আ মা র স্বা মী
শহীদ ডা. অমলেন্দু দাক্ষী
শোভারাণী দাক্ষী
সেদিন ছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল শুক্রবার। পাবনা শহর থমথমে। সন্ধ্যার দিকে প্রগতিশীল আন্দোলনের কয়েকজন নেতা আলাপ-আলোচনায় বসলেন শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি দোকানে। নতুন ব্রিজ সংলগ্ন ট্রাফিক মোড়ের সম্মুখে একটি ডাক্তারের দোকান; দোকানের মালিক ডা. অমলেন্দু দাক্ষী। চললো আলোচনা। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় শেষ হলো সভা। শহরে লোকজন কম। দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে ফিরলেন ডাক্তার বাবু।
ট্রাফিক মোড়ের দোকান থেকে পাথরতলার (দিলালপুর) চারতলা ভবন। এ বাড়িরই নিচতলায় ভাড়া থাকেন পাবনার খ্যাতিমান দন্ত চিকিৎসক, আমার স্বামী ডা. অমলেন্দু দাক্ষী। পোশাক বদলিয়ে লুঙ্গি পরলেন ডাক্তার। খালি গায়েই খেতে বসলেন তিনি। রাত প্রায় ৯টা। ছেলে অসিতকরণ, মেয়ে শিখা আর ছুটকা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে একটু আগেই। আমি বসে আছি খাবার টেবিলেই। তাঁর সঙ্গে খাবার টেবিলে ওই আমার শেষ বাসা। এমন সময় বাইরে জিপের শব্দ। তারপর বুটের আওয়াজ। সচকিত হলেন ডাক্তার। বুটের শব্দ আরো এগিয়ে এলো। মুখের ভাত মুখে রেখেই শুনছেন তিনি। চিবোতে পারছেন না। দাঁতগুলো যেন স্থবির হয়ে আসছে ডেন্টিস্টের। দরজায় অনবরত লাথির শব্দ… । বুটের লাথি। আমি এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। তার আগেই পূব পাশের দেয়াল ভেঙে ফেলেছে পাকসেনারা / ঘরে ঢুকে পড়েছে চার-পাঁচজন।
-দাক্ষী কোন হ্যাঁয়?
আমি। নিজেকে দেখালেন ডাক্তার বাবু।
-শালে শুয়ার কা বাচ্চা, তুমি শুনা নেহি, ম্যায় তুমকো বুলাতা হ্যায়? চুপ থাকলেন ডাক্তার বাবু। পেছন থেকে একজন এসে লাথি মারলো ভাতের থালায়। সামনের সেনাটি কষে এক চড় মারলো ডাক্তারের গালে। মাথা নিচু করে সহ্য করলেন ডাক্তার। এবার যেন আদেশ পেয়ে গেল অন্য সেনারা। শুরু হলো কিল…লাথি। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী। চিৎকার করে ছুটে এলাম আমি। ছুটে এলো ছেলেমেয়েরা। সবাই মিলে জড়িয়ে ধরলাম ডাক্তারকে। একেবারে আড়াল করে। যেমন আড়াল করে রাখে তা-দেয়া মুরগি তার ছানাদের। রাইফেলের বাট উঁচু করলেন একজন সেনা। ঝন ঝন শব্দে খান খান হয়ে গেল কাঁচের আলমারি। শকুনের মতো হাতের থাবায় আঁকড়ে ধরলো কচি কচি ছেলেমেয়েদের ডানা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হলো তাদের। হাত ধরে টেনে তোলা হলো ডাক্তারকে। তারপর বের করার জন্য দরজার দিকে ধাক্কা। ছুটে এগিয়ে গেলাম আমি। পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো একজন। তারপর সজোরে লাথি। চিৎকার দিয়ে বসে পড়লাম আমি। বের করে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারকে। আমার হঠাৎ মনে হলো উনি খালি গায়ে রয়েছেন। তাড়াতাড়ি উঠে কিছুক্ষণ আগেই খুলে রাখা জামা-গেঞ্জি নিয়ে জড়ো করে ছুড়ে দিলাম।
সে গাড়িতেই ছিলেন আমিনুদ্দিন সাহেব। পাবনা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান, বিচক্ষণ আইনজীবী, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন সাহেবের একি অবস্থা! চোখে-মুখে বিষন্নতা। তবে কি তারও একই অবস্থা! জামা-গেঞ্জি দুটিই পরে নিলেন তিনি। গাড়িতে খানসেনাদের সাথে আরো ক’জন উঠে বসলো। ওরা সবাই এ শহরের বাসিন্দা। ডাক্তার এদের চেনেন। এরাও চেনে ডাক্তারকে, চেনে শহরের সব নেতৃবৃন্দের বাড়িঘর, দােকানপাট, রাস্তাঘাট সবকিছু। পেশায় ওরা সবাই পাহারাদার। পশ্চিম পাকিস্তানি। কেউ বেলুচি, কেউ পাঠান। অথচ এ দেশের জল-হাওয়া, মানুষের ভালোবাসা এসবই ধরে রেখেছিল তাদের । তাই গভীর বিশ্বাস নিয়েই শহরের মানুষ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল প্রহরীর দায়িত্ব; কিন্তু এই কি সেই দায়িত্ববোধের নমুনা? এই কি সেই বিশ্বস্ততার পরিচয়? গোটা শহরের দায়িত্ব ওদের হাতে তুলে দিয়ে সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, ওরা তখন বিশ্বাসঘাতক সেজে একের পর এক ধরিয়ে দিচ্ছে রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবীদের।
