আ মা র স্বা মী
শহীদ ডা. আজহারুল হক
সৈয়দা সালমা হক
এদুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ডাক্তার আজহারুল হকের সাথে আমার পরিচয়, পরিচয় থেকে জীবনসাথী। আর এক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে চিরদিনের মতো। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই ওমর জন্ম থেকেই মস্তিষ্কবিকৃত। আমাদের গ্রামের বাড়ি পাংশাতে একদিন সে রাগে উন্মত্ত হয়ে আরেক ভাই বাবরকে গুলি করার জন্য বন্দুক নিয়ে তাড়া করে, তড়িৎ বেগে আমি দৌড়ে বাবরকে বাঁচানোর জন্য যাই—অমনি গুলি ছুড়ে বসে ওমর। আর ঐ গুলির ছররা পেছন দিকে আমার ঘাড়ের উপরের অংশে লেগে যায়। অলৌকিকভাবে প্ৰাণে বেঁচে গেলেও ছররা বের করার জন্য আমাকে দ্রুত ঢাকায় এনে তৎকালীন প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক প্রফেসর আনসারীর অধীনে ভর্তি করা হয়। পরপর দু’দিন আমার ঘাড়ে জটিল অপারেশন করে ডা. আনসারী ছররা বের করতে সক্ষম হন। মারাত্মক এই ঝুকিপূর্ণ অপারেশনে ডা. আজহার সহকারী হিসেবে অংশ নেন। আজহার ছিল ডা. আনসারীর খুব প্রিয় ছাত্র। ওই সময় ক্লিনিকে ডা. আজহারকে দেখতাম সদা কর্মব্যস্ত থাকতে, কখনও ধীর পায়ে হেঁটে এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে দেখিনি। সবসময়ই এক প্রকার দৌড়েই চলাফেরা করতে আমি লক্ষ্য করেছি। ঘন্টার পর ঘণ্টা অপারেশন থিয়েটারে দাড়িয়ে কাজ করতে কোনোরূপ বিরক্তি ছিল না তার। গভীর রাত পর্যন্ত ক্লিনিকে জটিল রোগী নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। অথচ একটুও ক্লান্ত হননি। তিনি ছিলেন তাঁর পেশার প্রতি খুব আন্তরিক, শেখার প্রতি গভীর মনোযোগী। অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের বেঁটে-খাটো শ্যামলা রঙের মানুষ ছিলেন তিনি।
স্মৃতিচারণ করা বড় কঠিন, বড় কষ্টের, তা যদি মধুর না হয়ে হয় এরকম— ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের বিয়ে হয়, যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর, এক হৃদয়বিদারক-নিষ্ঠুরতা, বর্বরতার মধ্য দিয়ে। মাত্র এক বছর নয় মাস ছিল আমাদের বিবাহিত জীবন। কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে এত স্বল্প সময়ের মধ্য যে স্মৃতি ডা. আজহার আমার জীবনে রেখে গেছেন তা লিখে শেষ করার নয়। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫
‘৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাতের বিভীষিকার কথা। আমি ২৪ মার্চ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর কেবিনে ভর্তি হই।
ঐ একই সময়ে আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি ও আমার ভাইয়ের ফুফু শাশুড়িও রোগী হিসেবে আগে থেকেই হাসপাতালে ছিলেন। এক সাথে এই তিন রোগী দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন ডা. আজহার। ২৫ মার্চের রাতে তিনি বাসায় না ফিরে আমার কেবিনেই থেকে গেলেন।
রাত ১০টার দিকে কর্তব্যরত সিস্টার আমাকে প্যাথেডিন ইনজেকশন দিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ডাক্তার কেবিন সংলগ্ন বারান্দায় টেবিলের ওপর ঘুমাতে গেলেন। ডাক্তার আজহার তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের শল্য বিভাগে সহকারী সার্জন হিসেবে চাকরিরত। তাই আমি ভর্তি হওয়ার দিন থেকে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবিনে এসে আমাকে দেখে যেতেন। ২৫ মার্চ বেলা ১১টার দিকে ডা. আজহার হাসপাতাল ক্যান্টিন থেকে কাবাব ও শিঙ্গাড়া কিনে আমার কেবিনে এলেন, ঐ সময়ে আমার বড় বোন মিসেস শাহাবুদ্দীনও এসেছিলেন। খাবারগুলো বোনের হাতে দিয়ে এবং কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলেন আজহার, তখন আমি শুয়ে, চেয়ে তাকে দেখছিলাম, সাদা অ্যাপ্রোন ও কালো প্যান্টে ওঁকে সেদিন আমার চোখে কেন যেন খুব ভালো লাগছিল। খেতে খেতে তিনি আমার বোনকে উদ্দেশ করে বললেন, “আপা, আজকে কিছু একটা হতে পারে, দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে, যে কোনো মুহুর্তে কারফিউ হয়ে যেতে পারে। ১৯ নম্বর ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড খালি করার হুকুম হয়েছে।’ ‘আমি সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে কী হয়েছে জিগ্যেস করাতে তিনি ‘ও কিছু না, অফিসে অনেক কাজ আছে’ বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। বিয়ের পর থেকেই ডাক্তারকে দেখতাম এসব রাজনৈতিক ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাতে, প্রায় সময়ই নানা বিষয়ে গভীর আলোচনা করতেন। অন্যদের সাথে। নতুন নতুন খবর নিয়ে বাসায় ফিরে কী উৎসাহ নিয়েই না কথাগুলো আমাকে বলতেন। ছাত্রজীবনে তিনি কোনো ছাত্র সংগঠন করতেন কিনা জানি না। তবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভি.পি হুমায়ুন কবীরের সাথে তার খুব অন্তরঙ্গতা দেখতাম। ২৫ মার্চের রাত ১২টার দিকে যখন আমি প্যাথেডনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বিকট আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, আজহার তখন কেবিনের বারান্দায় ঘুমিয়ে। মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহর যেন থারথার করে কাঁপছে। আমি আয়াকে বলার আগেই দেখি ডাক্তার নিজেই কেবিনে ঢুকে দ্রুত আমার বেডটি ওয়ালের দিকে টেনে নিচ্ছেন। কারণ বেডটি ছিল জানালা বরাবর। অবিরাম বিকট গুলির শব্দে, কামানের তোপ ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে আমি দিশেহারা, প্রায় অজ্ঞান হয়ে থারথার করে কাঁপছিলাম। এমন কাঁপুনি যে আজহার আমাকে জাপটে ধরেও ঠেকাতে পারছিলেন না।
ডাক্তার ঐ সময় কাঁচের জানালার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘দেখ দেখ, ট্যাঙ্ক বের হয়েছে।’ তখনও বুঝতে পারছিলাম না মহাকালের নৃশংস, জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটছে এই শহরে। সারাটা রাত আমাদের এভাবেই কাটলো। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে গোলাগুলির আওয়াজ কিছুটা কমে এসেছে, মনে হলো পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। হাসপাতালের তিনতলা কেবিনে অসুস্থ অবস্থাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম সারাটা শহর যেন দ্রুত থমথমে হয়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতায় ভরে উঠেছে। আজহার এই সময় বললেন, ‘তুমি ভয় পেয়ো না, আমি নিচ থেকে মা ও ফুফুকে একটু দেখে আসি।’ আমি বললাম, ‘না, আপনি আমাকে একা রেখে যাবেন না’- এই বলে আমি তাঁর হাত চেপে ধরলাম। আজহার বললেন, সারা রাত মা ও ফুফু, কেমন ছিলেন, কী অবস্থায় আছেন একটু দেখে আসি’ বলেই তাঁর হাত জোর করে আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিচে চলে গেলেন। কিন্তু ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল, তিনি ফিরে এলেন না, তখন আমার খুব ভয় করতে লাগলো। এই সময় আয়া বললো, ‘আপা ঢাকা শহরে কোনো মানুষ নেই। সবাইকে মেরে ফেলেছে, মেডিকেলও থাকবে না, হাসপাতালের পানির পাম্প-ড্রাইভারকেও মেরে ফেলেছে।’ আয়াটা তক্ষুনি চলে যেতে চাচ্ছিল, আমি কারফিউর মধ্যে তাকে যেতে নিষেধ করলাম। কিছুক্ষণ পর আজহার হস্তদন্ত হয়ে কেবিনে ফিরে আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘মদিনা খালার স্বামীর নাম কী?’ ‘লে, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন’, বলেই আমি উইিকষ্ঠিত হয়ে কেন, কী হয়েছে জিগ্যেস করাতে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘না, কিছু না।’ পরে জানতে পেরেছিলাম
