You dont have javascript enabled! Please enable it!

এক অনন্য আত্মসমর্পণের কাহিনি
লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মেজর জেনারেল ফারজু রাফায়েল জ্যাকব (অব.) ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বঞ্চল কমান্ডের চিফ অব জেনারেল স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক আয়ােজনের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। জ্যাকব ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭৮ তিনি সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং তার সামরিক জীবন নিয়ে তিনি দুটি বই রচনা করেন সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, বার্থ অব আ নেশন ও অ্যান ওডিসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস: অ্যান অটোবায়ােগ্রাফি। জেনারেল জ্যাকবের এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে ভারতীয় ওয়েব ম্যাগাজিন রেডিফ ডটকম-এর ডেপুটি ম্যানেজিং এডিটর রামানন্দ সেনগুপ্তের সঙ্গে ২০০৭ সালের আলাপচারিতার ভিত্তিতে। লিখাটি ২০০৭ সালের ২৬ মার্চে প্রথম আলাের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনার পূর্ণতা আনার জন্য শেষে জ্যাকবের সারেন্ডার অ্যাট ঢাকাবই থেকে অংশবিশেষ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবল দমনপীড়ন শুরু হলে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকতে থাকে, ফলে ভারত সরকার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এপ্রিলের শুরুর দিকে তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ আমাকে বললেন, ‘সৈন্যবাহিনী নিয়ে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়া দরকার।
আমি তাকে বললাম, সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের মাউন্টেন ডিভিশন আছে কিন্তু কোনাে সেতু নেই; আমাদের ও ঢাকার মধ্যে অনেক নদী, বেশ
পৃষ্ঠা: ২৭০

প্রশস্ত সেসব নদী, কিন্তু সেগুলাের ওপর সেতু নেই। সামনে বর্ষাকাল। নদীনালা-অধ্যুষিত অঞ্চলে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ আমাদের সৈন্যদের নেই, আমাদের পরিবহনব্যবস্থাও নেই, ফলে আমাদের পক্ষে ওদিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
সব শুনে মানেকশ বললেন, তিনি আবার আসবেন।
পরদিন আবার এসে বললেন যে তাকে ও সেনাবাহিনীকে কাপুরুষ বলা হচ্ছে। আমি তাকে বললাম, তাদের গিয়ে বলুন, আপনি কিছু করছেন না, তা নয়; ইস্টার্ন কমান্ড অগ্রসর হচ্ছে না।’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কবে নাগাদ আপনারা পারবেন?
উত্তরে আমি বললাম, যদি সেতুসহ প্রয়ােজনীয় আর সবকিছুর ব্যবস্থা করেন, তারপর প্রশিক্ষণের সময় দেন, তাহলেও ১৫ নভেম্বরের আগে নয়। এ কথা বললাম এ জন্য যে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে মাটি শুকিয়ে উঠবে, তখন। আমরা অগ্রসর হতে পারব। তারপর ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে এ বিষয়ে অবহিত করার জন্য যান মানেকশ।
আমাদের জানা ছিল যে একটা যুদ্ধ হতে যাচ্ছে। আমি পূর্ব পাকিস্তান দখল করার একটা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানিরা শহরগুলােকে রক্ষা করতে চাইবে, তাই আমার পরিকল্পনায় মূল কৌশল ছিল, ঢাকা হবে আমাদের চূড়ান্ত ও প্রধান লক্ষ্য, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত কেন্দ্র ঢাকা। অন্যান্য সেক্টরে, যেমন যশাের সেক্টরে আমরা লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিই যােগাযােগকেন্দ্রগুলােকে।