আমার পরম পূজনীয় শ্বশুর পাৰ্বতীচরণ দাক্ষী ছিলেন রাজশাহী শহরের একজন বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক। তাঁর আগ্রহেই আমার স্বামী বেছে নিয়েছিলেন এই পেশা। তারপর ১৯৫৪ সালে রাজশাহী ছেড়ে সবাই চলে আসেন পাবনা। ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতো তাকে। তাই পাবনা এসে পিতার পেশা আঁকড়ে ধরলেও রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেননি তিনি। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব ও ‘ন্যাপ’-এর প্রতি ছিল তার সীমাহীন শ্রদ্ধা। ১৯৫৮ সালে মার্শল ল’ জারি করে ক্ষমতায় এলো আইয়ুব খান। গ্রেফতার করা হলো রাজনীতিবিদদের। গ্রেফতার হলেন তিনিও। থাকলেন রাজশাহী কারাগারে। মুক্ত হলেন বেশ কিছুদিন পর। ১৯৬৪ সালে এলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। তিনি সক্রিয় হলেন দাঙ্গা প্রতিরোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। অনেক ব্যক্তিকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে, দাঙ্গবিরোধী সাহস দিয়ে তিনি সর্বস্তরে হয়েছিলেন প্ৰশংসাভাজন। তাই ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পুনর্বার গ্রেফতার হলেন তিনি ৬ সেপ্টেম্বর। প্রায় এক বছর জেলে থাকার পর আবার ফিরে আসেন পাবনায়। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলো। ভাসানী গ্রুপের সমর্থক হিসেবেই থেকে গেলেন তিনি। রাজনীতির সমর্থক হলেও তিনি কখনোই প্রকাশ্যে মিছিল কিংবা সভা করেননি এর আগে। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হলে ঐ দিনই পাবনায় তার প্রতিবাদ মিছিল হয়। সে মিছিলে তিনিও অংশ নেন। প্রগতিশীল সকল রাজনীতিবিদের প্রতিই তার ছিল সমান ভালোবাসা। এর মধ্যে শ্ৰী রণেশ মৈত্র, জনাব আনোয়ারুল হক, বাবু প্ৰসাদ রায়, জনাব টিপু বিশ্বাস ও জনাব আনসারুল ইসলাম ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ । এমনিভাবে রাজনীতিতে সরাসরি না থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেমিক। বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের আশ্রয় দিয়ে, অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি। আর তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বার্থবাদী মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি। হয়েছেন ছুরিকাহত।
পাকিস্তানি নরপশুরা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পর এবং শ্মশানে মরদেহ আনার আগে আমার কোনো স্মৃতি নেই। তাঁর সঙ্গে আমার সমস্ত স্মৃতি আমাদের বিবাহিত জীবনকে ঘিরে; যেখানে তিনি একজন আদর্শ স্বামী, স্নেহময় পিতা, দয়ার্দ্র চিকিৎসক, সচেতন দেশপ্রেমিক। আর্তমানবতার সেবায় তিনি সময়-অসমীয় নেই ছুটে গেছেন সংসার ও পরিবার উপেক্ষা করে, সেখানে কোনো ক্ষুদ্র প্রয়োজন তাকে আটকে রাখতে পারেনি। তার সেইসব স্মৃতি অবলম্বন করেই আমার বেঁচে থাকা ।
তবে হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া একজন জনাব খালেক তালুকদার মারফত যা জেনেছি তাতে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটা অনুমান করতে পারি। প্রথমে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে তাঁকে নিয়ে গিয়ে
অমানুষিক নির্যাতন চালায় ২৮ মার্চ রাত ৮টা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে সদ্য গঠিত মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে প্রায় ৩০ জন সঙ্গীর মৃতদেহ ফেলে পাক হানাদাররা আশ্ৰয় নেয় বিসিক শিল্প নগরীতে। আমার স্বামীকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছিলেন পূর্বোল্লিখিত আমিনুদ্দিন সাহেব ছাড়াও সাঈদ তালুকদার সাহেব, খালেক তালুকদার সাহেব ও রামেজ পাগল। মাঝে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে, এর মধ্যে কোনো খাবার নেই, এমনকি জলও নেই। আমিনুদ্দিন সাহেবই তাঁর বরাদ্দ জল থেকে প্রথম জল খাওয়ান। ২৯ মার্চে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিসিক শিল্পনগরী আক্রমণ করলে পরাজয় আসন্ন জেনে পাক মেজর সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে এবং সবাইকে এক দাঁড়িতে বেঁধে টেনে-হেঁচড়ে একটা ট্রেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। আহত খালেক তালুকদার বেঁচে যান অলৌকিকভাবে। তাঁর কথা থেকেই মনে হয়, মৃত্যুত আগে তিনি ও সহবন্দিরা যে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তা কি মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? আমার বিবাহিত জীবনের স্মৃতি ও তাঁর মৃত্যুকালীন অদৃশ্য স্মৃতি মাঝে মধ্যে কোনোটাই আমি কোনো বোধে আনতে পারি না।
*(রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার;
প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য
মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১, জুন ১৯৮৪; ৮ম খন্ড; পৃ.
৭০৭।
গ. *স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় খন্ড; ২য় পুনর্মুদ্রণ,
প্রকাশকালঃ শ্রাবন ১৪০৯, আগস্ট ২০০২; পৃ. ১৩৬ ।
ঘ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনা; রক্তক্ষন;
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৮৮ ।
ঙ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক
মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৮; পৃ. ৪৩ ।
চ. একাত্তরের বধ্যভূমী ও গণকবর; সম্পাদনাঃ সুকুমার বিশ্বাসঃ অনুপম প্রকাশনী; প্রকাশকাল;
ফেব্রুয়ারি ২০০০; পৃ. ৪৯২ ।
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