকে মানুষ কিছুদিন পরেই মুছে যায়। যারা মহৎকর্মে নিয়োজিত থাকেন তাদেরই কেবল সবাই দীর্ঘদিন মনে রাখেআমার আব্বু তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মানুষ।

১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানিরা যে সহজে আমাদের শাসন ক্ষমতা দেবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজে সপ্তাহে দু’দিন যেতেন। যাওয়া-আসার পথে তেজগাঁও বিমানবন্দর পড়ত। তখন তাঁর চোখে পড়ত বিমানে করে কোনো যাত্রী যাওয়া-আসা করত না; তাঁর পরিবর্তে আর্মি অফিসার, অস্ত্ৰ-গোলাবারুদ নামত। তাই তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি সবসময় বলতেন বড় কোনো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন তিনি অবাক হননি; কারণ তিনি অঘটনটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমরা পুরান ঢাকার নারিন্দায় ৯নং শাহ সাহেব

 ৩৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!