You dont have javascript enabled! Please enable it!

চুড়ান্ত যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনী

এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল

এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লাল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। প্রায় ৩৩ বছর চাকরি শেষে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে চাকরি থেকে অবসর নেন। চাকরিজীবনের স্মৃতি নিয়ে পি সি লাল ইংরেজিতে একটি স্মৃতিমূলক বই লিখেন, নাম মাই ইয়ারস উইথ আইএফএ। (প্রকাশক : আইএমএইচ দিল্লি, ভারত, ১৯৯৫ সাল)। বইয়ে পি সি লাল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ভূমিকার উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৯৮২ সালের ১৩ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। নিচে পি সি লালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বর্ণনার কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত করে উপস্থাপন করা হলাে।

যুদ্ধের পরিকল্পনা। যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে এয়ার মার্শাল চ্যাটার্জি নিজে গিয়ে সর্বশেষ পরিকল্পনাটি এয়ার মার্শাল দেওয়ানের [ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক] হাতে দিয়ে এলেন। তাদের এ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল যে তারা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারবে। ঘাঁটিগুলাে প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড তাদের আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টারকে জানাবে, আর সেখান থেকে তা জানানাে হবে দিল্লির হেডকোয়ার্টারকে। আক্রমণের লক্ষ্যগুলাে ২৪ ঘণ্টা আগে স্থির করা হবে। প্রথম কর্তব্য হবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যথাসম্ভব ক্ষতি করা এবং নিজেদের দেশের আকাশ ও মাটিকে রক্ষা করা। সেনাবাহিনীকে সাহায্য করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে। ৪ নম্বর কোরের সাহায্যের অনুরােধগুলাে প্রথমে বলা হলাে শিলংয়ে পাঠাতে, কিন্তু তারপর বলা হলাে গুয়াহাটিতে পাঠাতে। আর ২ নম্বর

পৃষ্ঠা: ২৩২

কোরেরগুলাে কলকাতায়। যুদ্ধের পুরাে সময়টিতে সেনাবাহিনীর একটি অনুরােধও প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। বিমানবাহিনীর ৬০-৭০ শতাংশ কর্মকাণ্ড এই বিশেষ কাজে নিয়ােজিত ছিল। কিন্তু নৌসেনাদের সঙ্গে সমন্বয় এত সহজে হয়নি। একটা উদাহরণ দিই। জাতিসংঘের বিমান যখন বিশেষ কাজে ঢাকায় এল, নৌসেনাদের জানানাে হলাে তার ওপর গুলি না চালাতে। তা সত্ত্বেও ‘বিক্রান্ত’ [আইএনএস বিক্রান্ত, বিমানবাহী নৌজাহাজ] থেকে অ্যারােপ্লেন উড়ে এসে তার ওপর গুলি চালাল। ভাগ্যিস! তাদের লক্ষ্যটা খারাপ ছিল। গুলি লাগল না।

আসামের পূর্ব প্রান্তে জোরহাট ঘাঁটির কমান্ডার ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। জোরহাট ঘাঁটিতে বেশি ব্যস্ততা ছিল না। এ ভদ্রলােকের নানা গুণ ছিল—মৌলিক চিন্তায়, নেতৃত্বে, ক্ষমতায় ও কাজে। ওড়ারও প্রচণ্ড শখ ছিল।

ন্যাটদের [Gnat] কাহিনি

২২ নম্বর ন্যাট স্কোয়াড্রনকে কলাইকুন্ডায় (মেদিনীপুর) রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তাদের দমদমে আনা হয়। পাকিস্তানি বিমানের প্রথম কয়েকবারের অনধিকার প্রবেশ আমাদের ছেলেরা প্রতিরােধ করতে পারেনি। ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে খুব যুদ্ধ হয়, ট্যাংক-কামানসহ। আমাদের সেনারা ১৩টা পাকিস্তানি ট্যাংক নষ্ট করে দেয়। ২২ নভেম্বর সকাল ৮টা বেজে ১১ মিনিটে রাডারে ধরা পড়ল—যশােরের দিক থেকে পাকিস্তানি বিমান আসছে। আমাদের চারটে ন্যাট আকাশে উঠে তাদের আক্রমণ করামাত্র তারা নিজের দেশে ফিরে গেল। দ্বিতীয়বার সকাল ১০টা বেজে ২৮ মিনিটে আবার তাদের তাড়ানাে হলাে। তৃতীয়বার বেলা ২টায় আবার আমাদের রাডারে তাদের দেখা গেল। মিনিট দুই তাদের দেখা গেল। দুই হাজার ফুট (আন্দাজ ৬০০ মিটার) ওপরে উঠে আক্রমণ করতে উদ্যত। ২টা বেজে ৪৯ মিনিটে হুকুম হলাে, স্ক্র্যাম্বল’ (স্ক্র্যাম্বল’-এর অর্থ হলাে সংকেত পাওয়ামাত্র নিজেদের জঙ্গি বিমানের সাহায্যে শত্রু বিমানকে আক্রমণ করা)। ২টা বেজে ৫১ মিনিটে দমদম থেকে উড়ে গেল চারটে ন্যাট, চার হাজার ফুট ওপর দিয়ে।

