বাংলাদেশ যুদ্ধ
কুলদীপ নায়ার
কুলদীপ নায়ার ১৯৭১১ সালে কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সমরবিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে। কলাম লিখতেন। তিনি একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কলাম লেখক। তাঁর জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯২৩। কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বিয়ন্ড। দ্য লাইনস (রলি বুকস প্রাইভেট লিমিটেড, নয়াদিল্লি ও ডেইলি স্টার বুকস, ঢাকা, ২০১২)। এ গ্রন্থের ‘দ্য বাংলাদেশ ওয়ার’ অধ্যায়ে তিনি বাংলাদেশের। স্বাধীনতাযুদ্ধের বর্ণনা দেন। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে কুলদীপ নায়ারের ভাষ্যের কিছু অংশ তুলে ধরা হলাে।
ভারতের সমস্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের আগমন। তাদের এক মিলিয়ন (যুদ্ধের শেষের দিকে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় দশ মিলিয়নে উন্নীত হয়, যাদের অধিকাংশ হিন্দু এবং কিছু মুসলমান। আসে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য। এতে ব্যাপক ভিত্তিতে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করতে হয়। একই সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য প্রাথমিক সংগ্রামও শুরু হয়।
ব্যাপক শরণার্থী আগমনের ফলে ভারত যে গুরুভার বহন করছিল, তা অন্য দেশগুলােকে অবহিত করতে ইন্দিরা গান্ধী প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিপীড়নের দরুন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করা যে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল; তিনি তা-ও বিশ্ববাসীকে ব্যাখ্যা করেন।
ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো তাঁদের বিবেচনায় পাকিস্তানকে বিভক্ত করার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হন। মুজিবকে গ্রেপ্তার ও তার দল আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করা হয়।
পৃষ্ঠা: ২৮০
এবং পূর্ব পাকিস্তানে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, যদিও (২৬ মার্চ ১৯৭১) তারা নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করেছে।
ইসলামাবাদের সামরিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে পরিণত হয়। ভারতের দিকে বয়ে চলা শরণার্থীদের ক্ষীণ ধারা ক্রমেই প্রবলপ্রবাহের রূপ নেয়। নয়াদিল্লি সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করে (শরণ সিং বারবার এ জন্য চাপ প্রয়ােগ করেন)। কিন্তু প্রস্তাবটি ভারতীয় নীতির পরিপন্থী হওয়ার যুক্তিতে তা প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং সমগােত্রীয় লোকদের জন্য তার দ্বার রুদ্ধ করা হতাে অমানবিক। এমনকি নেহরুও’ এ বিষয়ে বিশেষ অবস্থান নিয়েছিলেন: “যদি আমাদের কাছে নিরাপত্তা বিধানের জন্য কোনাে আবেদন আসে, বিশেষ করে তা যদি মৃত্যুভয় বা তার চেয়ে খারাপ কিছুর জন্য শঙ্কিত নারী বা শিশুদের কাছ থেকে আসে, তবে তাদের জন্য কিছু না করে নির্বিকার থাকা কঠিন এবং শেষ পর্যন্ত অসম্ভব।
ওই সময় ভারত একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত আমাকে এমনই জানান, যখন স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ঢাকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সিদ্ধান্তটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে সমর্থন জানানো এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনে সাহায্য করা। এর ফলে সেদিক থেকে ভারতকে অন্য কোনাে শক্তির আক্রমণ না করার নিশ্চয়তা থাকবে। ওই দেশে বসবাসরত এক কোটি হিন্দুর ব্যাপারে সুবিমল দত্ত বলেন, তাদের নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। নয়াদিল্লির আনুমান ছিল, তাদের অনেকেই ভারতের স্থায়ী অভিবাসী হতে। পারে, কিছুসংখ্যক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারে এবং কিছু বাংলাদেশের। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন ধারণ করবে। নিষ্ঠুর হলেও এটাই ছিল যুক্তি।
নয়াদিল্লি বাংলাদেশের গেরিলাযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণদান ও অস্ত্র জোগানাের মাধ্যমে সাহায্য দিতে শুরু করে। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে কিছু নাগা ও মিজো বিদ্রোহ করার সময় যেমনটি পাকিস্তান করেছিল। সামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বাধীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গেরিলাদের প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে এবং ভারতের পাঠানকোট বিমানবন্দরে বােমাবর্ষণ করে সব বিমান ধ্বংস করে দেয়, এটা ভারতের জন্য স্বস্তির ব্যাপার হলাে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছিল একটি বিভক্ত প্রতিষ্ঠান। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের অবসান চেয়েছিলেন বলে গুজব রটে। কিন্তু তিনি ছিলেন কার্যত তার সহায়তাকারীদের। হাতে বন্দী। ভারতীয় সেনাবাহিনীও তখন পর্যন্ত একটি সুসংঘবদ্ধ শক্তি ছিল।