আমরা স্থির করলাম, বাইরের শহরগুলােকে এড়িয়ে, প্রচলিত পথ ব্যবহার না করে বিকল্প নানা পথে সােজা ঢাকার দিকে অগ্রসর হব। আমরা কোনাে শহর দখলে নিতে চাইনি, কারণ একটা শহর পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক সময় লাগে। আমি জানতাম, যুদ্ধটা হবে সংক্ষিপ্ত; জানতাম, জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে, তাই শহরগুলাে দখল করতে গিয়ে আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অর্থাৎ আমাদের কৌশল ছিল, পাকিস্তানিদের সীমান্তের দিকে টেনে আনা, শহরগুলাে ও পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাব্যুহ এড়াতে বিকল্প পথগুলাে ব্যবহার করা এবং সব দিক থেকে সরাসরি ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া।
এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের ভারতে আসা চলছেই। তাজউদ্দীন ও তার সহযােগীরা কলকাতায়। তাদের স্বাধীনতার ঘােষণার প্রাথমিক খসড়া তৈরির কাজে আমি সহযােগিতা করলাম। ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে সহযােগিতা করার জন্য আমাদের আদেশ দিল। সীমান্ত এলাকাগুলােতে প্রশিক্ষণ-শিবির স্থাপন করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ
পৃষ্ঠা: ২৭১

দেওয়া ও অস্ত্রসজ্জিত করার কাজ চলল। মুক্তিবাহিনী ও পরে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নগুলাে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। তারা এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল পুরােপুরি ভেঙে পড়ে। পাকিস্তানিরা নির্বিঘ্নে কোথাও যেতে পারত না, কোথাও বেরােলেই তাদের একটা না একটা আক্রমণের শিকার হতেই হতাে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যােগাযােগব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছিল এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল দুর্বল করে দিয়েছিল, ফলে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছিল।
আমাদের জন্য প্রধান সমস্যা ছিল লজিস্টিকস [রসদ], ওই যুদ্ধে জেতার জন্য সেটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মে মাসে, কারও কাছ থেকে কোনাে নির্দেশ পাওয়ার আগেই ত্রিপুরায় এক কোর সেনাদলের জন্য লজিস্টিকস গড়ে তুলতে শুরু করি। একইভাবে তুরা ও অন্যান্য স্থানে আমরা বর্ডার রােডস অর্গানাইজেশনকে দিয়ে রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, এয়ারফিল্ড ইত্যাদি বানিয়ে নিই। মে মাসে আমি একটি পরিকল্পনা সেনা সদর দপ্তরে পাঠাই, সে পরিকল্পনায় ঢাকাকে করি প্রধান লক্ষ্যস্থল; সৈন্য বরাদ্দের কথাও সে পরিকল্পনায় ছিল। সেনাসদর সেটি নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে ভাবে। তারপর আগস্ট মাসে জেনারেল মানেকশ ও ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস কে কে সিং আমাদের একটা পরিকল্পনা দেন। লিখিতভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় যে আমাদের খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দর দখল করতে হবে, সেই লক্ষ্যেই যেন আমরা বেশি শক্তি নিয়ােগ করি। আমি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করি যে আমাদের উচিত ঢাকা দখল করা। কিন্তু আমাকে বলা হলাে, না, আমরা যদি খুলনা আর চট্টগ্রাম জয় করতে পারি, তাহলেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। আমি জানতে চাই, কীভাবে সেটা সম্ভব, কারণ খুলনা হচ্ছে আমাদের সীমান্ত থেকে ৩০ মাইল দূরে সামান্য একটা নদীবন্দর, আর চট্টগ্রামের গুরুত্ব নিছকই প্রান্তিক বা পেরিফেরিয়াল। এভাবে কিছুদিন যুক্তিতর্ক চলে, অবশেষে মানেকশ ওই লিখিত আদেশে একমাত্র যে পরিবর্তনটা আনেন, সেটা হচ্ছে ‘বেশি শক্তি’ কথাটা বাদ দেওয়া।
অর্থাৎ যে আদেশ নিয়ে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম, তাতে বলা ছিল, খুলনা ও চট্টগ্রাম দখল করতে হবে। ঢাকার উল্লেখ কোথাও ছিল না।
কিন্তু আমরা খুলনাও জয় করিনি, চট্টগ্রামও জয় করিনি, তবু যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। ঢাকা আক্রমণের জন্য আমার সৈন্য প্রয়ােজন ছিল। ছয় মাউন্টেন ডিভিশনকে রাখা হয়েছিল উত্তরে—ভুটানের জন্য। সেই ডিভিশনের কাছে। আমি সৈন্য পাঠানাের অনুরােধ জানালাম। কিন্তু আমাকে জানানাে হলাে,
পৃষ্ঠা: ২৭২