পাইলট ম্যাসি প্রথম আঘাত করল একটি স্যাবরকে। ক্ষতিগ্রস্ত স্যাবরটি স্বদেশ অভিমুখে রওনা হলাে বটে, কিন্তু চৌগাছায় একটা পুকুরে পড়ে গেল। তার পাইলট ছিল উইং কমান্ডার চৌধুরী। অন্য দুই পাইলট, যারা বন্দী হলেন, তাঁদের নাম ফ্লাইট লে. পারভেজ মেহদি কুরেশি ও

পৃষ্ঠা: ২৩৩

ফ্লাইং অফিসার খালিল আহমেদ। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গণপতি আর ফ্লাইং অফিসার ল্যাজারস ছিলেন তিন আর চার নম্বরের অ্যারােপ্লেনে। ঠিক তিনটার সময় গণপতি চিৎকার করে উঠলেন, ‘খুন! খুন! খুন!’ স্যাবরগুলাে ন্যাটগুলাের ঠিক সামনে। গণপতি আর ল্যাজারস গুলি চালাতে লাগলেন। লক্ষ্যবস্তু গুলিবিদ্ধ হলাে। দুই শত্রু পাইলট বিমান থেকে লাফিয়ে পড়লেন। বিধ্বস্ত বিমান দুটি বনগাঁয়ে ধরাশায়ী হলাে। একটা স্যাবর ধরা গেল না। আমাদের চার পাইলট নির্বিঘ্নে ফিরে এলেন। বরাবর যুদ্ধ—চারটি সেববের বিরুদ্ধে চারটি ন্যাট। পাকিস্তানিদের লােকসান হলাে কিন্তু তাদের বিবৃতিতে তারা ঠিক কথা লিখল না। জেনারেল ফজল মুকিম খান, সৈয়দ সব্বির হুসেন এবং স্কোয়াড্রন লিডার এম তারিক কুরেশি তাদের বইয়ে লিখেছেন, আট-দশটা ন্যাট চারটা সেবরের পেছনে লেগে তিনটার বিনাশ করেছে।

তিনটা স্যাবর হারিয়েও পাকিস্তান আক্রমণ বন্ধ করল না। পরদিন সকালে আবার চারটে স্যার এসে হাজির। পানাগড় (বর্ধমান) থেকে দুটো আর কলাইকুন্ডা থেকে দুটো, চারটা মিগ এদের তাড়ানাের জন্য এল। কিন্তু এরা পৌছানাের ঠিক এক মিনিট আগে স্যাবরগুলাে ফিরে চলে গেল। পরদিন, ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি’ ঘােষণা করলেন।

কিছুদিন ধরে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে আমরা অনেকগুলাে বিমানঘাঁটি তৈরি করেছিলাম, যাতে এগুলাে উত্তর সীমান্তের সুরক্ষার জন্যও কাজে লাগে। এগুলাে হলাে কলাইকুন্ডা, দমদম ও ব্যারাকপুর, পানাগড়, উত্তর বাংলায় বাগডােগরা এবং হাসিমারা, আসামের গুয়াহাটি এবং শিলচরের কাছে কুম্ভীরগ্রাম, যেখান থেকে মিজো পাহাড় ও নাগাল্যান্ডেও মালপত্র সরবরাহ করা হতাে। [ ৩ ডিসেম্বর[ রাতে আমাদের ছেলেরা গিয়ে তেজগাঁ ও চট্টগ্রামের ঘাঁটি দুটোতে বােমা ফেলে এল। ৪ ডিসেম্বর সকালে আমাদের জঙ্গি বিমানের দল গিয়ে তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় হানা দিল। এ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটা ছােট অংশ ছিল। প্রথমে তাদের ওপর হামলা চালানাে হলাে। পরে তাদের বিমানঘাঁটির রানওয়েগুলােতে বােমা ফেলে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি করা হলাে, তাদের বিমান থাকা সত্ত্বেও তারা উড়তে পারল না। আকাশে আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলাে। তখন আমাদের একমাত্র কাজ হলাে আমাদের সেনাবাহিনী, যারা রাজধানী ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল, তাদের সাহায্য করা।

পৃষ্ঠা: ২৩৪

২২ নম্বর ন্যাট স্কোয়াড্রনের পাইলটরা, যাঁরা বিমানগুলাে পরিচালনা করেছিলেন, তাঁদের কাজ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁদের ১২টি বিমান প্রত্যহ উড়েছে। সবসুদ্ধ ২৫০ বার উড়ে আক্রমণ করেছে। প্রথম দুই দিন ছিল প্রতিরােধের দায়িত্ব, এরপর সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা—যশাের, ঈশ্বরদী, সাতক্ষীরা, গােয়ালন্দ ঘাট, কুষ্টিয়া, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বরিশাল, টাঙ্গাইলে প্যারাট্রপ নামানাে—এবং ক্যানবেরা বিমানগুলােকে যখন দিনের বেলায় বােমা ফেলতে পাঠানাে হতাে, তখন তাদের রক্ষা করা। ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর তাদের কাজ ছিল ছােট ছােট নৌকা বা স্টিমারে করে ছদ্মবেশে যে। পাকিস্তানি সেনারা পালানাের চেষ্টা করছিল, তাদের ওপর গুলি চালানাে। মুক্তিবাহিনী এ খবরগুলাে দিচ্ছিল, আর অ্যারােপ্লেন থেকে দেখাও যাচ্ছিল। আরও দুটি ন্যাট স্কোয়াড্রন, উইং কমান্ডার এম এম সিংয়ের নেতৃত্বে ১৫ নম্বর [ন্যাট] স্কোয়াড্রন এবং উইং কমান্ডার বাধাওয়ারের নেতৃত্বে ২৪ নম্বর [ন্যাট] স্কোয়াড্রন, পূর্ব থেকে নিয়ােজিত ছিল।

