You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধ
অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ

অ্যাডমিরাল সারদারিলাল মাথরাদাস নন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। অ্যাডমিরাল নন্দ ১৯১৫ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি রাজকীয় নৌবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান হন। ১৯৭৩ সালে তিনি নৌবাহিনী থেকে অবসর নেন। তিনি ভারতের অন্যতম মর্যাদাজনক জাতীয় পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। অ্যাডমিরাল নন্দ ২০০৯ সালের ১১ মে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আত্মজীবনী দ্য ম্যান হু বম্বড করাচি (হারপারকলিন্স, ২০০৪) গ্রন্থের ‘ওয়ার ইন দ্য বে অব বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ অধ্যায়ের অংশবিশেষ নিচে উপস্থাপন করা হলাে। রচনাটি ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলােতে প্রকাশ পায়।
যুদ্ধের আগে সতর্কতামূলক পর্বে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহর মােতায়েন করা হয়েছিল, যাতে লড়াই বাধলেই শত্রুপক্ষকে হতবাক করে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের কিছু বিমানঘাঁটিতে হামলা চালালে নৌবহরটি ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বিকেলে আন্দামান থেকে যাত্রা করে। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী কে কোথায় অভিযান চালাবে, তা আগেই আলােচনার মাধ্যমে ঠিক করা ছিল। ৪ ডিসেম্বর ভােরে আমাদের যুদ্ধজাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালানাের দূরত্বে চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর সকালে যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে আঘাত হানে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে পরদিন কোনাে বিমান। হামলা চালানাে হলাে না। তবে ৬ ডিসেম্বর প্রচণ্ড বিমান হামলা চালানাে হয়, এর ফলে পাকিস্তানের অনেক ছােট নৌযান, কিছু বাণিজ্য জাহাজ ও কয়েকটি রণতরি ডুবে যায়। ১০ ডিসেম্বর সমুদ্র ও নদীপথের প্রায় সব ধরনের
পৃষ্ঠা: ২৪৬

যােগাযােগব্যবস্থাই পুরােপুরি স্থবির করে দেওয়া হয়। এই সময়ােচিত আক্রমণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ে দারুণভাবে সাহায্য করে।। এখানে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকার কথা স্বীকার না করলেই নয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের ব্যাপক অংশকে বিক্ষুব্ধ করে এবং অনেক নৌসেনাসহ তাদের ব্যাপকসংখ্যক সৈন্য পালিয়ে যায়। পাকিস্তান নৌবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিক্রুটিংয়ের ওপর নির্ভর করত। তবে নৌবাহিনীর কারিগরি ট্রেডের নাবিকদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই পালিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুক্তিলাভের আন্দোলন করছে, এমন অনেক সংগঠন রাতারাতি নড়েচড়ে ওঠে এবং এগুলাের সদস্যরা শরণার্থীদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে আসেন। পরে এই মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন এবং তাঁদের লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অনুরােধ জানান। মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডাে অংশটি গঠিত হয়েছিল এমন সব নাবিক নিয়ে, যারা পাকিস্তানের দানে [Daphne] ক্যাটাগরির সাবমেরিন ম্যানগ্রো থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া অনেক উৎসাহী বাঙালি যুবক এই অংশটিকে ঘিরে সংগঠিত হন। স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং জাহাজ ও রণতরি ধ্বংস করায় এই বাহিনীটিই অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান [পূর্বাঞ্চলীয় নৌকমান্ডের এফওসি-ইন-সি] ঠিকই অনুমান করেছিলেন যে ঢাকার হাইকমান্ড পূর্ব পাকিস্তান থেকে অধিকাংশ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পালিয়ে আসার ব্যাপারে সব সময় আশাবাদী ছিল। তাদের ধারণা ছিল, বাণিজ্য জাহাজের ধারণক্ষমতায় কুলালে প্রায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও জওয়ান ধরা পড়ার আগেই পালিয়ে যাবে। তবে এই বিশাল মাপের পলায়নের জন্য প্রয়ােজন ছিল এমন বড় জাহাজের, যা শুধু চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই ছেড়ে যায়। ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও বিক্রান্ত চট্টগ্রাম বিমানঘাঁটি ধ্বংস করতে এবং তিনটি বাণিজ্য জাহাজ ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি রণতরি ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এগুলাে ক্যামােফ্ল্যাজ অবস্থায় ছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের পলায়নের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ইঞ্জিনচালিত সব ভাসমান নৌযানই ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনাে পথ খােলা রইল না। একমাত্র যে জাহাজটি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেয়, সেটি হলাে পিএনএস রাজশাহী। এটি ছিল পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটারে টিকে থাকা একমাত্র জাহাজ।
পৃষ্ঠা: ২৪৭

পাকিস্তানের সাবমেরিন ‘গাজি’ মােতায়েনের ব্যাপারটি ছিল প্রায় পুরােপুরি মিলে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীর মতােই। ভারতীয় নৌবাহিনী স্থান-কাল বিবেচনা করে ইঙ্গিত দিয়েছিল, পাকিস্তানের একমাত্র গাজিরই বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালানাের মতাে পাল্লা ও কার্যকারিতা রয়েছে এবং গাজিকেই এ মিশনে পাঠানাে হতে পারে। একই হিসাব সম্ভবত পাকিস্তানও করেছিল। বঙ্গোপসাগরে গাজিকে মােতায়েনের সিদ্ধান্তটি পাকিস্তান সদর দপ্তর অবশ্যই অক্টোবরের শেষ দিকে নিয়েছিল। তা না হলে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে সাবমেরিনটিকে পূর্ব উপকূলের দিকে পাঠানাে সম্ভব হতাে না। এটি স্পষ্ট, জুলাই-আগস্ট মাসে বিক্রান্তকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানাে হয়েছে জেনেই গাজিকে মােতায়েন করা হয়েছিল। বিক্রান্তের বঙ্গোপসাগরে অবস্থানের বিষয়টি গােপন রাখা ছিল প্রায় অসম্ভব। তবে জাহাজটির প্রকৃত অবস্থান বিষয়ে শত্রুপক্ষের গােয়েন্দা বিভাগকে ধাঁধায় ফেলার সর্বোচ্চ কৌশল নেওয়া হয় এবং তাতে ভারত সফলও হয়। ক. আমার স্টাফ এ-ও অনুমান করতে পেরেছিল যে বিক্রান্ত ও গাজি একে অন্যের গতিপথ অতিক্রম করবে। পাকিস্তানি সাবমেরিনটি ২৫-২৭ নভেম্বর মাদ্রাজ [চেন্নাই] থেকে যাত্রা শুরু করে এবং যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার মুহূর্তে এটি বিশাখাপত্তম ছাড়ছিল। ৩-৪ ডিসেম্বর রাতে বিশাখাপত্তম থেকে চালানাে এক আক্রমণে গাজি ধ্বংস ও সাগরে নিমজ্জিত হয়। এরপর ডুবুরিদের অনেকগুলাে দল ধ্বংসস্তৃপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে এবং তাতে জাহাজটির উপস্থিতি বা এর পূর্ব দিকে যাত্রা সম্পর্কে কিংবা এর টার্গেট যে বিক্রান্ত ছিল, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ থাকে না। o আমরা পাকিস্তান নৌবাহিনীর সব ধরনের বার্তা আদান-প্রদানের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলাম। ফলে তাদের যাবতীয় কার্যক্রমের প্রস্তুতি ও লড়াই বাধার আগে জাহাজ ও সাবমেরিন মােতায়েনের বিষয়ে দফায় দফায় সলাপরামর্শের একটি সম্যক চিত্র আমাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয়। তবে একইভাবে শত্রুপক্ষও যাতে আমাদের যােগাযােগব্যবস্থার ওপর নজরদারি না করতে পারে, সে ব্যাপারে আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছিল। মেকি সংকেত প্রেরণ, কোড-ভায়ােলেশন মনিটরিং এবং অন্যান্য নিরাপত্তাবিষয়ক কার্যক্রম।
পূর্বাঞ্চলীয় নৌকমান্ড পাকিস্তানিদের এই ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে বিক্রান্ত বিশাখাপত্তম পােতাশ্রয়ে রয়েছে, যদিও সেটি ওই মুহূর্তে ছিল আন্দামানে। ২৫ নভেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনী যেকোনাে মূল্যে জোন ভিকটর (বিশাখাপত্তমের ছদ্মনাম) দখল করতে গাজিকে নির্দেশ দেয়। কারণ, পাকিস্তানি নৌ-গােয়েন্দারা তাদের বলেছিল, ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজটি
পৃষ্ঠা: ২৪৮

সেখানেই রয়েছে। ৩-৪ ডিসেম্বর রাতে ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজি নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে বিক্রান্তের জন্য ক্লান্তিকর প্রতীক্ষায় ছিল!