সেখান থেকে কোনাে সৈন্য আমি পাচ্ছি না, কারণ উত্তর দিক থেকে চীনারা আক্রমণ করে বসতে পারে। মানেকশ তাই সেখান থেকে কোনাে সৈন্য নিয়ে ঢাকার জন্য পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমাকে একটা প্যারা ব্যাটালিয়ন গ্রুপ দেওয়া হয়। আমি সেই গ্রুপকে টাঙ্গাইলে নামানাের পরিকল্পনা করি এবং সেই আদেশ স্বাক্ষর করি অক্টোবরে। আমরা স্থির করি, ছত্রী বাহিনীর ওই গ্রুপটি নামবে সংকেত পাওয়ার সাত ঘণ্টা পর এবং তাদের লিঙ্কআপ করা হবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। আমরা যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম, ঠিক সেটাই ঘটেছিল। ৯ নভেম্বর মাসে আমরা ৫০ প্যারা ব্রিগেডের ক্যাপটেন পি কে ঘােষকে ‘টাইগার’ সিদ্দিকীর (কাদের সিদ্দিকী) সঙ্গে টাঙ্গাইলে পাঠাই ছত্রী বাহিনীর অবতরণের জায়গা নির্ধারণের জন্য। কিন্তু আমাদের সৈন্য দরকার ছিল। মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে যে দুটি ডিভিশন ছিল, তাদের আর্টিলারি ছিল না। আমি তাই চীনা সীমান্ত থেকে সব আর্টিলারি সরিয়ে এনে এই দুটি ডিভিশনের ঘাটতি পূরণ করি। ঢাকায় আঘাত হানার জন্য তিনটি ব্রিগেডও আমি নিয়ে আসি।
৩০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর অভিযান শেষ হয়। তাই আমি আর্মি কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরাকে বলি, এই হচ্ছে ঢাকার ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা। তিনি আমাকে বলেন যে তিনি তা মানেকশকে জানাবেন। আমি বলি, মানেকশকে জানাবেন না; কারণ তিনি বলেছেন, চীনারা আমাদের আক্রমণ করতে পারে, তিনি আমাদের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেন না। আর ঢাকা যে গুরুত্বপূর্ণ, এটাও মানেকশ মনে করেন না।
৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মানেকশকে কিছুই জানানাে হয়নি। ওই তারিখে অরােরা তাকে একটি বার্তায় জানান যে ঢাকা অধিকারের উদ্দেশ্যে আমি তিনটি ব্রিগেড নামিয়ে এনেছি। দুই ঘণ্টার মধ্যে মানেকশর কাছ থেকে এ রকম উত্তর আসে: এই ব্রিগেডগুলাে সরাতে আপনাকে কে বলেছে? আপনি এক্ষুনি তাদের ফেরত পাঠান! অরােরা এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী করা যায়? আমি বললাম, বিষয়টা আমি দেখব। নতুন ডিরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস ইন্দর গিল এ ব্যাপারে আমাকে সহযােগিতা করছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আপনি কেন এই বার্তাটা পাঠাতে গেছেন? মানেকশ আমার ওপর চোটপাট করছেন—কেন বিষয়টি তাঁকে জানাইনি।
আমি বলি ওই বার্তা আমি পাঠাইনি; আর এখন ব্রিগেড়গুলাে ফেরত পাঠানােরও কোনাে উপায় নেই। আমরা সবাই জানি যে যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে, আর আমরা সবাই এ-ও জানি যে আমি যদি ব্রিগেডগুলাে ফেরত পাঠাই,
পৃষ্ঠা: ২৭৩

তাহলে তাদের আর ফেরত পাব না। গিল বললেন, “ঠিক আছে, ফেরত না পাঠালেন; কিন্তু সেনাসদরের অনুমােদন ছাড়া তাদের বাংলাদেশের ভেতরে ঢােকাবেন না, কারণ সেনাপ্রধান এ ব্যাপারে অনড়।’ উত্তরে আমি বললাম, ইন্দর, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।’
আমি জানতাম না যে যুদ্ধ শুরু হলেও ডিসেম্বরের ৮ তারিখের আগে পর্যন্ত মানেকশ এই ব্রিগেডগুলাে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢােকার অনুমতি আমাকে দেবেন না। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ সন্ধ্যায় মানেকশ আমাকে ফোন। করে বলেন, পাকিস্তানিরা পশ্চিমে আমাদের এয়ারফিল্ডের ওপর বােমা হামলা চালিয়েছে। আমি তাকে বললাম, তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি বললেন, হ্যা, এখন আপনি এগিয়ে যান। মিসেস গান্ধী কলকাতা গিয়েছেন, তাঁকে সব বিষয়ে অবহিত করুন। আমি বলি, ঠিক হ্যায়।
তারপর আমি অরােরাকে বলি, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমাকে নির্দেশনামা তৈরি করতে হবে, তাই আপনি রাজভবনে গিয়ে মিসেস গান্ধীকে অবহিত করুন। তারপর বিমানবাহিনীর সহযােগিতার জন্য যােগাযােগ করে আমি নির্দেশগুলাে ইস্যু করি।