পৃষ্ঠা: ২৮১
না। যাহােক, সামরিক অভিযান শুরুর আগে তিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ, এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল এবং অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ সভায় মিলিত হয়ে মানেকশকে সর্বাধিনায়ক করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সভার কার্যবিবরণীতে নন্দ বলেন যে মতবিরােধ যা-ই থাকুক না কেন, সভাকক্ষের চারদেয়ালের অভ্যন্তরেই সেগুলাে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
পাঠানকোট আক্রমণ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করার মুহূর্তে তার প্রতিক্রিয়া ছিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করেছে। ভারত ইত্যবসরে প্রস্তুত হয়ে গেছে।
বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম পােতাশ্রয় এবং ঢাকা বিমানবন্দরে বােমাবর্ষণ করে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। সমুদ্রপথে অবরােধ সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তাদানের সব ধরনের পথ। বন্ধ এবং তাদের পালিয়ে যাওয়ারও পথ রুদ্ধ করা হয়।
নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে, তারা পাকিস্তানকে কেবল নিজেদের জলসীমায় নয়, করাচিতে তাদের নৌঘাঁটিতেই অবরুদ্ধ করে রাখে। এতে এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যে পাকিস্তানিরা ভারতীয় জাহাজ মনে করে নিজেরাই নিজেদের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। আমার প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে জানায় যে পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে জরুরি সাহায্য চেয়ে প্রেরিত বেতার বার্তাটি (এসওএস) যে শাখায় গ্রহণ করা হয়, তার প্রধান ছিলেন। জনৈক বাঙালি কর্মকর্তা। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যবশত তিনি বার্তাটি চেপে যান। করাচির তেল স্থাপনাগুলােতে বােমাবর্ষণ করা হয়। তিন মাস পর আমি যখন বন্দরটি পরিদর্শন করি, তখন সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ দেখতে পাই।। শুরুতে ভারতের পরিকল্পনা ছিল সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানের তৈরি অবস্থানসমূহ এড়িয়ে মেঘনা ও পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকা পৌছানাে। সামরিক অভিযানের পর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব আমাকে তা জানান। তবে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরবক্স সিং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, প্রারম্ভিক পর্বের অভিযান পরিচালনায় ঢাকাকে প্রধান লক্ষ্যবস্তুরূপে বিবেচনা করা হয়নি। তার অনুযােগ হলাে,। সামরিক গুরুত্বহীন উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলাে দখল করতে খুব বেশি সময়ের অপচয় করা হয়।
পাকিস্তান প্রথম ভেবেছিল যে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সীমান্তবর্তী একচিলতে এলাকা দখল করাই হবে ভারতের লক্ষ্য। অবশ্য প্রাথমিকভাবে এটাই ছিল নয়াদিল্লির পরিকল্পনা। শরণ সিং বারবার ৫০ মাইলের একটি বেষ্টনী সৃষ্টির ইঙ্গিত দেন। স্থায়ী সমাধান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সেখানে
পৃষ্ঠা: ২৮২
জাতিসংঘের আনুকূল্যে শরণার্থীদের অস্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতে সম্মত হয়নি।
আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তান ভেবেছিল যে ভারত সীমিত অভিযান চালানাের পরিকল্পনা করেছে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি বড় ধরনের ভারতীয় আক্রমণ আশঙ্কা করেননি। তিনি ধারণা করেছিলেন, ভারতের প্রচেষ্টা হবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক টুকরা ভূখণ্ড দখল করা। তিনি ব্যাখ্যা করেন, তাঁর প্রাথমিক সেনাসমাবেশ এবং সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পেছনে সেটাই ছিল যুক্তি। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী সুরক্ষিত যশাের শহরের পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঢাকা অভিমুখে এগােতে থাকায় পাকিস্তান বুঝতে পারে যে শুধু কিছু ভূখণ্ড দখল করার আদৌ কোনাে পরিকল্পনা যদি থেকেও থাকে, তা পরিত্যক্ত হয়েছে। ততক্ষণে সমরকৌশল পরিবর্তন করার বিষয়ে পাকিস্তানের অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। ভারতীয় সৈন্যরা ত্বরিতগতিতে ঢাকা অভিমুখে এগােতে থাকে এবং পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অবিলম্বে তাদের সংযােগ স্থাপিত হয়।