গাজির নিমজ্জনের খবর যুদ্ধে এক চমক্কার আভাস দেয়। তবে গাজির ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধারকৃত আলামত সূত্রে ইতিবাচক প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি খবরটি চেপে যাই। এ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে পূর্বাঞ্চলীয় নৌকমান্ডের এফওসি ইন সি ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান যেসব কৌশল প্রণয়ন করেছিলেন, সেগুলাের অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা দেখতে পাই যে পাকিস্তান তাদের সব জ্বালানিচালিত নৌযান পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য তারা কিছু দাড়বাহী ছােট নৌকা ছেড়ে দেয়। অপ্রয়ােজনীয় ধ্বংস যুদ্ধের পর বাংলাদেশিদেরই ক্ষতির কারণ হবে ভেবে শুরুর দিকে আমরা প্রতিটি নৌযানেই আঘাত না হানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে এই সিদ্ধান্ত বদলানাে হয় এবং বিক্রান্তকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে নদী বা বন্দরের সব যন্ত্রচালিত নৌযানেই যেন হামলা চালানাে হয়। কারণ, যুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের যানকে শত্রুম্যান হিসেবেই দেখা উচিত।
মনে হচ্ছিল সবাই এ কথা জানত যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেভাবে অব্যাহত গতিতে এগােচ্ছে, তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টিকে থাকার সম্ভাবনা সীমিত। এ ক্ষেত্রে তারা হয় আত্মসমর্পণ করবে, নয় সমুদ্রপথে পিছু। হটবে। বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি আসন্ন—এ খবর পেয়ে আমরা ধরে নিলাম, পাকিস্তানিরা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেবে। পাকিস্তানিদের চট্টগ্রাম, চালনা ও খুলনা বন্দর দিয়ে যন্ত্রচালিত নৌযান ও ফেরিতে চড়ে সমুদ্রে গিয়ে জাহাজে ওঠার সম্ভাবনাটি সহসাই খুবই বাস্তব হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বন্দরে এ ধরনের যান নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
যখন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করল এবং আমরা অনুমান করলাম যে এর গভীর পানির জলযানগুলাে অগভীর পানিতে চলাচল করতে গেলে বাধাগ্রস্ত হবে, তখন আমরা স্বস্তি বােধ করলাম। সেই সঙ্গে এটিও খুব স্পষ্ট হয়ে গেল যে পাকিস্তান যদি তাদের সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ চায়, সে ক্ষেত্রে তারা চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা অন্যান্য নদীবন্দর থেকে ছােট্ট নৌযানে করে মাঝসমুদ্রে গিয়ে জাহাজে চড়বে। তাই পলায়নের সব পথ রুদ্ধ করে দিতে বন্দরের সব জাহাজসহ যাবতীয় নৌযান ও ফেরিতে হামলা চালানাের আদেশ দেওয়া হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে তিন বাহিনীর প্রধান মানেকশ (সেনাবাহিনী), প্রতাপ লাল (বিমানবাহিনী) এবং আমি জলে ও স্থলে একসঙ্গে
পৃষ্ঠা: ২৪৯

অবতরণের সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করেছিলাম। সৈন্য মােতায়েনের ভার নেয় সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিবহনের দায়িত্ব পড়ে আমাদের ওপর। আমরা দুটি এলএসটি (ল্যান্ডিং শিপ ট্যাংক-ভ্যাসেলস, যার মাধ্যমে সমুদ্রপথে অবতরণকারী সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য ট্যাংকসমূহ বহন। করা হয়) প্রস্তুত করি। কিছু গুর্খা জওয়ানকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয় সেনাবাহিনী। শেষ পর্যন্ত সমুদ্রপথে অবতরণের প্রয়ােজন হয়নি, যেহেতু স্থলভাগেই অপারেশন চলছিল। . উভচর অবতরণের ধারণাটি ১২ ডিসেম্বর কিংবা এর কাছাকাছি কোনাে তারিখে তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠকে উঠেছিল। তত দিনে পাকিস্তানিরা প্রায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। তাই তৈরি থাকার পরও আমাদের উভচর বাহিনীকে আর মােতায়েন করা হয়নি। সেনাবাহিনী মনে করে তাদের সব প্রস্তুতি শেষ, সৈন্যরাও আক্রমণ করতে প্রস্তুত রয়েছে, তাই