আমার খালু মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তানি আর্মিরা গুলি করে হত্যা করেছে। এই সময়ে তাঁর পরনের অ্যাপ্রোনে রক্তের দাগ দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম, হাসপাতাল অসংখ্য বুলেটবিদ্ধ, বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত মুমূর্ষু আহত রোগীতে ভরে গেছে, কোনো ওয়ার্ড এমনকি করিডোর বা বরান্দা খালি নেই। হাসপাতালে তখন উপস্থিত ডাক্তারের সংখ্যা খুবই নগণ্য, আজহারসহ সামান্য যে ক’জন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই মিলে আহতদের অস্ত্ৰোপচার করে বুলেট বের করতে শুরু করেছেন। ‘এখনও অসংখ্য আহত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে’ এই কথা বলে তিনি আমার জন্য হরলিকস বানাতে শুরু করলেন তখন হাসপাতালে পানি নেই; পানির ট্যাপে ফোঁটায় ফোঁটায় যেটুকু পানি আসছিল তাই ধরেই হারলিকস তৈরি করে তিনি দ্রুত আবার নিচে চলে গেলেন আহতদের তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করতে হবে বলে। সে সময় বাইরে আকাশটা ভীষণ ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, বাতাসে বারুদের পোড়া গন্ধ। এদিকে ডাক্তার নিচ থেকে ফিরলেন অনেকক্ষণ পর। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তাঁকে তখন খুবই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত লাগছিল, অ্যাপ্রোনে আরও রক্তের দাগ। ডাক্তার আমাকে শুধু অভয় ও সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ডাক্তার সন্ধ্যায় ও রাতে আরও কয়েকবার নিচে গেলেন আহতদের চিকিৎসার জন্য। সারা রাত এভাবেই কেটে গেল, সে রাতে আমাদের কারও খাওয়া হলো না। আর খাবার থাকলেও নিশ্চয়ই গলা দিয়ে নামতো না। কারও চোখে ঘুম নেই।
২৭ মার্চ কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হলে আজহার আমার আত্মীয়-স্বজনের খবর ও খাবার এনে দেন। তিনদিন পর ভালো খাবার পেলেও তা আমার গলা দিয়ে নামছিল না। আমি অসম্ভব ভীত দেখে তিনি বললেন, তোমাকে নিয়ে আর এখানে থাকা যাবে না, আগামীকাল সকালেই বাসায় চলে যাব। কিন্তু ২৮ মার্চ সকাল হতে না হতেই দেখি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও অন্য ডাক্তারদের পরিবার হাসপাতালের এক একটি কেবিনে ঢুকছেন, সবার হাতে একটি করে কেরোসিনের চুলা, একটি সুটকেস ও চালের ব্যাগ। লোকের ভিড়ে হাসপাতাল ভরে যাচ্ছে। এসব দেখে ও দু’একটি পরিবারের সাথে আলাপ করে বুঝলাম এখন হাসপাতালই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তাই মত পাল্টে আমি হাসপাতালেই থাকতে চাইলাম। ততক্ষণে আমরা কেবিন ছেড়ে দিয়েছি। সেখানে একটি পরিবারও এসে গেছে। আমার পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত জেনে আজহার বললেন ‘কেবিন তো অফিসিয়ালি আমি সকালেই ছেড়ে দিয়েছি, আর তাছাড়া রাতে গলাগুলির শব্দে ভয় পাও, তাই বাসায় যাওয়াই ভালো।’ এরপর আমরা ২৮ মার্চ থেকে ২৪ মে ‘৭১ পর্যন্ত পরীবাগের ৩/ডি ওয়াপদা কলোনিতে নোওয়া ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। এস.টি.এস. মাহমুদ- আমার নেওয়া ভাই তখন ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার।