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
যুদ্ধে আমাদের অগ্রযাত্রা ছিল বেশ ভালাে। উত্তর দিক থেকে আমাদের অগ্রাভিযান খুব ভালােভাবে এগােয়, দুটি ব্রিগেডের আসতে দেরি হলেও ছত্রী বাহিনীর অবতরণ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই ঘটে এবং ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ নাগাদ আমরা প্রায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌছে যাই।
ইতিমধ্যে মালাক্কা প্রণালি ধরে মার্কিন নৌবহর এগিয়ে আসছিল। এ খবরে দিল্লিতে অনেকেই ভয় পেয়ে যান। ইসলামাবাদ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য যেসব রেডিও সংকেত পাঠানাে হচ্ছিল, সেগুলােতে আড়ি পেতে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম, সেসব সংকেতে বলা হচ্ছিল, ‘লড়াই চালিয়ে যাও। আমাদের সাহায্য করার জন্য উত্তর দিক থেকে আসছে চীনারা আর দক্ষিণ দিক থেকে আসছে আমেরিকানরা।’ নিয়াজি এটা বিশ্বাস করেছিলেন।
১৩ ডিসেম্বর রাতে আমি ওয়্যারলেসে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে যােগাযােগ করে বলি, আমরা ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়েছি, আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী, তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর উত্থান অত্যাসন্ন। এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করব এবং সংখ্যালঘু (অবাঙালি) জনগােষ্ঠীকে সুরক্ষা দেব।
১৪ ডিসেম্বর আমরা খবর পাই যে সেদিন ঢাকায় গভর্নর হাউসে একটা
পৃষ্ঠা: ২৭৪

বৈঠক হবে। ঢাকায় গভর্নর হাউস ছিল দুটি, আমরা আন্দাজ করে একটা বেছে নিই এবং সৌভাগ্যক্রমে আমাদের আন্দাজ সঠিক হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী দুই ঘণ্টার মধ্যে গভর্নর হাউসে বােমা ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদত্যাগ করেন। সেদিন বিকেল চারটায় নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী আমেরিকান কনসাল জেনারেল স্পিভাকের সঙ্গে দেখা করে কয়েকটি প্রস্তাব রাখেন। সেগুলাে ছিল : জাতিসংঘের অধীনে যুদ্ধবিরতি, জাতিসংঘের অধীনে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার, পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার জাতিসংঘের ওপর ন্যস্ত করা এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে কোনাে বিচার হবে না ইত্যাদি।
অন্য একটা দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এটা আমি জানতে পারি। বিষয়টি মানেকশকে জানাই, মানেকশ ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেন। রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। একই দিনে ইসলামাবাদের আমেরিকান দূতাবাস ওই প্রস্তাব নিউইয়র্কে পাঠায় এবং সেটা ১৫ ডিসেম্বর পাঠানাে হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে, যিনি তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি এটা মানতে অস্বীকৃতি জানান। তারপর আমেরিকানরা সেটি আমাদের কাছে পাঠায়। ১৫ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেওয়া হয়। একই দিন সন্ধ্যায় (আমাদের সময় অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর সকাল) সােভিয়েত শিবিরের অন্যতম দেশ পােল্যান্ড নিউইয়র্কে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পেশ করে। ভুট্টো সে প্রস্তাব ছিড়ে ফেলে দেন, কারণ সে প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসনকারী হিসেবে নিন্দা করা হয়নি।
১৬ ডিসেম্বর সকালে মানেকশ আমাকে ফোন করে বলেন, ‘যান, ওদের আত্মসমর্পণ করান।
আমি ঢাকায় নামার পর জাতিসংঘের কয়েকজন প্রতিনিধি আমার কাছে এসে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও শাসনভার গ্রহণের বন্দোবস্ত করার জন্য আমরা আপনার সঙ্গে আসব।’