তাদেরই ব্যবহার করা হােক। যা আমরা জানতাম, ওই অঞ্চলে আমাদের কোনাে বাধার মুখে পড়তে হবে না। আমাদের আরও জানা ছিল যে এ এমন এক অনুশীলন, যার মাধ্যমে। জানার সুযােগ হবে আমরা যা অর্জন করতে চাই, তা আদৌ সম্ভব কি না। আসলে ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডকে অভিযান চালানাের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেনেই আমরা উভচর অবতরণের ধারণাটি বিবেচনা করেছিলাম। পরিকল্পনামতাে গুর্খা জওয়ানরা আমাদের এলএসটিতে আরােহণ করে। তাদের অবতরণস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা হয় সংশ্লিষ্ট সব উপাদানের হিসাব-নিকাশে ভুল করি কিংবা জওয়ানরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত ছিল না। ফলে আমাদের কিছু সৈন্য প্রাণ হারায়।
বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মি চূড়ান্ত সত্যের মুখােমুখি হয় ১০ ডিসেম্বর, যেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে পুবদিকের অংশটি মেঘনা নদী অতিক্রম করে। সেদিনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই পূর্বাঞ্চলে। হেরে গেছে। তবে পূর্বাঞ্চলের লড়াইয়ের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের লড়াইয়েরও গভীর সম্পর্ক ছিল, যেহেতু পাকিস্তান এমনটিই চেয়েছিল। সরাসরি যুদ্ধ এড়াতে এবং যুদ্ধ যাতে একই এলাকায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলে চাপ কম রাখার কৌশল নিয়েছিল। এই প্রপঞ্চটি উপলব্ধি করা জরুরি। কারণ, ১০ ডিসেম্বরের পর এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে হেরে গেছে, তবে পশ্চিমাঞ্চলে এই ঘটনার প্রভাব। তখনাে ছিল অনিশ্চিত।
উপমহাদেশের দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই যুদ্ধনাট্যের পেছনে আরেকটি নাটকও মঞ্চায়িত হচ্ছিল, যার দুই কুশীলব যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত
পৃষ্ঠা: ২৫০

ইউনিয়ন। স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে দুটি দেশই পরস্পরকে টেক্কা দিতে চেয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই একদিন আমেরিকার নৌবহর এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল যে ভারত মহাসাগরে সে যদি প্রভাব রাখতে চায়, তবে তা কেবল সমুদ্রপথেই সম্ভব। তাই এন্টারপ্রাইজের অগ্রাভিযানের খবর পাওয়ার পর আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতি বিষয়ে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেওয়ার খবরটি আমরা ১০ ডিসেম্বর বিকেলে গােয়েন্দা সূত্র ও পত্রপত্রিকার খবর মারফত পাই। প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরের যাত্রার খবরটি আমি শুনেছি কি না। আমি হা-বাচক উত্তর দিই। শুনে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনারা কী করতে যাচ্ছেন? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনি কি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায়?’ এবার প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনার এই মন্তব্যের হেতু কী? আমি জবাব দিই, ‘ম্যাডাম, তারা আমাদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে চাইছে। তবে আমাদের উচিত শক্ত থাকা। আমি আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেনদের নির্দেশ দিচ্ছি কোনাে মার্কিন জাহাজের মুখােমুখি হলে তারা যেন পরিচয় বিনিময় করে এবং চা-কফির দাওয়াত দেয়। শুনে প্রধানমন্ত্রী শুধু হাসলেন। এরপর আমি অ্যাডমিরাল কৃষ্ণানকে নির্দেশ দিই, তিনি যেন এ অনুযায়ী সব জাহাজকে নির্দেশ দেন।
এটি সত্য যে ওই সময়ে রাশিয়া তাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মার্কিন জাহাজের গতিবিধি জেনে আমাদের তা অবহিত করত। ১১ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বেশ কিছু বড় ঘটনা ঘটে, যেগুলাের ব্যাখ্যা প্রয়ােজন আছে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের হাইকমান্ডকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে যে বন্ধুভাবাপন্ন পরাশক্তিগুলাে তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসবে। পাকিস্তান এই বন্ধুভাবাপন্ন পরাশক্তিগুলােকে কখনাে ‘সাদা’ আবার কখনাে ‘হলুদ’ বলে উল্লেখ করত। এসব সাংকেতিক শব্দের অর্থ আমাদের জানা ছিল, তাই আমাদের সবকিছু হালকাভাবে নেওয়ার। সুযােগ ছিল না।