ওখানে থাকার সময় আজহার একটি ঝুকিপূর্ণ দুঃসাহসিক অথচ মানবিক কাজ করেছিলেন, যা আমি অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম। আজিমপুর কলোনির ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের ‘বি’ ফ্ল্যাটে ফুড ডিপার্টমেন্টের এক ভদ্রলোকের ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রকে ২৬ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাক আর্মিরা কলোনিতে ঢুকে ঐ ১ নম্বর বিল্ডিংয়ের ছাদের কালো পতাকাটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ছেলেটি যখন ঐ কালো পতাকাটি নামানোর জন্য ছাদে ওঠে ঠিক সেই সময় নিচ থেকে আর্মি গুলি করে। গুলি ছেলেটির পায়ে লাগে। আহত ছেলেটির গুলি বের করার জন্য অভিভাবকরা হন্যে হয়ে ডাক্তার খুঁজে শেষে ২৭ মার্চ বুলেটবিদ্ধ ছেলেটির বাবা ডাক্তার পাওয়ার আশায় ঢাকা মেডিকেলে যান এবং উপস্থিত কয়েকজন ডাক্তারকে ঘটনাটি বলে ছেলেটির জীবন বাঁচানোর জন্য কাতর প্রার্থনা করেন। এই কথা শোনামাত্র ডা. আজহার সাথে সাথে রাজি হয়ে ছেলেটির বাবার সাথে গোপনে আজিমপুরে ঐ বাসাতে গিয়ে বুলেটটি অল্পক্ষণের মধ্যেই অত্যন্ত সুচারুরূপে বের করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে প্রতিদিন আজহার ছেলেটির ড্রেসিং বদলানোর জন্য খুব গোপনে ঐ বাসায় যেতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। এখন ছেলেটি নাকি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে শুনেছি। তার নাম আর আমার মনে নেই। এত বড় একটা ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাহসিক কাজ তিনি করলেন সম্পূর্ণই আমার অজ্ঞাতসারে।
২৪ মে, ১৯৭১ বিকেলে আমাদের নিজের বাসা ২২ নম্বর ফ্রি স্কুলে স্ট্রিটে (হাকিম হাউস) ফিরে আসি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আজহার বিকেলের দিকে কাজী আলাউদ্দিন রোডের ‘শামীম ব্রাদার্স’ নামের ফার্মেসিতে বসতেন। যুদ্ধের সময় হাতিরপুলে বাসার কাছেই সাইদা ফার্মেসিতে বিকেলের দিকে বসা শুরু করলেন। কিন্তু তখন তিনি সবসময়ই অনেক রাত করে বাসায় ফিরতে লাগলেন। দেশের ঐ রকম একটা অস্বাভাবিক মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। কেন যে একথা আমার বারবারই মনে হতো আজও বুঝি না। তিনি রাতে ফিরে এলে মনে হতো বুক থেকে যেন ভারি পাথর সরলো, ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারছি। রোজ রোজ দেরি করার কারণ কী জিগ্যেস করলে, দূরে কলে গিয়েছিলেন বা রোগীর ভিড় ছিল ইত্যাদি অজুহাত দিতেন, কখনও আসল কথাটি বলতেন না। এই ভয়াবহ যুদ্ধের সময় তাকে প্র্যাকটিস না করার জন্য বারবার অনুরোধ করতাম, কত বলেছি, কী দরকার বিকেলে ফার্মেসিতে বসে? না বসলেই কি নয়? উত্তরে তিনি সবসময় হাসতে হাসতে বলতেন, “আমি ডাক্তার মানুষ; আমার যা ডিউটি তা তো আমাকে করতেই হবে, রোগীরা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?’
যত নিষেধ করি তত যেন বেশি মেতে উঠলেন রোগী দেখা নিয়ে, যেন কোন নেশায় ধরেছে তাঁকে। যুদ্ধের ভেতর এত রোগীই-বা কত্থেকে আসে একদিন জিগ্যেস করতে বললেন, ‘আরে বোঝা না কেন, ডাক্তার কই, বেশিরভাগই তো এখন এখানে নেই, ডাক্তারের অভাব, তাই এত ভিড় মনে হচ্ছে।’ এভাবেই উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ নিয়ে দিন চলতে লাগলো। প্রায়ই রাত করে বাসায় ফিরে নতুন নতুন সংবাদ আমাকে শোনাতেন। বলতেন, আর কয়টা দিন সবুর করো, দ্যাখোনো কী হয়, শিগগিরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অমুক দিন ঢাকা শহরের অমুক জায়গায় হামলা করবে অথবা অমুক তারিখে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি । মাঝে মধ্যেই অনেক করে চাল, ডাল, তেল, আলু কিনে রাখতেন। একদিন বললেন, ‘১৪ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, মুক্তিবাহিনীরা অ্যাটাক করবে।’ তার জন্য খাবার কিনে আলাদা করে তুলে রাখলেন। এটা তিনি শহীদ হওয়ার মাত্র এক-দেড় মাস আগের কথা। সেই চাল-ডাল তার মৃত্যুর পর গরিব-দুঃখীকে খাওয়ানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমাদের আগত বাচ্চার (আমি তখন প্রথম অন্তঃসত্ত্বা) কাপড়-চোপড় ডেটল দিয়ে ধুয়ে পৃথক একটা সুটকেসে রেডি রাখতে-এজন্য দোকান থেকে বাচ্চার জন্য নতুন কাপড়ও কিছু কিনে এনেছিলেন। আরো বলেছিলেন, যখন-তখন আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে, এমনকি গ্রামেগঞ্জে যেতে হতে পারে। এসব শুনে আমি অবাক হয়ে বলতাম, আপনি এতসব কথা কত্থেকে পান। এর উত্তর তার স্বভাবসলুভ হাসি দিয়ে বলতেন, ‘আরে, আমার কাছে সব খবরই আসে, লোকে খবর দিয়ে যায়, তুমি আমাকে কী মনে করে?’ এসব কথা জোরে জোরে বলে হো হো করে হাসতেন। এত জোরে বলতেন যে, আশপাশের বাসায় লোকজনও শুনতে পেতেন। তখনও আমি এসব কথার মর্ম বুঝিনি। শহীদ হওয়ার পর সাইদাং ফার্মেসির তখনকার মালিকদের কাছে জানতে পারলাম কেন তিনি অধিক রাতে বাসায় ফিরতেন। তাঁরাই আমাকে জানালেন, ডাক্তার আহত, বুলেটবিদ্ধ ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ডেরায় গিয়ে চিকিৎসা করতেন, বুলেট বের করতেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের একবার চোখ-ওঠা রোগ হয়েছিল, তখন নাকি ডাক্তার ওদের জন্য ভীষণ কষ্ট করে ওষুধ জোগাড় করে নিজ হাতে পৌঁছে দিতেন। হাতিরপুল এলাকাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আখড়া, তাই যত ওষুধ, চিকিৎসা সব আজহার করতেন। তিনি এক সময় আমাকে এও বলেছিলেন, ১৪ অক্টোবর থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরপাকড় শুরু হবে। দেখতে দেখতে ১৫ নভেম্বর সেই অভিশপ্ত দিনটি চলে এলো আমার জীবনে। ঐ দিন ভোর পৌঁনে ৬টায় আমার ঘুম ভাঙলো, আমি ডাক্তারের অ্যাপ্রোনটা লন্ড্রি থেকে আনার জন্য কাজের ছেলে শাহাদাতকে পয়সা দিলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ফিরে এসে বললো, ‘বেগম সাহেব অ্যাপ্রোন আনতে পারলাম না, কারফিউ হয়ে গেছে, মিলেটারিরা পুরা হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রোড, হাকিম হাউস এলাকা ঘিরে রেখেছে। আমাকে হাত উঁচু করতে বললো এবং বুকে রাইফেল ধরে বললো, তুমি কোথায় কাজ করো?’ আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, ‘ওরা তোমার সাথে কী ভাষায় কথা বলেছে?’ ছেলেটি বললো, ‘বাংলায়।’ তখন তাকে বললাম তুমি রাজাকার দেখেই ভয় পেয়ে গেলে!’ এরপর ওকে শান্ত হতে, বিশ্রাম নিতে বললাম। এর মধ্যে আমাদের বুয়া চা দিয়ে গেল, আজহারের বেড-টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। আমিও চা খেলাম, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, তার সাথে এই শেষ বেড-টি খাওয়া। এরপরই আমি খুব অস্থির হয়ে উঠলাম ডাক্তার কীভাবে হাসপাতালে যাবেন ভেবে। কারণ আমি জানতাম ও দেখেছি, আজহার খুবই কর্তব্য এবং সময়নিষ্ঠ। ঝড়,
ওনারা তো সেই কখন হাসপাতালে চলে গেছে। ভাই আমাকে অস্থির হতে বারণ করলেন। ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে মান্নান নামের একজন পিয়ন এসে খবর দিল ডাক্তার আজহার এখনও পৌছায়নি, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা হবে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো, আমার মাথাটা হালকা শূন্য হয়ে যেতে লাগলো। সারা ‘হাকিম হাউস’ এলাকায় বিদ্যুতের মতো কথাটা ছড়িয়ে পড়লে সবাই বিষাদক্লিষ্ট, কালো মুখ নিয়ে জড়ো হতে লাগলো। আমার ভাই সাথে সাথে সাইদা ফার্মেসির মালিকদের খবরটা দিলেন ও বাড়িওয়ালার ফোনে মগবাজারে বড় দুলাভাই ও অন্য ভাইদের জানালেন। শুরু হয়ে গেল খোঁজ করার জন্য ছোটাছুটি। আমার ভাই ও দুলাভাই হাসপাতালে গিয়ে দেখেন কে বা কারা যেন ডাক্তারদের দৈনিক উপস্থিতির হাজিরা খাতায় আজহারের নামের পাশে ‘পি’ প্রেজেন্ট লিখে রেখেছে। সাথে সাথে এই আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা হলে সুপার নিজে তা কেটে দিলেন। এদিকে আশপাশের বাসা ও দোকানিদের কাছ থেকে নানা কথা আসতে শুরু করলো, আমাদের বাসার গেটের কাছে যে তেঁতুল গাছটি সেখানে দাঁড়িয়ে আজহার ও হুমায়ুন কবীরের সাথে আল বদররা কথা বলছিল, সামনের তিনতলা বিল্ডিংয়ের ভাড়াটে ভদ্রলোক উপর থেকে সব প্রত্যক্ষ করেছেন; এ দৃশ্য ঝাঁপ-ফেলা কয়েকজন দোকানিও ঝাঁপের ফোটা দিয়ে দেখেছেন; কিন্তু দূরত্বের জন্য কী কথাবার্তা হচ্ছিল তা আর বুঝতে পারেননি।
তবে এক পর্যায়ে আজহার তেঁতুল গাছে হাত ঠেস দিয়ে যখন কথা বলছিলেন তখন ওরা ডাক্তারের হাতের ডানায় রাইফেল দিয়ে বাড়ি মারে এবং মুখটা নাকি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সাথে সাথে কয়েকজন এসে সামনে, পেছনে রাইফেল তাক করে ওঁদের দু’জনকে তেঁতুল গাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জিপ গাড়িতে তোলে। সেই গাড়িতে নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারি লোকটি ছিল, সেই লোকই নাকি সে সময় দালালি করতো।
ডাক্তারের ও আমার আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বন্ধ সবাই ডাক্তারের খোজে যে যেখানে পারে হন্যে হয়ে চারদিকে বেরিয়ে পড়লেন, সময় কীভাবে গড়িয়ে যেতে লাগলো জানি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ডাক্তার ফিরে এলেন। কিন্তু না, সন্ধ্যা হলো, রাত হলো, গভীর রাত হলো, না ডাক্তারের ফেরার লক্ষণ দেখা গেল না। এরই মধ্যে আমার ইঞ্জিনিয়ার ভাই হাকিম হাউস থেকে আমাকে নিতে এসেছেন তার পরীবাগের বাসায় এবং আমাকে নিয়েও গেলেন। সারারাত আমি ডাক্তারের ফিরে আসার আশায় অপেক্ষা করলাম এক বুক অজানা আতঙ্ক, আশঙ্কা নিয়ে। বাসার কারো মুখে কথা ছিল না, ঘুম ছিল না কারো চোখে । কখন যেন ভোর হলো, ১৬ নভেম্বর ১৯৭১ সাল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আজহার ফিরে এলেন-প্রতীক্ষা, দুরু দুরু বুকে আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু হায়! এরই মধ্যে নিয়তির যা লিখন তা লেখা হয়ে গেছে, আমি জানি না। আমার ভাইবোনরা ১৬ নভেম্বর সকালেই জেনে গেছে চরম খবরটি। শুধু আমাকে জানানো হয়নি। ততোক্ষণে ড. আজহার ও ডা. হুমায়ুন কবীরের হাত-পা, চোখ বাধা, শুধু জাঙ্গিয়া পরা নিথর, নীরব তরতাজা দেহ দুটি নটরডেম কলেজের সামনের কালভার্টের নিচ থেকে তুলে ঠেলা গাড়িতে করে তাদেরই প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মার্গে এনে রাখা হয়েছে। আমাকে শুধু ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে। সকাল থেকেই ডাক্তারের ভাইবোন, আমার সব ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন একে একে এসে বাসা ভরে গেছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমি তখন শুধু থরথর করে কাঁপছি আর কাঁদছি ও বলছি, তোমরা কেউ কোনো কথা বলছে না কেন? আমার সামনে কেউ আসছে না কেন? সবাই আমাকে দেখে যেন লুকাচ্ছিলো। মুরব্বিারা কেউ কেউ ‘ছবর করো, ছবির করো’ বলছিলেন। আমি বলছিলাম, ‘কেন ছবর করবো? ছবর তো মানুষ মরে গেলে করতে বলে, তবে আমাকে কেন একথা বলা হচ্ছে?’ আমার শক্তি ছিল না কোনো কথা বলার, আমি যেন কেমন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। এই রকমভাবেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গেল। শেষে ইফতারের ও মাগরিবের কিছু আগে (সেদিন ছিল ২৭ রমজান, শবেকদরের রাত) আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে নিদারুণ, সবচেয়ে সত্যি কথাটি আমার বড় ননদ মনো আপা (মিসেস মনোয়ারা ইসলাম) শোনালেন, তাঁদের ভাই ‘শহীদ’ হয়ে গেছেন। মুহুর্তেই কানে এলো, ডেডবডি আমার একনজর দেখার জন্য নিচে সিড়ির গোড়ায় অপেক্ষায় আছে। স্পষ্ট কানে সব পৌঁছাচ্ছিলো না, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী হচ্ছে বা হয়েছে। মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরে চোখে কেমন যেন আঁধার দেখছিলাম, সবকিছু বোঝার আগেই দেখতে পেলাম আমাকে ধরাধরি করে দোতলার সিঁড়ির প্রান্তে আনা হলো, আমি উপর থেকে নিচে দেখলাম খাটিয়ায় শ্বেত-শুভ্র বসনে শায়িত সদা কর্মব্যস্ত, চঞ্চল, হাস্য-উৎফুল্ল মানুষটি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন।
আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হায়! কাছ থেকে আমাকে কেউ দেখতে দিল না, দূর থেকে এক ঝলক দেখিয়েই ওরা নিয়ে গেল, সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসছে, -কারফিউ হয়ে যেতে পারে। তাই তড়িঘড়ি করে ওরা আমাকে ভালো করে না দেখতে দিয়েই আজহারকে নিয়ে গেল, চিরদিনের মতো নিয়ে গেল-আমি শেষ দেখাটাও ভালো করে দেখতে পেলাম না। শুনেছি নরপশুর ডাক্তারকে কোনো গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল— এই কি সহ্য করা যায়? কী যন্ত্রণা, কী কষ্টই না দিয়ে ওঁর তরতাজা ৩১ বছরের জীবনটা বের করেছে। শেষ হয়ে গেল সব, ধূলিসাৎ হয়ে গেল আজহারের স্বপ্ন, কত কল্পনা ছিল, কত সাধ ছিল, বড় ডাক্তার হবে, আরও বড় হবে, আমাদের ছেলে হবে, সংসার হবে, কিন্তু সবকিছুই অসমাপ্ত থেকে গেল, অপূর্ণ রয়ে গেল, শুরু হলো আমার জীবনে অমানিশার অন্ধকার, ভবিষ্যৎহীন ভবিষ্যতের। ডাক্তার হারিয়ে যাওয়ার পর ভালো করে আমি কাঁদতেও পারিনি, বুকফাটা কান্না করারও উপায় ছিল না। ওয়াপদা কলোনি ভাইয়ের বাসার পাশেই ছিল শাহবাগ রোড, ঐ রাস্তা দিয়ে সারাক্ষণ অনবরত মিলিটারি জিপ আসা-যাওয়া করতো। আমার ভাই জোরে কান্না শুনলে বলতেন, ‘এখানে ডেডবডি আনা হয়েছিল তা অনেকেই জানে, আবার কান্নাকাটি শুনলে ওরা এসে আমাদের সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে।’ তাই শত দুঃখকষ্ট নিয়েই দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো, অবশেষে ঠিক একমাস পর এলো বিজয়ের সেই ১৬ ডিসেম্বর।
আসন্ন ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কায় নিরাপদ স্থানের জন্য আমরা পরীবাগ থেকে আমার ভাইয়ের সাথে ইস্কাটন গার্ডেনে দুলাভাইয়ের খালার বাসায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর যখন প্রথম আমি নিজ কানে দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম তখন আমার মনপ্রাণ তোলপাড় করে কান্নার ঢল নেমে এলো। সবচেয়ে বেশি প্রাণ খুলে ঐ সময় কাঁদলাম। তখনই আমি বেশি করে বুঝতে পারলাম ডাক্তার নেই। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিলো এই ভেবে- আমি মাত্র একটি মাসের জন্য ডাক্তারকে হারালাম, মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে দেশ স্বাধীন হলো, অথচ ডাক্তার দেখতে পেলো না। সবাই কত আনন্দ করছে, কিন্তু আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। স্বাধীনতা যদি আরো দেরি করে, অনেক দেরি করে আসতো তবে আমার কষ্টটা, জ্বালাটা বোধহয় কিছুটা লাঘব হতো। ১৮ ডিসেম্বর ইস্কাটন গার্ডেন থেকে আবার ভাইয়ের পরীবাগের বাসায় ফিরছিলাম, রাস্তায় দেখলাম, শুধু ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ি আর শুধু প্রাইভেট কার, পিক-আপ পেছনে গাদাগাদি করে মালপত্র নিয়ে গাড়িগুলো এদিক থেকে ওদিকে ছুটে চলেছে। আমি তখন অনুভব করলাম, এখন তো ফেরার পালা, সবাই এখন যার যার ঘরে, সংসারে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যাচ্ছি কোথায়? আমি তো আমার সংসারে ফিরে যেতে পারলাম না। এরপর স্বাধীনতার ঠিক এক মাস পর ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে আমাদের অতি আকাঙ্ক্ষিত একমাত্র সন্তান আশরাফুল হক নিশান রাত সাড়ে ৯টায় জন্মগ্রহণ করলো। ডাক্তারের হারিয়ে যাওয়ার ঠিক দুই মাস পর এলো ডাক্তার ও আমার সবচেয়ে আদরের ধন নিশান; কিন্তু ডাক্তারের ভাগ্যে তা আর দেখা হলো না। সেই আজন্ম এতিম নিশান অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
ডা. আজহারুল হক ১৯৪০ সালের ২ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম জহুরুল হক, মা মরহুমা ফাতেমা খাতুন। আদি বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায়। মাত্র দুই বছর বয়সেই আজহার পিতৃহারা হন। তাঁর বাবা ছিলেন ‘জেলার’। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে জেলার থাকার সময় ওখানেই তাঁর জন্ম হয়। সাত ভাই চার বোনের বৃহৎ সংসারে আজহারকে অত্যন্ত আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে। বড় ভাই আনোয়ারুল হকের কর্মস্থল নোয়াখালী, সিলেট, চিটাগাং, বরিশালসহ ঢাকাতে আজহারের স্কুলজীবন কেটেছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলায় ভীষণ মেতে থাকতেন, বিশেষ করে ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ভালো খেলোয়াড় হিসেবে তিনি বহু কাপ, মেডেল ও শিল্ড পেয়েছেন, যা আজও তার স্বাক্ষর বহন করে। খেলাধুলা ছাড়াও তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন এবং অভিনয়ও করতেন। স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। সিলেটে থাকার সময় তিনি বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। অত্যন্ত সহজ-সরল সাদাসিধে মানুষ ছিলেন তিনি।
তিনি এত বিনয়ী ছিলেন যে, কখনও কারো সাথে ‘আপনি’ ছাড়া ‘তুমি’ করে কোনোদিন কথা বলেননি। তাঁর কর্মস্থলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, আজও তাদের কারও কারও সাথে আমার দেখা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাকে স্মরণ করে। তিনি কোনো রিকশাওয়ালাকে পর্যন্ত ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন না। তিনি গরিব, দুঃখীদের জন্য বিনা পয়সায় এমনকি তাঁর পাওয়া সব ‘ফ্রি স্যাম্পল’ ওষুধগুলো বিলি করে দিতেন। বহু রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসী তাঁর ভক্ত ছিল। তাঁর লাশ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ১৬ নভেম্বর হাতিরপুলের বাসায় বহু বস্তির লোক, রিকশাওয়ালা, দিন-মজুর, বাসার কাজের লোক কাঁদতে কাঁদতে ভিড় জমিয়েছিল। ছোট-বড় সবার সাথেই তিনি অতি সহজেই মিশতে পারতেন, তার মিষ্টভাষার কথা আজও সবাই বলাবলি করেন। অত্যন্ত প্ৰাণোচ্ছল ও চঞ্চল প্রকৃতির এবং কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, ক্লান্ত হতে খুব একটা দেখিনি। গভীর রাত পর্যন্ত মেডিকেলের বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন-সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও। কারণ বিলেতে গিয়ে বড় ডিগ্রি আনার তার স্বল্প ছিল, টাকা-পয়সা উপার্জনের দিকে কোনো ঝোঁক ছিল না। একবার সৌদি আরবে তার চাকরি হওয়ার কথা হয়েছিল, কিন্তু তিনি লেখাপড়ার জন্য বিলেতে যাওয়ার ব্যাঘাত ঘটবে বলে যাননি। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন তিনি। সার্জারিতে তাঁর খুব ভালো হাত ছিল। তিনি গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন। দেশি খাবারই তাঁর পছন্দ ছিল, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস প্রিয় খাবার।
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