ভারত সরকার প্রতিদিন যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রকাশ করছিল। আমি তা টুকে নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরবক্স সিংয়ের কাছে ছুটে যেতাম। তিনি সামরিক কার্যক্রমসমূহ ও ওইগুলাের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতেন। দৈনিক স্টেটসম্যান-এর প্রথম পাতায় ‘একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ’ শিরােনামে আমি প্রতিদিন কলাম লেখা শুরু করলাম। অশােক মেহতা ওই সামরিক বিশেষজ্ঞের নাম জানতে চেয়ে আমাকে ফোন করেন। কলাম লেখক আমিই সেই বিশেষজ্ঞ, এটা তাকে বললে তিনি কিছুটা হতাশ হন।
মস্কোর মাধ্যমে নয়াদিল্লি জ্ঞাত হয় যে ওয়াশিংটন বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হতে পারে। দীর্ঘ পশ্চাদপসরণের পর সেখানে তারা সমবেত হবে। জেনারেল মানেকশ এক বেতার বক্তৃতায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক করে বলেন যে তাদের পালানাের কোনাে পথ নেই। কারণ, পালানাের সব পথই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আত্মসমর্পণ করাই তাদের জন্য ভালাে হবে। একজন। সৈনিক হিসেবে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে তাদের সঙ্গে সহৃদয় আচরণ করা হবে। ওই সময় ইন্টারসেপ্ট করা এক বার্তা থেকে জানা যায়, উপসামরিক আইন প্রশাসক রাও ফরমান আলীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে জেনারেল নিয়াজি পলায়ন করেছেন। তবে এর কোনাে সত্যতা ছিল না। নিয়াজির পালানাের সুযােগ করে দিতে বার্তাটি সাজানাে হয়েছিল, তবে তাতে কোনাে কাজ হয়নি।
পৃষ্ঠা: ২৮৩
ভারত ঢাকার চারদিকে পাতা ফাঁস এঁটে দিতে শুরু করলেও দেখা যায় যে এতে দীর্ঘ সময় লাগছে। খুব বেশি পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করছিল না। মনে হলাে, তারা ঢাকার চারপাশে চূড়ান্ত অবস্থান নেওয়ার প্রচেষ্টায় পরিকল্পনামাফিক সরে যাচ্ছিল। অভিযানের শেষের দিকে ভারতীয় সৈন্যদের ধীরগতি মস্কোকে উদ্বিগ্ন করে। বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি ভিয়েতনাম হােক, এটা তারা চায়নি। সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলি কুজনেৎসভ অতি দ্রুত দিল্লি আসেন। তবে অচিরেই তাঁর দৃঢ় ধারণা জন্মে যে। বাংলাদেশের জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি সেনাদের মনােবল ভেঙে গিয়েছে এবং তাদের আত্মসমর্পণ মাত্র তিন কি চার দিনের ব্যাপার।
পাকিস্তান অস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে। ওয়াশিংটন গুরুত্বের সঙ্গে অনুরােধটি বিবেচনা করে এবং পাকিস্তানি বন্দরগুলােতে ভারতের অবরােধ সত্ত্বেও অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার উপায় নিয়ে ভাবতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র সাড়া দেবে কি না, প্রতিনিধিরা এ প্রশ্ন করায় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রেস সচিব সাদামাটাভাবে বলেন, কোনাে সংবাদ নেই। এই সন্দেহজনক জবাব ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে বলে তাঁর আগেকার বিবৃতির বিপরীত।
ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে সহায়তা দিতে ১৯৬৪ সালে সম্পাদিত যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যকার পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তির সাহায্য নেওয়ার চিন্তা করে। ইন্দিরা গান্ধী প্রথম সুযােগেই এক সভায় যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি কোনাে কোনাে দেশ আমাদের ভীতি প্রদর্শনের প্রচেষ্টায়। রত। এমনকি বলছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের কতকগুলাে চুক্তি রয়েছে। আগে আমি এটা জানতাম না। কারণ, চুক্তিতে যা-ই থাকুক না কেন, আমি যদুর জানি, তা করা হয়েছে কমিউনিজমবিরােধী চুক্তি হিসেবে। তা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনাে চুক্তি নয়। সেটি ন্যায়পরায়ণতার কণ্ঠস্বরবিরােধীও নয়, গরিবদের ধ্বংস করার জন্যও নয়। যদি তা-ই হয়, তবে তারা বিশ্বকে এক মস্ত মিথ্যা কথা বলেছে।