১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর এন্টারপ্রাইজের অবস্থান সম্পর্কে কিছু সন্দেহ ছিল। তবে ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে যখন আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যােগাযােগ করা হয়, তখন নৌবহরটি মালাক্কা প্রণালিতে ছিল। আমাদের কাছে এ-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের আগে ও পরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ভূমিকার তফাতটা হবে আকাশ-পাতাল।
পৃষ্ঠা: ২৫১

ওই সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়ার পরও এ কথা সত্য যে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের পর সপ্তম নৌবহরের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী হবে, তা আমরা তখনাে সঠিকভাবে অনুমান করতে পারিনি। যুদ্ধের পর এ বিষয়ে বেশ কিছু বক্তব্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতিচারণা ও অ্যাডমিরাল এলমাে জুমওয়াল্টের আত্মজীবনী ওন ওয়াচ। তবে এই দুজনই নিজের মতাে করে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন। বড় বিষয়গুলােতে দুজনের কথায় মিল থাকলেও খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ে অমিল ছিল। অথচ এ ধরনের খুঁটিনাটি বিষয়ই কোনাে লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করে।
অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট তাঁর আত্মজীবনী ওন ওয়াচ-এ লেখেন, ১৯৭১এর মার্চের দিকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে এবং ভারত মহাসাগরের জন্য একটি সর্বাত্মক মার্কিন নীতি তৈরির সমস্যাটি স্পষ্ট হয়ে। ওঠে। ভারত ও পাকিস্তানের এই দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করতে ওয়াশিংটন সেকশন অ্যাকশন গ্রুপ (ডব্লিউএসএজি) ১৯৭১-এর ১৭ আগস্ট, ৮ সেপ্টেম্বর, ৭ অক্টোবর, ২২ নভেম্বর এবং ১, ৩, ৪, ৬ ও ৮ ডিসেম্বর বৈঠকে বসে। উপর্যুপরি এসব বৈঠক অনুষ্ঠান প্রমাণ করে মার্কিন প্রশাসন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন ছিল। মার্কিন প্রশাসন মরিয়া হয়ে একটা মতৈক্যে পৌছার চেষ্টা করছিল। তবে প্রতিবারই তারা সময় থেকে একধাপ পিছিয়ে পড়ছিল এবং একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তাদের কোনাে কৌশলই কাজ করছিল না। ‘জোরালাে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বা ২১ নভেম্বর ভারতকে অর্থনৈতিক সহায়তা দান বন্ধের ঘােষণা, এর কোনােটাতেই কিছু হলাে না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বললেন, ‘বিশ্ব জনমত যা-ই হােক’, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে এবং এককথায় ভারত তা-ই করেছিল।
অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্টের মতে, ভারতের মত পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়ে কিসিঞ্জারের অগ্নিশর্মা হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এ বিষয়ে আরও বিশদ জানা যায় সুপরিচিত লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার জ্যাক এন্ডারসনের বর্ণনায়। তিনি বলেন, অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানঘেঁষা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা মার্কিন প্রশাসনকে আরও ক্রুদ্ধ করে। নৌবাহিনীর সঙ্গে আলােচনা করেই ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের আদেশে গঠিত হয় টাস্কফোর্স ৭৪। এতে পারমাণবিক বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা বহর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে ভারত মহাসাগরে মােতায়েনের আদেশ দেওয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ২৫২