ত্রিপুরায় এমন কোনাে বিমানঘাঁটি ছিল না, যেখান থেকে আমাদের। জঙ্গি বিমান উঠতে-নামতে পারে। আর আগরতলার বিমানঘাঁটির অবস্থান। সীমানার খুবই কাছে। ইয়াহিয়া খানের রণহুংকার যখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তখন আমরা ভাবতে লাগলাম যে এর মােকাবিলা কী করে করা যায়। একমাত্র জঙ্গি বিমান, যা আগরতলার মতাে ছােট বিমানঘাঁটিতে ওঠানামা করার চেষ্টা করতে পারে, তা ছিল ন্যাট। এম এম সিং এবং বাধাওয়ারকে এ বিষয়ে ভেবে দেখতে বলা হলাে। এম এম সিং গিয়ে আগরতলার রানওয়েটা মেপে এলেন। ১৫ নম্বর স্কোয়াড্রন তখন উত্তর বাংলার বাগডােগরায়। সেখানকার রানওয়ের ওপর তিনি আগরতলার রানওয়ের মাপ, ১ হাজার ৫০০ বা ১ হাজার ৬০০ গজ, চিহ্নিত করলেন। তিনি নিজে সেই চিহ্নিত করা এলাকার মধ্যে বিমান ওঠানামা করে। দেখলেন এবং নিজের স্কোয়াড্রনের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার নিলেন। যুদ্ধের শুরুতে তারা ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে বেশ সাহায্য করে। তারপর তাদের দমদমে পাঠানাে হয়। সেখান থেকে ২২ নম্বর স্কোয়াড্রনের সঙ্গে তারা সেনাবাহিনীকে অনেক সাহায্য করে—চালনায়, খুলনায়, বরিশালে, ঝিনাইদহে, মাগুরায়, চাঁদপুরে, ঢাকায়, কুষ্টিয়ায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজে। জলপথে পলায়নপর পাকিস্তানিদের ওপরও গুলি চালায়। নৌবাহিনী দাবি করে যে তারা চালনা বন্দর সমুদ্রের দিক থেকে পুরােপুরি ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু আকাশ থেকে দেখা গেল যে আসলে তা নয়। মালপত্র ও যাত্রী নিয়ে। নৌকা ঠিকই যাতায়াত করছে। বিক্রান্ত জাহাজটার ওপর যে সি-হক্স বিমানগুলাে ছিল, তাদের গতি স্যাবরের চেয়ে অনেকটা মন্থর। কাজেই

পৃষ্ঠা: ২৩৫

যতক্ষণ না আমাদের বিমানবাহিনী স্যারগুলাের আকাশে ওড়া বন্ধ করল, ততক্ষণ সি-হক্সগুলােও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি।

২৪ নম্বর স্কোয়াড্রন প্রথমে ছিল কলাইকুন্ডায়। তারপর তাদের আসামের তেজপুরে ৩০ নম্বর স্কোয়াড্রনের সঙ্গে জায়গা বদলি করতে পাঠানাে হলাে। সেখান থেকে আবার স্কোয়াড্রন লিডার জয়কুমারকে শিলচরের কুম্ভীরগ্রামে পাঠানাে হলাে বিমানগুলাে নিরাপদে রাখার জন্য সঠিক অবস্থান পরীক্ষা, অবস্থানের উন্নয়ন সাধন, লােকেদের থাকার ব্যবস্থা এসব ঠিক আছে কি না, তা দেখতে। ১২ ডিসেম্বর ২৪ নম্বর স্কোয়াড্রনকে আগরতলা পাঠানাে হলাে, আর ১৫ নম্বর স্কোয়াড্রনকে ১৫ তারিখে।

হান্টারদের [Hunter] কাহিনি হান্টারদের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে মিগ দেওয়ার কথা তুলেছিলাম। ১৭ নম্বর [হান্টার] স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক উইং কমান্ডার চত্ৰথ [Narindra Chatrath] অত্যন্ত বিরক্তি এবং দম্ভের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হান্টারদের অন্য কারও সুরক্ষার দরকার পড়ে না। তারা নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়ে। উইং কমান্ডার সুন্দরেশনের নেতৃত্বে ১৪ নম্বর (হান্টার] স্কোয়াড্রন প্রথমে ছিল কলাইকুন্ডায় এবং এরপর আমাদের সেনাদের অগ্রযাত্রার সহায়তা করতে যশােরে গেল। ১৭ নম্বর আর ৩৭ নম্বর হান্টার] স্কোয়াড্রন। রইল উত্তর বাংলায়, আমাদের নবপ্রতিষ্ঠিত ঘাঁটি হাসিমারায়। হান্টাররা যতটা জ্বালানি নিতে পারে, তা নিয়ে হাসিমারা থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসা করে ঢাকার ওপর ১০ মিনিটের মতাে থাকা সম্ভব। বিমানগুলােতে চারটে করে ট্যাংক লাগানাে যায়, আর প্রতিটি ট্যাংকে ১০০ গ্যালন তেল ধরে। এ হান্টারগুলাের নির্ধারিত কাজ ছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে তাদের ধ্বংস করা। দ্বিতীয় কাজ, সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা। এগুলােতে চারটে করে বন্দুক বা ছােট কামান লাগানাে থাকে। তা ছাড়া এরা বােমা এবং রকেট ফেলতে ও ছুড়তে পারে। এদের বিশদ কার্যসূচি ঠিক করার দায়িত্ব ছিল শিলংয়ে অবস্থিত পূর্বাঞ্চল এয়ার কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের। ১৭ এবং ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের কেন্দ্রীয় অফিস হাসিমারায় রইল। কিন্তু ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের একটা ফ্লাইট’, মানে আট কি দশটি বিমানকে ৪ ডিসেম্বরে কুম্ভীরগ্রামে পাঠানাে হলাে। ওখান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আরও কাছে। সেখান থেকে ঢাকার আগে চট্টগ্রাম অবধি বা তত দূরের যেকোনাে জায়গায় যাওয়া সম্ভব।