নিক্সন প্রথমে ভারতকে একটি সতর্কীকরণ’ বার্তা পাঠান। অতঃপর পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ’-এর নেতৃত্বে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। মস্কো থেকে প্রথম এ তথ্য আসে। উত্তর ভিয়েতনাম উপকূলের দূরবর্তী টনকিন উপসাগরে। অবস্থিত সপ্তম নৌবহর থেকে পাঠানাে এক বেতার বার্তা ইন্টারসেপ্ট করে। তারা তথ্যটি জানতে পারে। ওয়াশিংটনের ভারতীয় দূতাবাসও শিগগিরই এটা নিশ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর জনৈক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভারতীয়
পৃষ্ঠা: ২৮৪
দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে অনিচ্ছাকৃতভাবে এ তথ্য ফাঁস করেন। ওই সময় নয়াদিল্লিতে এক আরব কূটনীতিকের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার দেখা হয়। তিনি আমেরিকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সমর্থন করে সপ্তম নৌবহরের ভারত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা প্রকাশ্যেই জানান।
জাতিসংঘে অবস্থানরত শরণ সিং নয়াদিল্লিতে টেলিফোন করে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে বলেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে বলে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তৎসত্ত্বেও একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মস্কো জাতিসংঘকে সনির্বন্ধ অনুরােধ করে। পাকিস্তান এতে সম্মত হলে স্বয়ংসিদ্ধভাবেই যুদ্ধবিরতি হতাে। নয়াদিল্লি অবিলম্বে (৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। সামরিক অভিযানের পুরােভাগে অবস্থানকারী জ্যাকব যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিকের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের এক দিন আগে এই মর্মে একটি টেলিফোন কল পান যে নিয়াজি ও ফরমান আলী উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করেছেন। তথ্যটি হেনরি কিসিঞ্জার এই আশায় তাঁর কাছে রেখে দেন যেন ইত্যবসরে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের অধিকৃত কিছু ভূখণ্ড পাকিস্তান পুনর্দখল করতে পারে।
তুলনামূলক বিচারে ভারতের অবদানের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা অনেক বড় ছিল। আমার কোনাে সন্দেহ নেই যে তাঁরা নিজেরাই তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতেন। মুজিব ঘােষণা করেন যে পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ, এর ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যাবতীয় বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর বর্বরােচিত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘােষণা দেওয়া হয়। ভারতের সাহায্য ছাড়া বাঙালিদের পক্ষে এটা অর্জন। কষ্টসাধ্য হতাে এবং এতে তাদের বেশ দীর্ঘ সময় লাগত। তবে তাদের দৃঢ়সংকল্প এবং ত্যাগ স্বীকারের সামর্থ্যকে কখনাে খাটো করে দেখা সমীচীন নয়।
প্রায় ৩০ লাখ লােক নিহত এবং ১ কোটি মানুষকে তাদের বাস্তুভিটা ও পরিবার থেকে ছিন্নমূল করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে পাকিস্তানিদের খুব সামান্যই জানা ছিল। আত্মসমর্পণের আগে হাজার হাজার ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিককে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে এর সত্যতা প্রতিপন্ন হয়।
আমি বুঝতে পারি না কেন পাকিস্তান ওই সময়ে তাদের সেনাবাহিনীর নৃশংস কার্যক্রমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। অজ্ঞতার দরুন এটা হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বােমা ফেলার জন্য জাপানের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে, পাকিস্তান কেন নয়।
পৃষ্ঠা: ২৮৫
হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যে উল্লেখ করা হয় যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতনের মূল কারণ ছিল মদ ও নারীর প্রতি লিপ্সা এবং জমি ও বাড়ির লােভের দরুন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পেশাগত যােগ্যতা ও যুদ্ধ করার উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলা।
কমিশন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিকে জেরা করার সময় জিজ্ঞেস করেন যে, জেনারেল নিয়াজি, শুধু ঢাকাতেই আপনার ২৬ হাজার ৪০০ সৈন্য ছিল এবং ভারতীয়দের কমপক্ষে আরও দুই সপ্তাহ যুদ্ধ করতে হতাে। জাতিসংঘের অধিবেশন চালু ছিল এবং আপনি যদি অতিরিক্ত আর মাত্র এক দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতেন, তবে ভারতীয়দের ফিরে যেতে হতাে। আপনি কেন এই লজ্জাজনক, নিঃশর্ত প্রকাশ্য আত্মসমর্পণে সম্মত হলেন এবং আপনার এডিসির পরিচালনায় গার্ড অব অনার প্রদান করলেন? নিয়াজি উত্তর দেন, জেনারেল জ্যাকব ভয় দেখিয়ে আমাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন।