১২ ডিসেম্বর এন্টারপ্রাইজ গ্রুপকে মালাক্কা প্রণালি ধরে এগােনাের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে পরদিনই আদেশটি পরিবর্তন করা হয় এবং বিশেষ নির্দেশ আসে যে বহরটি যেন দিনের বেলা সামনে অগ্রসর হয়, যাতে আরও বেশি। অবলােকনের সুবিধা পাওয়া যায়। এর চেয়ে আরও বেশি বিভ্রান্তিকর দাবি। হচ্ছে এই যে নৌবহর পাঠানাের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা থেকে মার্কিনদের অপসারণ। এটি ছিল প্রতারণা। কারণ, থেকে যাওয়া কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
একেবারেই ঘটনাক্রমে দুটো বিমানবাহী জাহাজসহ একটি বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীও ভারত মহাসাগরে ছিল। দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ নৌ-এটাশে আমার অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ায় সহায়তা করতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে অবস্থানরত ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলােকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানাে হচ্ছে। আমি তাঁকে উপদেশ দিলাম, যেহেতু সব ব্রিটিশ নাগরিককে এরই মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং যেহেতু ব্রিটেন এই সংঘাত থেকে এখনাে দূরে রয়েছে এবং কদিন বাদে পাকিস্তানকেও আত্মসমর্পণ করতে হবে, এই অবস্থায় যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে খামাখা নিজেদের সুনাম নষ্ট করার কোনাে মানে হয় না।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি সােভিয়েত ডেস্ট্রয়ার এবং মাইন সুইপারও মালাক্কা প্রণালি দিয়ে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। এ ছাড়া সােভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর থেকেও বাড়তি রণসরঞ্জাম আনা হয়। সব মিলে নৌপরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।
জুমওয়াল্টের পরামর্শ অনুসারে এন্টারপ্রাইজকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দূরে থাকার এবং শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে অবস্থান নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।
সােভিয়েত নৌবাহিনী দ্বিতীয় দফা শক্তি বৃদ্ধির পর মার্কিন টাস্ক গ্রুপ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মার্কিন টাস্ক গ্রুপের চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় ছিল। তবে জুমওয়াল্ট দাবি করেন, এন্টারপ্রাইজের উদ্দেশ্য তার কাছে ঠিক স্পষ্ট ছিল না। তিনি শুধু এটুকু জানতেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল সংকটকালে তারা মিত্রদের পাশে দাঁড়ায়।
জুমওয়াল্ট ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ইউএসআইয়ে (ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট) বক্তৃতা দিতে ভারতে আসেন। অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানাের উদ্দেশ্য কী ছিল? জুমওয়াল্ট জবাব দেন, কিসিঞ্জার তাকে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্টের (রিচার্ড নিক্সন) ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্র যেন পাকিস্তানকে সহায়তা করে। ১০ ডিসেম্বর পরমাণু বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজ এবং আরও কিছু
পৃষ্ঠা: ২৫৩

প্রয়ােজনীয় জাহাজ ও সরঞ্জামসহযােগে একটি টাস্ক গ্রুপ সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। এই টাস্ক গ্রুপের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল না। জুমওয়াল্ট কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখােমুখি হলে তারা কী করবেন। কিসিঞ্জার জবাব দেন, এটি আপনার বিষয়।’ ১৯৭১-এর ১৩ ডিসেম্বর জুমওয়াল্টকে ভারত মহাসাগরে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে বলা হয়। সঙ্গে এই নির্দেশ ছিল, জাহাজটি যেন দিনের বেলা মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করে, যাতে বিশ্ববাসী তা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। নির্দেশটি ছিল অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর।
বক্তৃতার পর আমি জুমওয়াল্টকে আমার বাড়িতে দাওয়াত দিই। বাড়িতে এ নিয়ে বিশদ আলােচনা হয়। তিনি জানতে চাইলেন, ওই দিন খবরটি শােনার পর আমার প্রতিক্রিয়া ও পরিকল্পনা কী ছিল। আমি জবাব দিলাম, খবরটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান এবং নৌবাহিনী কী করতে যাচ্ছে, জানতে চান। সব শুনে জুমওয়াল্ট হাসেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। তাঁর আত্মজীবনী ওন ওয়াচ-এর সঙ্গে এই নিবন্ধেরও একটি কপি পাঠিয়ে জুমওয়াল্ট তাতে মন্তব্য করেন : ‘অ্যাডমিরাল এস এম নন্দকে, ১৯৭১ সালে বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা এড়ানাের কৌশল যার জানা ছিল, শ্রদ্ধার সঙ্গেই আর জুমওয়াল্ট। এ যুদ্ধের দিনগুলােতে আমাদের তিন বাহিনীর মধ্যে চমৎকার সমন্বয় ছিল। কর্মকর্তারা প্রতিদিন বৈঠকে মিলিত হতেন এবং সুনির্দিষ্ট অপারেশনগুলাের বিষয়ে পুরােপুরি মতৈক্য হতাে। কিছু অনৈক্যের ঘটনার কথাও আমার মনে পড়ে, যা না ঘটাই ছিল অস্বাভাবিক। তবে এমন একটি ঘটনাও মনে করতে পারছি না, আন্তরিক পরিবেশে যার মিটমাট হয়নি। মাঝেমধ্যে জেনারেল মানেকশ আমার বন্ধু বিমানবাহিনী প্রধান প্রতাপ লালের ওপর চোটপাট করতেন। সে ক্ষেত্রে আমাকেই মীমাংসা করতে হতাে।
১৯৭১-এর যুদ্ধে নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীরই বড় ভূমিকা ছিল এবং এ জন্য জেনারেল মানেকশকে বাড়তি প্রশংসা করতে আমার ঈর্ষা হবে না। মাঝেমধ্যে আমি প্রতাপ লালকেও স্মরণ করিয়ে দিতাম, আমাদের সবাইকে আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। সেনাবাহিনীর আধিপত্য নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের উচিত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা।
সব অপারেশন তিন বাহিনীর মধ্যে ভাগ করা ছিল। বিমানবাহিনীর কাজ ছিল পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামে আবির্ভূত হওয়া অঞ্চলটিতে পাকিস্তানের বিমানশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। বিমানবাহিনীর আওতাবহির্ভূত অঞ্চলে অভিযান চালানাের দায়িত্ব ছিল নৌবাহিনীর এবং অপারেশনের জন্য উভয়কে নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল। আমরা চাইনি আমাদের
পৃষ্ঠা: ২৫৪

বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী ভুল করে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক বা একে অন্যের ওপর হামলা চালাক।
সীমারেখা টানার ফলে একটিও ভুল-বােঝাবুঝির ঘটনা ঘটেনি। আমাদের বিমানবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে হুমকি নিরসন করতে পেরেছিল। আমরা এ খবর জানতাম এবং বিষয়টি আমাদের খুব ভালাে লেগেছিল। এর ফলে আমরা বিক্রান্তকে উপকূলের আরও কাছে মােতায়েন করতে সক্ষম হই। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানিরা পিছু হটার কাজে ব্যবহার করতে পারে, এমন সব নৌযানকে অচল করে দেওয়া।
এমওডি [প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়] প্রতিটি বাহিনীর সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে থাকে এবং সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ‘৭১-এর যুদ্ধে এমওডির ইতিবাচক ও সহযােগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আন্তবাহিনী সম্পর্ক ও সহযােগিতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল নিজে ভূমিকা রেখে এটি সম্ভব করে তুলেছিলেন। এর ফলে তিন বাহিনীর সদর দপ্তরের সব স্টাফ ও এমওডি একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে সক্ষম হন। তাঁদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অপারেশনের সীমারেখাকে নিখুঁত করায় সহায়ক হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে চমৎকার। সহযােগিতা ও টিমওয়ার্ক নিশ্চিত করে। এ সংকটকালে কে বি লালের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের নজির হিসেবে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুদ্ধ চলছে, এমন অঞ্চলে জেলেদের। উপস্থিতি সব সময়ই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইউনিয়ন ওয়ার বুক’-এ এ রকম একটি বিধান রয়েছে, লড়াইয়ের সময় উপকূল এলাকায় মাছ ধরা। অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনা থেকে এ নিয়ম করা হয়। ওই সময় কিছু ইউ-বােটে পাল লাগিয়ে সেগুলাে জেলেনৌকার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই থেকে পূর্বসতর্কতা হিসেবে জেলেদের সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ায় বাধা দেওয়া হয়।
এ রকম একটি বিধানের কথা আমিও দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম। আসলে ১৯৬৫ সালে আমরা আমাদের নিজেদের জেলেদের তাড়িয়ে এলাকা নিষ্কণ্টক করতে অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় করি। আমি ভাবছিলাম এ ধরনের কোনাে নিয়ম আমাদের পরিবেশে প্রয়ােজনীয় কি না। কারণ, আমাদের নিজেদের। জেলেদের দুর্দশা বাড়ানাে এবং জীবিকা আহরণ থেকে তাদের বঞ্চিত করা। ছাড়া বেশি কিছু এ থেকে অর্জিত হয় না। অন্যদিকে আমরা যদি তাদের ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে সমুদ্রে যেতে বলি, তবে তারা আমাদের গােয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং আমাদের জলভাগে সন্দেহজনক কিছু দেখলেই খবর পাঠাতে পারে। তাদের অতি কষ্টে পাকড়াও করে সময় অপচয় করার বদলে এভাবে উপকূলে নজরদারির কাজে লাগানাে যায়।
পৃষ্ঠা: ২৫৫

আমি কে বি লালের সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে এই ভাবনাটি বিনিময় করি এবং ইউনিয়ন ওয়ার বুক সংশােধন করার প্রস্তাব দিই। প্রতিরক্ষাসচিব তাৎক্ষণিকভাবে আমার প্রস্তাবের উপযুক্ততা উপলব্ধি করেন এবং আমাকে স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। বিস্তারিত আলােচনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করে, যুদ্ধের সময় জেলেরা যেন কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে একটি টিম হিসেবে কাজ করে এবং কোনাে অপরিচিত নৌকা দেখলে আমাদের খবর দেয়। এর ফলে অনেক কষ্টসাধ্য কাজের সহজ সমাধান মিলে যায় এবং যুদ্ধের গােয়েন্দা তৎপরতায় যােগ হয় অনবদ্য এক সহায়তা। জেলে সম্প্রদায় তাদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই খুশি হয়েছিল। তবে যুদ্ধে শরিক হওয়া এবং নজরদারির জন্য অর্থ পাওয়ার বিষয়টি তাদের খুব আগ্রহী করে তােলে।
৩-৪ ডিসেম্বর রাতে ভিজাগ [Vizag] বন্দরের প্রবেশপথে একটি অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক শব্দের সূত্র ধরে গাজিকে শনাক্ত ও ধ্বংস করা হয়েছিল। জেলেরাই সেদিন ওই শব্দ শুনে যুদ্ধ-নজরদারি সংগঠনকে খবরটি দিয়েছিল। এভাবেই একটি সরল সংশােধনীর ফলে শত শত জেলেকে দেশের সেবায় নিয়ােজিত করা সম্ভব হয়। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে আমার শৈশব কেটেছিল সমুদ্রের ধারে আর ওই সব মানুষের সান্নিধ্যে, যাদের জীবন-জীবিকা একান্তই সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। জেলেদের নৌবাহিনীর প্রতিবন্ধক হিসেবে নয়, সহায়ক হিসেবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্ভবত আমি আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকেই অর্জন করেছিলাম।
পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ১৬ ডিসেম্বর লে. জেনারেল এ কে নিয়াজি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তবে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাকিস্তানের গ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার আন্তর্জাতিক সময় রাত আটটায় দুই ফ্রন্টেই লড়াই বন্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়।
অনুবাদ : গাউস রহমান পিয়াস ও ছিদ্দিক মন্জু
পৃষ্ঠা: ২৫৬

Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!