আমি তাদের বলি, ‘ধন্যবাদ, আপনাদের সহযােগিতার প্রয়ােজন হবে না।’
তখন ঢাকার সবখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। আমাকে নিয়াজির কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আমার কাছে এলেন। পথে মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট আমাদের। থামায় এবং সামনে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাঁরা বলেন, “আমরা নিয়াজির সদর দপ্তরে হামলা চালাতে যাচ্ছি। আমি তাদের বলি, উনি আত্মসমর্পণ করবেন। প্লিজ, আমাকে যেতে দিন। অনেকক্ষণ কথা-কাটাকাটি। চলল। অবশেষে আমি বললাম, “দেখুন, আগামীকাল আপনাদের নতুন সরকার দায়িত্ব নিতে আসছে, নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে চান। ঈশ্বরের। দোহাই, আমাদের যেতে দিন!’ তারপর তারা আমাদের পথ ছাড়লেন। আমি
পৃষ্ঠা: ২৭৫

নিয়াজির সদর দপ্তরে পৌছে আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়াটি তাঁকে পড়ে শােনালাম। শুনে নিয়াজি বললেন, এটা তাে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিল। কিন্তু আপনি তাে এসেছেন শুধু যুদ্ধবিরতি আর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রত্যাহার নিয়ে আলােচনা করার জন্য।’
উত্তরে আমি বললাম যে তা নিঃশর্ত নয়। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। তাঁর কোনাে কোনাে সহযােগী, যেমন রাও ফরমান আলী, তাঁকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে রাজি হতে নিষেধ করছিলেন। অবশেষে আমি নিয়াজিকে বললাম, জেনারেল, আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আপনাদের পরিবার-পরিজন, সংখ্যালঘু অবাঙালি, প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এবং আপনাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা হবে। তারপরও যদি। আপনারা আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে আপনার ও আপনাদের পরিবারপরিজনের কিছু হলে আমি দায়িত্ব নিতে পারব না। তা ছাড়া শিগগিরই আবার লড়াই শুরু করার আদেশ দেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে কোনাে বিকল্পও থাকবে না। আমি আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দিচ্ছি।’
এ কথা বলে আমি বেরিয়ে আসি। আধঘণ্টা পর গিয়ে দেখি, আত্মসমর্পণের দলিলটি টেবিলের ওপরেই রয়েছে। আমি নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করি, জেনারেল, আপনি কি এটি গ্রহণ করেছেন?
তিনি কোনাে উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। আমি তাঁকে একই কথা জিজ্ঞেস করলাম তিনবার। কোনাে উত্তর পেলাম না। তারপর কাগজটি টেবিল থেকে নিয়ে ওপরে তুলে ধরে বললাম, তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি। আপনি এটিতে সম্মত হয়েছেন।
তখন নিয়াজির চোখে পানি দেখতে পাই। অন্য পাকিস্তানি জেনারেল ও। অ্যাডমিরালদের চোখগুলাে ক্রোধে জ্বলছিল। নিয়াজি বললেন, আমি আত্মসমর্পণ করব আমার অফিসে।
আমি বললাম, না। আমি ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছি যে আপনি আত্মসমর্পণ করবেন রেসকোর্স ময়দানে, ঢাকার জনতার সামনে। তিনি বললেন, আমি তা করব না।’
করবেন, আমি বললাম, আপনি একটা গার্ড অব অনার প্রদান করবেন।’
তারপর আমরা যখন নিয়াজির গাড়িতে চড়ে বিমানবন্দরে যাচ্ছি, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে তার ওপর লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ভাগ্যক্রমে আমার স্টাফ অফিসার খারা ছিল শিখ, সে তার পাগড়িবাধা মাথা বের করে মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশে চিৎকার ছাড়ে। বিমানবন্দরের কাছে। গিয়ে দেখতে পাই, আমাদের অল্প কয়েকজন সৈন্য এদিক-সেদিক থেকে
পৃষ্ঠা: ২৭৬