নিয়াজি ১৯৯৮ সালে রচিত তাঁর পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা বইয়ে বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেন। নিয়াজি জ্যাকবকে দোষারােপের কারণ হলাে, শেষােক্ত ব্যক্তি শক্তি প্রয়ােগ করে নিয়াজিকে তার ৯৩ হাজার সৈন্যসহ জাতিসংঘ নয়, ভারতের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। জ্যাকব আমাকে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল মানেকশ তাঁকে একটি ‘আত্মসমর্পণপত্র জোগাড় করতে নির্দেশ দেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন চলছিল। জ্যাকব বললেন, আমি কিছুদিন আগে জেনারেল মানেকশর কাছে আত্মসমর্পণ দলিলের একটি মুসাবিদা পাঠিয়েছিলাম, যা শেষােক্তজন অনুমােদন করতে অস্বীকার করেন। দিল্লিতে পাঠানাে আমার আগের সেই খসড়াটি নিয়ে ঢাকায় যাই।’
ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি মার্ক হেনরি ও জন কেলির সঙ্গে জ্যাকবের দেখা হয়, তারা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তাঁদের সঙ্গে রাখতে অনুরােধ করেন। ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে তখনাে যুদ্ধ চলছে। জ্যাকব তাঁদের ধন্যবাদ জানান, তবে তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত হননি। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি স্টাফ কারে পাকিস্তানের একজন ব্রিগেডিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান। পথে কয়েক শত গজ দূরবর্তী স্থানে মুক্তিবাহিনী গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি অক্ষত ছিলেন। তারা পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু জ্যাকব তাঁদের বুঝিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে রাজি করান।
জ্যাকব নিয়াজির সদর দপ্তরে আলাপ-আলােচনা করে আত্মসমর্পণের বন্দোবস্ত করেন। যে খসড়া আত্মসমর্পণের দলিল তিনি পূর্বে দিল্লি
পৃষ্ঠা: ২৮৬
পাঠিয়েছিলেন, তা অননুমােদিত রয়ে যায়। তিনি দলিলটিকে ৯৩ হাজার সৈন্যের প্রকাশ্য, শর্তহীন অস্ত্রসমর্পণে রূপান্তরিত করেন।
১৯৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঘােষণা দেওয়া হয়। যদিও ইসলামাবাদ জাতিসংঘের উপস্থিতিতে অস্ত্রবিরতির বৃথা চেষ্টা করে। পাকিস্তান ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি পরিহারের ইচ্ছা পােষণ করেছিল। কিন্তু জ্যাকব ঢাকার জনসাধারণের পূর্ণ দৃষ্টিসমক্ষে এক প্রকাশ্য আত্মসমর্পণের পরিকল্পনা করতে সক্ষম হন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা কলকাতা থেকে বিমানে ঢাকায় আগমন করেন। কেন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরােরার কাছে প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ সম্পন্ন করা হলাে, যেখানে জ্যাকব একে আগেই কার্যকর করেছেন? জ্যাকবকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি স্পষ্টভাবে উত্তর দেননি। তিনি খােলাখুলিই বলেন, ‘মুসলিম দেশ একজন ইহুদির কাছে অস্ত্রসমর্পণ করেছে, এটা দেখিয়ে নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে হেয় করতে চেয়েছিল’ (জ্যাকব একজন ইহুদি)।
দুর্ভাগ্যবশত কতিপয় ভারতীয় সৈনিক এবং সেনা কর্মকর্তা ঢাকার সেরা বাড়িগুলাে লুট করেন। এতে ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত রুষ্ট হন। কিন্তু তাঁর কাছে মস্ত উদ্বেগের কারণ ছিল, বাংলাদেশ যুদ্ধজয়ের ফলে সমর্থন ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মানেকশ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানাের পরিকল্পনা করেছেন। মর্মে রটিত গুজব।
মানেকশ আমাকে যা বলেন তা হলাে, তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) রটনাটি সত্য কি না, তা পরীক্ষা করতে আমাকে ফোন করেন। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বলি যে এ ধরনের কিছুই হয়নি। তিনি তাঁর কাজ করুন এবং আমাকে আমার করণীয় করতে দিন।
ভারত ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করে এবং আজাদ কাশ্মীরে ৪৭৯.৯৬ বর্গকিলােমিটার, পাঞ্জাবে ৩৭৩.৯৩ বর্গকিলােমিটার, কচ্ছ ও সিন্ধুতে ৪৭৬.১৭ বর্গকিলােমিটার ভূমি দখল করে।
অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান
—X—
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান