You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.17 | চরমপত্র ১৭ জুলাই ১৯৭১ | এম আর আখতার মুকুল - সংগ্রামের নোটবুক

আইজ একটা ছােট্ট কাহিনীর কথা মনে পড়ে গেল। আমাগাে বকশী বাজারের ছক্কু মিয়া আর কাপ্তান বাজারের কালু মিয়া মাঝে মাঝে হেই জিনিষ খাইতাে। মানে কিনা হেগাে একটু গাঞ্জা খাওনের অভ্যাস আছিল। একদিন রথখােলায় তাজ হােটেলের বগলের গাঞ্জার দোকানে যাইয়া দ্যাহে কি, Strike.দোকানের মালিকরা Strike করছে। কালু আর ছক্কু দোকানের জানালার গন্ধ হােঙ্গনের পর মাল খাওনের লাইগ্যা অক্কর কুলবুল কইরা উঠলাে। অহন উপায়? গাঁঞ্জা পায় কই? ছক্কর মাথায় মাইদ্দে আঙ্কা একটা জব্বর প্ল্যান আইলাে। নবাবপুর দিয়া এত লােক যাইতাছে- কারু না কারু পকেটে মাল থাকবােই থাকবাে। দুই জনে মিলা নবাবপুরের রাস্তার দুই মুড়া বইলাে। হেরপর বইয়্যা বইয়্য হাতের তাউল্যা দুইডারে এমনভাবে ঘষতে শুরু করলাে যাতে মনে হয়। যেনাে দুইজনে মিইল্যা একটা দড়ি পাকাইতাছে। আসলে কিন্তুক পুরা ব্যাপারটাই False. রিকসা, ঠেলাগাড়ি, মােটর, বেবি ট্যাসি, বাস সব কিছু হেগাে চোখের সামনে দিয়া চইল্যা যাইতাছে; আর যাইতাছে পায়ে হাইট্ট্যা হাজারে হাজারে মানুষ। আধা ঘণ্টা ধইরা দুইজনে রাস্তার দুইমুড়া বইয়্যা এই রকম False দড়ি বানানাের Acting করণের পর দ্যাহে কি একজন গোঁফওলা আর খাকী সার্ট প্যান্টুল পিন্দুইন্যা লােক আঙ্কা হেই জায়গায় আইস্যা থামলাে। ব্যাড়ায় মাথা ঘুরাইয়া রাস্তার দুই মুড়া ছকু আর কালুর দিকে Angle কইর‍্যা তেরছি নজর মারলাে। তারপর রাস্তার মাইদ্দে এমনভবে ঠ্যাং উড়াইয়া ডিঙ্গাইলাে, যেমন মনে লয় হেইখানে হচাহাঁচিই একটা দড়ি রইছে। কেমন বুঝতাছেন?

তারপর ব্যাডায় হেই দড়িডা ডিঙ্গাইয়্যা গেলাে গা। ছক্কু লাফাইয়া উডড্যা কইলাে, ‘আবে এই কালু, পাইছিরে পাইছি- দৌড়। দুইজন যাইয়া রায় সাহেব বাজারের মুখে ব্যাডারে পাকড়াইলাে।

ব্যাডায় একটু মুচকি হাইস্যা কইলাে, ‘কেইসটা কি? মাল Short পড়ছেনি” ছক্কুমিয়া বাইশ হাজার টাকা দামের একটা হাসি দিয়া কইলাে, কি কইলেন Short? অক্করে ধলী- কিছুই নাইক্যা।

জবাব আইল,- এই রকম কুফা অবস্থা হইলে লগে আইতে পারেন। কিন্তুক একটা কথা। এতাে লােকের মাইদ্দে আমারে চিনলেন ক্যাতে?

সেনাপতি ইয়াহিয়া, থুক্কু ছক্কু মিয়া ব্যাডারে অক্করে জড়াইয়া ধইরা কইলাে, ‘হেই যে রখথােলার মুহে আপনে দড়ি ডিঙ্গাইলেন, লগে লগে বুঝলাম এইডা আমার মামু না হইয়া যায় না। মা-আ-মু এলায় মাল দেন।

‘দিমু, দিমু, আমারে যহন চিনছস্, তহন মাল পাইবি। অহন বুঝছেন, ইয়াহিয়া আর টিক্কা সাবে মামুর খোঁজ ক্যামতে পাইছে? হ-অ-অ-অ। এইদিকে কাম সারা- আন্ধার। ঢাকা শহর অন্ধ-কা-র। মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছুর লাহাল পােলাগুলা সেনাপতি ইয়াহিয়ার নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল মুজাফফর হাসানরে ওয়েলকাম করছে। ব্যাডায় তেজগাঁয় প্লেনের থনে নাইম্যাই দ্যহে দুনিয়া আন্ধার। কেইসটা কি? এসােসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকা ঢাকার থনে নিউজ পাড়াইছে, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকা শহর আর শহরতলী এলাকার তিন তিনডা Power station ছাতু বানাইছে। এই তিন জায়গায় এক লগে কারবার হইছে। এক এক জায়গায় বিচ্ছুগুলা ঢােকনের লগে লগে গার্ডগুলা সব কিছু ফালাইয়া দৌড় রে দৌড়!

হেরপর খাতির জমা কইর‍্যা ঘেডাঘ্যাড়, ঘেডাঘ্যাড়, ঘেডাঘ্যাড়। তিয়াত্তর মেগাওয়াট পাওয়ারের ও চল্লিশ মেগাওয়াট পাওয়ার বু-ই-ত্যা গেল গা। ষােল ঘণ্টা পরেও এইগুলাে মেরামত করণ যায় নাই। এই রকম একটা অবস্থায় ভাইস-এডমিরাল মুজাফফর হাসান ঢাকায় তশূরিফ আনছেন।

পহেলায় জেনারেল নিয়াজী সা’বরে জিগাইলাে, আমাগাে Best সােলজারগাে খবর কি? নিয়াজী সা’বের বগলের ব্যাটনটা মাটিতে পইড়্যা গ্যালাে। গলার মাইদ্দে একটা খ্যাক্রানী দিয়া কইলাে, ‘আইজ-কাইল জোনাকী পােকার লগে আমাগাে সােলজাররা তুফান পাইট করতাছে। হাসান সা’বে জিগাইলাে, এইটা কেমন কথা? জোনাকী? সেইডা আবার কি জিনিষ?’ নিয়াজী ভেউ ভেউ কইর‍্যা কাইন্দ্যা ভরাইলাে। তারপর রুমালে আঁসু মুইছা কইলাে, বঙ্গাল মুলু চেঁ যাদু হ্যায়। হিয়া রাতমে এক কিসিমকা কিড়া উড়তা হ্যায়। আওর হামারা জোয়ান লােগ উস্ কিডাকা উপর গুলি চালা রহা হ্যায়। ইয়ে সব কিড়াকো দেহাতী তােক জোনাকী বা হ্যায়। আজিব চীজ হ্যায়। ইয়ে সব জোনাকী কো Back Side মে আগ জ্বলতা হ্যায়। হাসান সা’বে বুঝলাে Worldএর Best সােলজারগাে টাইম হইয়্য গ্যাছেগা। তবুও Position টা ঠিক মতন ঠাহর করনের লাইগ্যা জিগাইলাে, আমাগাে সােলজাররা আর কি কি করতাছে? ফটু কইর‍্যা রাও ফরমান আলী মুখ খুললাে, যেগুলা বাঁইচ্যা আছে হেইগুলা- না যেগুলা হুইত্যা আছে হেইগুলা?’

মুজাফফর হাসান তাে রাইগ্যা টং। হােতনের গুলাতে খরচের খাতায়। যেইগুলা জিন্দা হেইগুলার কথা জিগাইতাছি। অ-অ-অ বুঝছি ‘হেইগুলা পাট গাছ কাড়তাছে।’ ‘তা হইলে তাে ভালাে কামই করতাছে- আমরা এই পাট Export কইর‍্যা কিছু Foreign Exchange পামু- তাই না?

না , স্যার, পাট ঠিক মতন বাত্তি হওনের আগেই কাড়ছে। কত কষ্ট কইরা পাবলিকরে ভােগা মাইরা আনা দুই ক্ষেতের মাইদ্দে পাট বুনাইছিলাম। অহন দেখতাছি হেইসব পাটক্ষেতের মাইদ্দে বিচ্ছুগুলা বইয়্যা আমাগাে জোয়ানগুলারে কতল করতাছে। তাই ছিক্রেট Order-এ সেলজারগাে দিয়া পাট গাছ কাডাইতাছি। না হইলে হাওয়ার চোটে পাট গাছের আগাটা একটুক লইড়া উড়লেই আমাগাে জোয়ানরা বেশুমার Firing করতাছে। 

আর এইদিকে ঢাকা টাউনে মাইদ্দে শুরু হইছে বােমা। সন্ধ্যা লাগলেই খালি বােমা আর গুলির আওয়াজ। দিনের বেলায় শুরু হইছে লেমা-আতংক। রাস্তাঘাট, অফিসআদালত, পেট্রোল পাম্প এইসব জায়গায় কাগজের দলা দেখলেই পুলিশ-সােলজার হগুগলেই খালি ‘বােমা’, ‘বােমা কইর‍্যা চিল্লাইতাছে। হেইদিন ঢাকার রেডিও গায়েবী আওয়াজ অফিসে একটা কাগজের দলা দেইখ্যা একজন মেলেটারি গার্ড খালি একবার কইলাে, ইসকো বােমা মালুম হােতা হ্যায়।’ ব্যস্-আর যায় কোথায়? কয়েক মিনিটের মাইদ্দে সব ভাগােয়াট। আর পশ্চিম পাকিস্তানী সােলজাররা একজন বাঙালি পিওনরে ধমকাইয়া হেই কাগজের দলাডা সরাইতে কইলাে। হেই বাঙালি পিওন পেছনে বেয়নেট দেইখ্যা কাগজের দলাডা ধরলাে আর ধরনের পরই হাইস্যা ফ্যালাইলাে। মােডা মােডা মােছওয়ালা সােলজাররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাে। এলায় বুঝছেন? বােমার আতংক কারে কয়?

কিন্তুক এইডা কি শুনতাছি। দেশী দালালগাে রাস্তাঘাটে দেখলেই রিকশাওয়ালারাও ব্যাডার লাহাল কইতাছে, ‘ঠিকভাবে শ্যাষ খাওয়া দাওয়াটা কইর‍্যা লন। আপনাগাে হেই টাইম আইস্যা গ্যাছে। আর এইদিকে কে বা কাহারা এই সকল দালালদিগের বসত বাটিতে আতর লােবান এবং সাবান ইত্যাদি পৌছাইয়া দিতাছে। আবার কেহ কেহ মনি অর্ডার যােগে দশ টাকা পাইতেছেন। মরণের আগে শ্যাষ খাওনের দশ টাকা। ক্যামন বুঝতাছেন? আমাগাে গােপালগঞ্জের ঠাণ্ডা মিয়া নাকি মনি অর্ডার পিওন দেখলেই কান্দতে শুরু করেন। কখনাে জোরে- আবার কখনাে ফেঁপাইয়া কান্দতে থাকেন। এলায় বুঝছেন, কেইসটা কি?