পূর্বাঞ্চল এয়ার কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের এই দুই হান্টার স্কোয়াড্রনের

ওপর নির্দেশ ছিল তারা ৪ ডিসেম্বর ভােরের আলােয় ঢাকায় গিয়ে স্যাবরগুলােকে ভূমিতে থাকতেই আক্রমণ করবে। চারটে বিমান উড়ল, তবে একটার কলকবজা কিছুটা বিগড়ে গিয়েছিল, ফলে নিচের চাকাগুলাে বন্ধ হচ্ছিল না। তাই তিনটি বিমান পদ্মার ওপর খুবই নিচু দিয়ে অভিযানে গেল। নদীর ওপর ভােরের ঘন কুয়াশা, দৃষ্টি চলে। ঢাকায় রাডার ছিল, আর রেডিও সেট নিয়ে তাদের অন্য সতর্কতামূলক পাহারার ব্যবস্থাও মােতায়েন ছিল। তাদের কাছে খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ চারটে স্যাবর আকাশে উড়ে আমাদের বিমানগুলােকে বাঁ দিক থেকে আক্রমণ করল—’যুদ্ধংদেহী। আমাদের বিমানগুলাে তখন ঢাকার ২০ মাইল দূরে।

হান্টাররা নিজেদের বাড়তি তেলের ট্যাংকগুলাে ফেলে দিল। হালকা না হলে গতি বাড়ানাে যায় না, লড়াই করা যায় না। গাছগুলাের ঠিক মাথার ওপরে তিন-চার মিনিটের লড়াই। চত্ৰথ যে স্যাবরটার ওপর গুলি চালাল, সেটা জ্বলতে আরম্ভ করল। চত্রথের বিমানেও গুলি লাগল, তবে সৌভাগ্যবশত আগুন ধরেনি। স্যাবরের পাইলট ‘ইজেক্ট’ করল–প্যারাস্যুট নিয়ে নিচে নামল। অন্য দুটি হান্টার নিরাপদে ফিরতে পারল। স্যারের। বন্দুক বা ছােট কামানের সঙ্গে ‘মিসাইল’ও ছিল। আমাদের হান্টারদের তা ছিল না।

হাসিমারা ও কুম্ভীরগ্রাম—এ দুই ঘাঁটি থেকে মৌলভীবাজার, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, ময়নামতি, লালমাই ইত্যাদি জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনীকে প্রচুর সাহায্য করা হয়। উত্তরের দুটো জায়গায় পাকিস্তানিরা ভারতীয় বাহিনীকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরােধ করেছিল—একটা হলাে কামালপুর এবং অন্যটা জামালপুর-কামালপুর ও টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি।

প্রথম দিনের যুদ্ধে আমরা ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের দুটো হান্টার হারাই, একটা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কামানের গােলায়, অন্যটা স্যাবরের গুলি লেগে। এ ছাড়া কুম্ভীরগ্রাম থেকে আমরা আরও কয়েকটি বিমান ও কয়েকজন তরুণ পাইলট হারাই। কিন্তু ওদের রানওয়েগুলাে আমাদের পাইলটরা নষ্ট করে দিলে ৬ তারিখ থেকে স্যার আর উড়তে পারল না। ‘ট্যাক্স’ (টেকনিক্যাল এয়ার সেন্টারস) আর ফ্যাক্স’গুলাে (ফরােয়ার্ড এয়ারকন্ট্রোলারস) খুব ভালােভাবে কাজ করল।

৬ ডিসেম্বর বিকেলবেলা উইং কমান্ডার চত্ৰথ আরেকটি বিমান সঙ্গে নিয়ে আর্মির সাহায্যার্থে হিলির দিকে গেলেন। গ্রাউন্ড লিয়াজন অফিসার’ (জিএলও) মেজর ধাবন ম্যাপে দেখিয়ে দিলেন শত্রুপক্ষ কোথায় আছে। হিলি পৌছানাের মাইল পাঁচেক আগে এক জায়গায় সৈন্যসামন্ত, ট্যাংক আর খুব ধুলাে উড়তে দেখা গেল। জিএলও যা বলেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল

পৃষ্ঠা: ২৩৭

যে জায়গাটা আমাদের দখলে। হান্টার দুটো ছয় হাজার থেকে আট হাজার ফুটের মধ্যে উড়ছিল। তারা অনেকটা নিচে নেমে এসে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বােঝার চেষ্টা করল, এরা ভারতীয় না পাকিস্তানি। আকাশে উড়ন্ত দ্রুতগতির বিমান থেকে তা বােঝা সহজ ছিল না। লােকগুলােকে একই ধরনের দেখতে লাগছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজ-সরঞ্জামেও বিশেষ তফাত নেই। এমন সময় তারা নিচ থেকে বিমানের দিকে গুলি চালাতে আরম্ভ করল। দ্বিধা কেটে গেল। বিমান দুটি থেকে গােটা তিনেক ট্যাংকে অগ্নিগােলা নিক্ষেপ করে ফিরে এল।

অভিযান থেকে এসে খবর দিতে হয়, কী করে এলাম। বিমানে ক্যামেরা লাগানাে থাকে, কী করা হলাে, তার ছবি উঠে যায়। দেখেশুনে জিএলও সাহেবের তাে মনে হলাে যে ওরা স্বপক্ষের ওপরই গুলি চালিয়ে এসেছে। নিজেদের দোষী ভেবে তাদের ভীষণ মনখারাপ। জিএলও তাদের সান্ত্বনা দিলেন, যুদ্ধে কখনাে কখনাে এ রকম হয়ে থাকে, তার জন্য বিষন্ন হয়াে না। ইচ্ছা করে তাে আর করােনি।’ ইত্যাদি। কিন্তু মাঝরাতে ৩৩ নম্বর কোর হেডকোয়ার্টার্স থেকে বার্তা এল, ‘শাবাশ! অনেক ধন্যবাদ।’ দুই পাইলট স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

৬ তারিখের পর হান্টারগুলােকে নদী, উপকূল, সমুদ্র জাহাজ, রেল ছাউনি, বিমানঘাঁটি আক্রমণ করার দায়িত্ব দেওয়া হলাে। বগুড়ার ছাউনিতে পাকিস্তানি ১৬ নম্বর ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার্স বা সদর দপ্তর। রংপুরেও প্রচুর পাকিস্তানি সেনা মােতায়েন ছিল। এদের উৎসাহ এতটা প্রবল ছিল যে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত বিপদাশঙ্কার সম্মুখীন হয়েও তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করছিল। পূর্বাঞ্চল এয়ার কমান্ডের হেডকোয়ার্টার্স থেকে এদের তা করতে মানা করা হলাে। আরও সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ করতে বলা হলাে। যুদ্ধে ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রন তিনটি বিমান ও তিনজন পাইলটকে হারায়। দুটি স্যাবর ধ্বংস করে। তা ছাড়া আর্মিকে প্রচুর সাহায্য করে। ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের ক্ষতি আরেকটু বেশি হয়। কিন্তু দুই স্কোয়াড্রন মিলে প্রচুর কাজ করেছিল।

‘সুখয়’দের ইতিবৃত্ত। যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে সুখয় স্কোয়াড্রনগুলাে কীভাবে নিজেদের শাণ দিয়ে তৈরি করল, তা লিপিবদ্ধ করে রাখার যােগ্য। উইং কমান্ডার শ্রীধরন ২২১ নম্বর সুখয় স্কোয়াড্রনের নেতৃত্বে ছিলেন। সুখয়। আমরা রাশিয়া থেকে নিই। ১৯৬৮-র মাঝামাঝি এগুলাে স্কোয়াড্রনে আসে। ঘাঁটি হিসেবে তিনি বেছে নিলেন পানাগড় (বর্ধমান)। অক্টোবর মাসে স্কোয়াড্রনটা উত্তর প্রদেশের বেরিলি থেকে এখানে এল।

৪ ডিসেম্বর, প্রথম দিনের যুদ্ধে এরা তেজগাঁওয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি

পৃষ্ঠা: ২৩৮

স্যার নষ্ট করে দেয়, পাঁচটা ছােট জাহাজকে ঘায়েল করে এবং সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। মুক্তিবাহিনী এদের অনেক খবর এনে দিয়েছিল। ৫, ৬, ৭ তারিখে যখন আমাদের সেনারা যশাের ও ঝিনাইদহ দখল করে, তখন এরা প্রচুর সাহায্য করে। কিছু বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের সেনাদের সঙ্গে ছিলেন। যশাের আমাদের হস্তগত হওয়ার পর সেনারা যখন খুলনার দিকে যাচ্ছিল, তখন এই সুখয়গুলাে কেমন সাহায্য করেছিল, তা লন্ডনের সানডে টাইমস কাগজেও বেরিয়েছিল। পরের তিন দিন কুষ্টিয়া দখল করতে লাগল। ১১ ডিসেম্বর বােমা ফেলে এরা হার্ডিঞ্জ সেতুর অধিকাংশটা উড়িয়ে দিল, মানে ডুবিয়ে দিল।

১৪ ডিসেম্বর অবধি শ দেড়েকবার এরা শত্রুর এলাকায় উড়ে গিয়ে। লড়াই চালায়। তারপর এদের পূর্ব থেকে পশ্চিম সীমান্তের অমৃতসরে পাঠানাে হলাে।

‘মিগ’দের [MiG] বীরগাথা

উইং কমান্ডার বি কে বিষ্ণয় [Bhupendra Kumar Bishnoi] ১৯৭০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি মিগ ২১-এর চালক ছিলেন আর ২৮ নম্বর [মিগ] স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। স্কোয়াড্রনটা প্রথমে আসামের তেজপুরে ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ হলে এটি গুয়াহাটিতে এল। ৪ নম্বর [মিগ] স্কোয়াড্রনও তখন গুয়াহাটিতে ছিল। [৩ ডিসেম্বর] রাত ১০টায় ডাক এল, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের দায়িত্ব ছিল নির্দেশ অনুযায়ী এগিয়ে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা, নিজের দেশকে পাহারা দেওয়া, সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা আর নিজেদের বিমান যখন বিপক্ষের ঘাঁটির ওপর হানা দিতে যায়, তখন তাদের সঙ্গে থেকে তাদের রক্ষা করা। ৪ ডিসেম্বর হান্টাররা যখন হাসিমারা থেকে ভােরের আলাে-আঁধারে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি আক্রমণ করতে গেল, তখন গুয়াহাটি থেকে ৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটে মিগ এদের রক্ষক হিসেবে গেল—যদিও হান্টারদের এতে একটু আপত্তি ছিল, এতে তাদের সম্মানে বাধে।

এরা ফিরে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে অপর চারটি মিগ উইং কমান্ডার বিষ্ণয়ের নেতৃত্বে আক্রমণের উদ্দেশে রওনা হয়। লক্ষ্য ছিল তেজগাঁও। সেখানে অপারেশনাল রেডিনেস প্ল্যাটফর্মে স্যাবরগুলাে ডাক পড়া মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে ওড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। দুটো মিগ আক্রমণ

পৃষ্ঠা: ২৩৯

করবে আর অন্য দুটো এদের রক্ষা করবে। এই দ্বিতীয় জোড়ার নেতা ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার মনবীর সিং। রকেট চালিয়ে আক্রমণের শেষে ওপরে উঠে আসার সময় উইং কমান্ডার বিষ্ণয়ের চোখে পড়ল, একটা স্যাবর ওড়ার চেষ্টা করছে। বিষ্ণয় স্কোয়াড্রন লিডার সিংকে তা জানালে সিং তার ওপর দুটো কে ১৩’ মিসাইল চালালেন। কিন্তু শিকার কি সর্বদা বিদ্ধ হয়?

ফিরতি পথে তারা যখন নিজের নিজের গােলাবারুদ সব উজাড় করে ব্যবহার করছিল, তখন দ্বিতীয় জোড়ার দ্বিতীয়জন, তরুণ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুবায়া, বলল যে সে আরও একটা স্যাবরকে উড়তে দেখেছে। বিষ্ণয় জিজ্ঞাসা করলেন, তােমার ট্যাংকে কত তেল আছে?’ উত্তর এল, ‘৯০০ লিটার। বিষ্ণয় হুকুম দিলেন আর লড়াইয়ে এগিয়াে না। সােজা নিজের ঘাটিতে ফিরে যাও। বাকি তিনজন গতি কমিয়ে একটু ছড়িয়ে পড়ে শত্রু-বিমান অন্বেষণ করলেন।

২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের পাইলটরা প্রতিদিনে দু-তিনবার করে শত্রুর এলাকায় উড়ে যুদ্ধ করেছে, সবাই মিলে ন্যূনাধিক ৩২০ বার। রক্ষক হিসেবে ওড়ার হিসাব এর মধ্যে নেই, সেগুলাে বাড়তি।

গােয়েন্দা বিভাগ থেকে বা মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে আমরা একদম জানতে পারিনি যে বিপক্ষের বিমানগুলাে কোথায় এবং কীভাবে রাখা হয়েছিল। তাই আমরা রকেট বেশি ব্যবহার করতে পারলাম না-করলেও তা থেকে বেশি ফল পেলাম না। যে সুবিধাটা পাওয়া উচিত ছিল, তা কাজে লাগাতে পারলাম না। পরাজয়ের পর যুদ্ধ শেষে জানতে পারি যে ওরা যেখানে ওদের বিমানগুলাে রাখত, তার কোনাে ছাদ ছিল না, শুধু জাল দিয়ে ঢাকা থাকত। গন্তব্যস্থলে পৌছে প্রথমবারেই লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ করা কঠিন। প্রথম দফায় তার অবস্থান ঠিক করে দেখে নিয়ে দ্বিতীয়বারে অস্ত্র প্রয়ােগ করলে তা সফল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তা না করতে পারলে সমস্ত প্রয়াস, সময়, সম্ভার, নিজের জীবন—সব বিফল হয়ে যায়।

বিষ্ণয় যখন তাঁর প্রথম আক্রমণটা বা ‘সর্টি’ থেকে ফিরে এলেন, দেখা গেল, তার বিমানে দুটি গুলি লেগেছে, সম্ভবত চীনের তৈরি ছােট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট বা ‘অ্যাক-অ্যাক’ কামান থেকে।

পরের দিন ৫ ডিসেম্বর, এরা আবার তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে গিয়ে রানওয়ের ওপর রকেট চালিয়ে এল। কিন্তু বিষ্ণয় বুঝতে পারলেন যে রকেট দিয়ে রানওয়ের বেশি ক্ষতি করা যাচ্ছে না। তাই গুয়াহাটি বিমানঘাঁটির অধ্যক্ষ গ্রুপ ক্যাপ্টেন ওয়লেন পরামর্শ দিলেন, ‘বােমা ব্যবহার করাে। এদের কিছু বিমান সেদিন গিয়ে ঢাকার উত্তর-পূর্বে, সিলেটের দক্ষিণে। মৌলভীবাজারে আমাদের সেনাদের সাহায্য করে এল।

