না দেখা বাবার কথা
শহীদ ডা. আজহারুল হক
আশরাফুল হক নিশান
বাবা শব্দটির শুরু ও শেষ কেমন, কোথা থেকে তা আমি জানি না, বুঝি না। তিনি আমার সবচেয়ে নিকটজন, প্রিয়জন হয়েও কতদূরে অনন্ত এক অজানায় রয়ে গেলেন। আমি এই পৃথিবীতে আসার মাত্র দু’মাস আগেই তাকে এখান থেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিয়েছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পাকবাহিনীর এ দেশীয় দোসর আল বদররা। কী ছিল তাঁর অপরাধ? অবশ্যই কিছু অপরাধ ছিল, তবে সেটা পাকবাহিনী তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের দৃষ্টিকোণ থেকে। আজ তাই ‘বাবা’ ডাকটি আমার কানো শুনলে মনে হয় নীল দিগন্তে অস্তায়মান লাল সূর্যের ওপার থেকে চিরপরিচিত কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হয়তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য কল্পনার জগতে চলে যাই- ‘বাবা থাকলে কেমন লাগত কেমন থাকতাম?’ পরীক্ষণেই সত্যের কশাঘাতে বাস্তবে ফিরে আসি। উপরে তাকিয়ে ভাবি, দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি একটি সুন্দর, সচ্ছল, স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ থেকে চিরজীবনের জন্য বঞ্চিত হলাম-যেটার সবচেয়ে বেশি আমার প্রয়োজন ছিল, নিয়তি আমাকে এমনই কোণঠাসা করলো। কাচের ফ্রেমে আবৃত দেয়ালে ঝুলন্ত বাবা অথবা শহীদ চিকিৎসকদের তালিকায় চার নম্বরে অন্তর্ভুক্ত বাবা কি আমার শূন্যতা পূরণে সক্ষম? মায়ের কাছে শুনে বাবার একটা চিত্র, চরিত্র কল্পনা করতে চেষ্টা করি—শুধুই কল্পনা; বাস্তবের সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই।”
মার কাছে শুনেছি বাবা নাকি চিকিৎসক হিসেবে নিজের কর্তব্য সম্পর্কে অস্বাভাবিক রকম নিষ্ঠাবান ছিলেন । গরিব, দুঃখীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন, তাদের মাঝে ফ্রি স্যাম্পল ওষুধ দিয়ে দিতেন। আরও শুনেছি, তিনি কীভাবে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে বেপরোয়াভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে চিকিৎসা করতেন, ওষুধপত্র সরবরাহ করতেন, টাকা পঁয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। তিনি হাতিরপুলে সাঈদা ফার্মেসিতে বসতেন, সেখানে সবসময় মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই প্রিয়। এসব যখন শুনি তখন বুকের মধ্যে এমন এক অনুভব করি যা আমি কারও সাথে শেয়ার করতে পারি না।
প্রতিদিন টিভিতে সংবাদের আগে যখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও জাতীয় পতাকার রক্তিম লাল সূর্য দেখি তখন ভাবি, আমার বাবার রক্তে রঞ্জিত এই পতাকা। লাখো শহীদের রক্তের কাছে ঋণী সমগ্র দেশ ও জাতি। আমার বাবার মতো অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা কখনোই কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবে না, দেবে না।
(*রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ ।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কাৰ্যালয় বিএমএ ভবনে (তোপাখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণঃ (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১, জুন ১৯৮৪; ৮ম খন্ড; পৃ. ৭০৭।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৪র্থ পর্যায়; ১৯৯৫। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. *স্মতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় খণ্ড, ২য় মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ শ্রাবণ ১৪০৯, আগস্ট ২০০২; পৃ.৯১ ।
চ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋন; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৪০ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।
জ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ পৌষ ১৪০০, জানুয়ারী ১৯৯৪; পৃ. ৮৪।
ঝ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ আগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ১৮ ।
ঞ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯; ৪৩ ।
ট. একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়; সম্পাদনাঃ ড. আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ্জামান এবং শাহরিয়ার কবির; প্রকাশনাঃ
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্ৰীঃ ৪ৰ্থ সংস্করণ, প্রকাশকাল : ফাল্গুন ১৩৯৫, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯; পৃ. ৭৮ ।
ঠ. সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ‘হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদরদের হত্যার শিকার কয়েকজন’; জাতীয় দিবস সংখ্যা-১৯৭৩ ।
৩৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