আসছে। একটা জিপে আমি দুজন ছত্রীসেনা দেখে তাদের নিজের সঙ্গে। নিলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছালে এক ট্রাক মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। টাইগার সিদ্দিকী। কী তাঁর মতলব ছিল জানি না, কিন্তু আমার বােধ হচ্ছিল তিনি নিয়াজিকে গুলি করতে চেয়েছিলেন। নিয়াজি যদি বিমানবন্দরে খুন হয়ে যেতেন, তাহলে আত্মসমর্পণ ঘটত না। আমি দুই ছত্রীসেনাকে বললাম নিয়াজিকে ঘিরে রাখতে, তাঁর দিকে রাইফেল তাক করে থাকতে বললাম এবং ওই অবস্থায় এয়ারফিল্ড থেকে তাঁকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিলাম। তারপর (কাদের) সিদ্দিকীর কাছে হেঁটে গেলাম।
তখন অরােরা, তাঁর স্ত্রী ও সফরসঙ্গীরা এসে নামলেন। ভেবেছিলাম, অরােরা ও নিয়াজির সঙ্গে আমিও যাব; কিন্তু আমাকে বলা হলাে অরােরার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। যেহেতু ততক্ষণে সবাই চলে গেছে এবং ওটাই ছিল শেষ গাড়ি, আমি তাই একটি ট্রাকে উঠে পড়লাম।
আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর শেষ হওয়ার পর জনতা নিয়াজিকে ফাসিতে লটকাতে চাইছিল। সে মুহূর্তে সেখানে আমাদের সৈন্য ছিল খুব কম; তাই আমরা নিয়াজিকে ঘিরে রেখে কর্ডন করে একটা সামরিক জিপে তুলে দিই, জিপটি তাঁকে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলে যায়।
সেটা ছিল এক অনন্য ধরনের আত্মসমর্পণ; নিয়াজির সামর্থ্য ছিল আরও অন্তত দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার এবং জাতিসংঘের অধিবেশন চলমান ছিল। তবু যুদ্ধবিরতি রূপান্তরিত হয়েছিল প্রকাশ্য আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে, এমন ঘটনা যুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য।
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য নিয়াজির বেঁচে থাকা অপরিহার্য ছিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে সিদ্দিকী হয়তাে নিয়াজিকে গুলি করতে এসেছে। আমি ভদ্রভাবে সিদ্দিকীকে বিমানবন্দর ত্যাগের জন্য অনুরােধ জানালাম, কিন্তু তিনি অনড় থাকলেন। আমি হুকুমের সুরে আবারও তাকে সরে যেতে বললাম। তবু তাকে দ্বিধান্বিত দেখলাম। শেষে সিদ্দিকী অসন্তুষ্টির সঙ্গে রানওয়ের ওপর দিয়ে তাঁর ট্রাকের দিকে পা বাড়ালেন। আমি চিৎকার করে তাকে রানওয়ে থেকে ট্রাক সরিয়ে নিতে বললাম। অবশেষে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম যখন তিনি তা সরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে খারা কর্নেল এম এস খারা, ভারতীয় গােয়েন্দা অফিসার] একটা পিটি ৭৫ ট্যাংক নিয়ে ফিরে এল। কথা ছিল সিদ্দিকী তার কুড়ি হাজার সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে। আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু সে সময় তাঁকে দেখা যায়নি। তিনি পালিয়ে আসা পাকিস্তানি সৈন্যদের টাঙ্গাইলে বাধাও দেননি। আর এখন তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে উদয় হয়েছেন, কিন্তু কী কারণে তা আমার বােধগম্য হয়নি। কিছুদিন পর তিনি ক্যামেরা ক্রসহ আন্তর্জাতিক
পৃষ্ঠা: ২৭৭

গণমাধ্যমকে, তাঁর ভাষায় বিশ্বাসঘাতকদের জনসমক্ষে বেয়নেটিং প্রত্যক্ষ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বহুল প্রচার পেয়েছিল।
বিকেল সাড়ে চারটার সময় পাঁচটি এমআই ফোর এবং চারটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে করে আর্মি অধিনায়কের সফরসঙ্গীরা এসে পৌছালেন, নিয়াজি আর আমি তাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলাম। পূর্বাঞ্চল অধিনায়ক। মিসেস অরােরা, এয়ার মার্শাল দেওয়ান [পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনী প্রধান], ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান [পূর্বাঞ্চল নৌবাহিনীর প্রধান], লে. জেনারেল সগত সিং [চতুর্থ কোরের অধিনায়ক] এবং উইং কমান্ডার খন্দকারসহ [বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ] বিমান থেকে নেমে এলেন। নিয়াজি, লে. জেনারেল অরােরা ও এয়ার মার্শাল দেওয়ান গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও সেই গাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু মিসেস অরােরাকে স্বামীর পাশে বসার জন্য আমাকে জায়গাটা ছেড়ে দিতে হলাে। গাড়িটি রওনা। দিয়ে দিলে আমি বিকল্প ব্যবস্থায় রেসকোর্সে পৌছালাম। যদিও প্রস্তুতির জন্য সময়ের স্বল্পতা ছিল, তবু অনুষ্ঠানটি মােটামুটি সুন্দরভাবে শেষ হলাে। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরােরা ও নিয়াজির টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে আনা আত্মসমর্পণের দলিলটি অরােরা টেবিলে উপস্থাপন করলেন। নিয়াজি উৎসুকভাবে তা একঝলক দেখলেন এবং তাতে স্বাক্ষর করলেন। অরােরাও স্বাক্ষর করলেন। আমি মনােযােগের সঙ্গে দলিলে নজর দিলাম এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম যে শিরােনামে লেখা আছে—১৬৩১ ঘটিকা আইএসটি (ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম)-এ স্বাক্ষরিত হবে। আমি আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম। তাতে ১৬৫৫ ঘটিকা দেখতে পেলাম। নিয়াজি তাঁর। এপােলেট (সামরিক ব্যাজ] খুলে ফেললেন এবং লেনিয়ার্ডসহ তার পয়েন্ট ত্রিএইট রিভলবারটি অরােরাকে হস্তান্তর করলেন। তাঁর চোখে জলের রেখা দেখা গেল। অন্ধকার হয়ে আসছিল। রেসকোর্সে উপস্থিত জনতা নিয়াজিবিরােধী আর পাকিস্তানবিরােধী স্লোগান দিচ্ছিল, সঙ্গে গালিগালাজও করছিল। আমরা নিয়াজির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। যেহেতু রেসকোর্স ময়দানে অতি সামান্য সৈন্য ছিল, তাই আমরা সিনিয়র অফিসাররা নিয়াজিকে ঘিরে একটা বৃত্ত রচনা করে তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে একটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিপের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি সগত সিংকে পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করার বিষয়ে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও যুদ্ধবন্দীদের ভারতে নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশ দিলাম। এরপর আমরা ঢাকা বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিলাম এবং আগরতলার উদ্দেশে উড়াল দিলাম। আমরা যখন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম, তখন আমার অনুমতি নিয়ে
পৃষ্ঠা: ২৭৮

পাকিস্তান নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ অ্যাডমিরাল কৃষ্ণানকে বিদায় জানাতে উপস্থিত হলেন। পরবর্তীজন শরিফকে তাঁর পিস্তলটি দেওয়ার জন্য বললেন। শরিফ হােলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কৃষ্ণানকে তুলে দিলেন। এরপর আমরা হেলিকপ্টারে চেপে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
ফোর্ট উইলিয়ামে পৌছে সারা দিনের ঘটনাপ্রবাহের প্রতিবেদন তৈরি করতে আমি অপারেশন রুমে গেলাম। কাজ শেষ করে প্রায় ভােরের দিকে আমি আমার বাসায় ফিরে গেলাম। বাসায় ঢােকার সঙ্গে সঙ্গেই বেল বেজে উঠল। গিয়ে দেখি দরজায় সানডে টাইমস-এর নিকোলস টমালিন দাঁড়িয়ে আছে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারে জায়গা না পাওয়ায় সে খুব অস্থির ছিল। আমি তাকে আত্মসমর্পণ আর যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিই। তার প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুব ভালাে প্রচার পেয়েছিল।
কিছুদিন পর আমি নিয়াজির আত্মসমর্পণ করা রিভলবারটা পরীক্ষা করি এবং উপলব্ধি করি যে সেটি নিয়াজির নিজস্ব ছিল না। এটি সেনাবাহিনীর সাধারণ বরাদ্দের পয়েন্ট ত্রিএইট রিভলবার ছিল। বেরেলটা ময়লা দিয়ে ভর্তি ছিল এবং বেশ কিছুদিন ধরে পরিষ্কারও করা হয়নি। লেনিয়ার্ডটি নােংরা এবং জায়গায় জায়গায় হেঁড়া ছিল। একজন জেনারেল অধিনায়কের অস্ত্র এ রকম হয় না। খুব সম্ভবত নিয়াজি তার সঙ্গের মিলিটারি পুলিশদের কারও কাছ থেকে এটি নিয়েছিলেন। আমার অনুভব হচ্ছিল যে নিয়াজি যা পেয়েছেন, তা তাঁর প্রাপ্য ছিল।
অনুবাদ : মশিউল আলম ও মুহাম্মদ লুৎফুল হক
পৃষ্ঠা: ২৭৯
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!