পৃষ্ঠা: ২৪০

৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে বিষ্ণয় নিজের দলবল নিয়ে। [বিমানবন্দর] গিয়ে রানওয়ের ওপর বােমা ফেলে এলেন। যুদ্ধের সময়। বিমানগুলাে যেভাবে নিচু দিয়ে যায়, সেভাবে রানওয়ের কাছে পৌছে উঁচুতে উঠে গিয়ে রানওয়ের ওপর একের পর এক বােমা ফেলল। এতে ২০ ফুট গভীর, ৪০ ফুট চওড়া বেশ কিছু গর্তের সৃষ্টি হলাে। রানওয়ে রক্ষা করার জন্য সাধারণত রানওয়ের দুই পাশে সারি সারি ‘অ্যাক-অ্যাক’ কামান লাগানাে থাকে। তাই তাদের থেকে বাঁচার জন্য বিমানগুলাে আড়াআড়িভাবে ওড়ে। কিন্তু এ সময়ে প্রয়ােজনের তাগিদে বিপদ মাথায় নিয়েও বিষ্ণয় রানওয়ের ওপর সােজা বিমান চালিয়ে বােমা ফেললেন। দুপুরে আবার গেলেন। গিয়ে দেখেন যে ওই বিরাট গর্তগুলাে ভরে ফেলা হয়েছে। তিনি এবং তার সাথিরা আবার একইভাবে বােমা ফেললেন।

কুর্মিটোলা রানওয়ের ওপরও ঠিক এভাবেই বােমা ফেলা হয়। ৪ নম্বর স্কোয়াড্রন এ দুরূহ কাজটা করে। কুর্মিটোলার গর্তগুলাে তারা আর পূরণ করেনি।

৭ তারিখ সকালে বিষ্ণয় নিজের সাথিদের নিয়ে গিয়ে দেখেন যে আগের দিন দুপুরে ছােড়া বােমার গর্তগুলাে আবার মেরামত করা হয়েছে। তারা আবার, মানে তৃতীয়বার একইভাবে বােমা ফেললেন। তারপর রানওয়ে আর মেরামত হয়নি, সেগুলাে আর ব্যবহারের উপযােগী রইল না। স্যাবরগুলাের উড়বার পথ বন্ধ হয়ে গেল।

৮ তারিখ এরা ঢাকার উত্তরে জয়দেবপুরে গােলাবারুদ কারখানার ওপর হানা দিল। ৯ তারিখে এল ঢাকা রেডিও স্টেশনের পালা। তারপর কেবল সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার দায়িত্ব বাকি রইল।

১১ তারিখ থেকে চলল শত্রু সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ—কুমিল্লা, সােনামুড়া, মৌলভীবাজার, লালমাই, ময়নামতি এলাকায়—কোথাও-বা রকেট দিয়ে, কোথাও-বা বােমা দিয়ে। একটা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে যখন ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের নেতৃত্বে ৯৫ মাউনটেন ব্রিগেড টাঙ্গাইলের উত্তরে জামালপুর অবরােধ করে, তখন মিগ বাহিনী তাদের সাহায্য করেছিল।

১০ ডিসেম্বর আমাদের বিমানবাহিনী জামালপুরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। খবর পাওয়া গেল, ঢাকার কাছে কোথাও একটা ‘ভুতুড়ে বিমানঘাঁটি’ আছে। সেখান থেকে ১১ তারিখ রাতে কিছু অ্যারােপ্লেন উড়েছে। বিষ্ণয়ের ওপর হুকুম হলাে সে বিষয়ে খোঁজখবর করতে হবে। বিষ্ণয় তার দুই সাথিকে নিয়ে গেলেন। তিনি ঢাকার মাইল কুড়ি দূরে ছােট একটা রানওয়ে আবিষ্কার করলেন—১ হাজার ২০০ গজের মতাে হবে। তিনি বােমা ফেলে সেটিকে নষ্ট করে দেন। পাকিস্তানি আর্মি অ্যাভিয়েশন স্কোয়াড্রনের আটটা

পৃষ্ঠা: ২৪১

হেলিকপ্টার সম্ভবত এখান থেকে যাতায়াত করত।

মিগ ২১-এর ৩০ নম্বর স্কোয়াড্রন, আর্মির ২ নম্বর কোরকে যশাের, খুলনা থেকে শুরু করে ঢাকা অবধি খুব সাহায্য করেছিল। তারপর তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

টাঙ্গাইলে প্যারাড্রপ

পূর্ব প্রান্তে যখন হেলিকপ্টারগুলাে ৪ নম্বর কোরের সেনা ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম মেঘনা নদীতে পারাপার করছিল, সেই সময়ই দেশের মধ্যভাগে সেনাবাহিনী আর বিমানবাহিনী মিলে আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।

যুদ্ধ পরিকল্পনার সময়ই আর্মি হেডকোয়ার্টার্স বা প্রধান কার্যালয় থেকে এক ব্যাটালিয়ন, মানে ৮০০ থেকে ১ হাজার, প্যারাট্রুপার পূর্বাঞ্চলীয় আর্মি কমান্ডের নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার অধীনে দেওয়া হয়, তার প্রয়ােজন অনুযায়ী নিয়ােগের জন্য। সাধারণত, তিনটি ব্যাটালিয়ন মিলে একটা ব্রিগেড হয়। এই প্যারা-ব্রিগেডের বাকি অংশ পূর্বাঞ্চলেই রাখা স্থির হয়, রিজার্ভ হিসেবে। মানে, আর্মি হেডকোয়ার্টার্সের হুকুম অনুসারে যখন যেখানে প্রয়ােজন, সেখানে তাদের নিয়ােগ করা হবে। অক্টোবরের মধ্যে জেনারেল অরােরার পরিকল্পনা মােটের ওপর তৈরি হয়ে গেল। ঠিক হলাে, ২ নম্বর প্যারা-ব্যাটালিয়নকে ১১ ডিসেম্বর বিকেল চারটের সময় টাঙ্গাইলে নামানাে হবে। একটা ব্যাটালিয়নে তিনটি বা চারটি কোম্পানি হয়, একেকটা কোম্পানিতে ১৫০ থেকে ৩০০ অবধি লােক থাকতে পারে।

কেন ১১ তারিখ? কেন বিকেল চারটে? কেন অন্য কোথাও নয়, কেন টাঙ্গাইলে? আমাদের পরিকল্পনা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হবে এক এক কোর, অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার সেনা নিয়ে। এর মধ্য থেকে উত্তরে কামালপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিকে সেনাসংখ্যা কিছু কম ছিল। তাই ঠিক হলাে, ওই দিকে প্যারাট্রুপারদের দেওয়া হবে। মুক্তিবাহিনী খবর দিল, টাঙ্গাইলে সেনা নামালে ওখানকার বাসিন্দারা তাদের সাহায্য করবে। তা ছাড়া জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে যে রাস্তা ঢাকায় আসে, টাঙ্গাইল সেই রাস্তার ওপর। কাজেই ওদিক থেকে যদি পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার দিকে আসে, পিছু হটতে বা ঢাকার সেনাদের সাহায্য করতে, আমাদের সেনারা সেটা প্রতিরােধ করতে পারবে।

পৃষ্ঠা: ২৪২

১১ তারিখ কেন? কারণ, জেনারেল আরােরার অনুমান ছিল যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে উত্তর সীমান্ত থেকে আমাদের ওখান অবধি পৌছাতে এক সপ্তাহ লাগবে। আর বিকেল চারটা কেন? প্রথমে ভাবা হয়েছিল, এটা রাতে করা হবে। কিন্তু পাকিস্তান বিমানবাহিনী যখন সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়ল, তখন এ সাবধানতার আর কোনাে প্রয়ােজন রইল না। আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলে শীতের দিনে বিকেল চারটায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করে। সেনারা যখন পৌছাবে, তখন একটু আলাে থাকবে, এতে সুবিধা হবে। তারপর রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দেবে।

এ আয়ােজনটা খুবই গােপন রাখা সম্ভব হয়েছিল। আকস্মিকতার কারণে লােকে বুঝতে পারল না যে কত লােক নামানাে হয়েছে। অনেক সংবাদপত্র, এমনকি বিবিসিও বলল যে এক ব্রিগেড, মানে আড়াই হাজার সেনা নামানাে হয়েছে। আসলে নামানাে হয়েছিল এক ব্যাটালিয়ন, প্রায় ৮০০ সেনা।

এই যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নভেম্বরের গােড়ার দিকে কলকাতায় পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের অধীনে একটা কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এটা যুক্ত রইল দিল্লিতে বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের পরিবহন বিভাগের সঙ্গে। এএন ১২-র অভিজ্ঞ পাইলট গ্রুপ ক্যাপ্টেন গুরুদীপ সিং রইলেন এর শীর্ষে। ঠিক হলাে ৫০টা পরিবহন বিমান একসঙ্গে এ কাজটা করবে—২২টা ডাকোটা, ২০টা প্যাকেট, ৬টা এএন ১২ আর ২টা ক্যারিবু। কিছু সেনা ছিল, যারা প্যাকেট [পরিবহন বিমান—Fair child C-119 Flying Boxcar] থেকে লাফাতে জানত, কিন্তু ডাকোটা থেকে তারা কখনাে লাফায়নি। কাজেই কিছুটা প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হলাে।

ডাকোটাগুলাে জড়াে হলাে কলাইকুন্ডায়, প্যাকেটগুলাে দমদমে। এএন ১২-গুলাের আস্তানা প্রথমে ছিল চণ্ডীগড়ে। কিন্তু সে জায়গাটা পাকিস্তান সীমানার অত্যন্ত কাছে, তাই তাদের সরানাে হয় উত্তর প্রদেশের গােরখপুরে। আর একটা এএন ১২ স্কোয়াড্রন রাখা হলাে বেরিলিতে। মহড়া চলল—এএন ১২-গুলাে নাগপুরে, প্যাকেটগুলাে এলাহাবাদের ফাফামাউয়ে আর ডাকোটাগুলাে কলাইকুন্ডায়।

৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনী যখন আমাদের আক্রমণ করল, তখন ২৫ নম্বর স্কোয়াড্রনের এএন ১২-গুলােকে হাসিমারা। থেকে এল ৭০ কামানগুলাে আগ্রায় পৌছে দেওয়ার কাজ দেওয়া হলাে। ১০ ডিসেম্বর দুপুরে তাদের হুকুম দেওয়া হলাে পরদিন সকালে দমদম চলে আসার জন্য। তারা আর প্যাকেটরা সেখানে একসঙ্গে সমবেত হলাে।

পৃষ্ঠা: ২৪৩

তাদের ম্যাপ, ফটো সব দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলাে কী করতে হবে। ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটিতে ২২টা ডাকোটা রওনা হওয়ার জন্য সারি দিয়ে দাড়িয়ে গেল।

যদিও ৬ ডিসেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ওড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবু দমদম থেকে কিছু নাটকে ডাকোটা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে দেওয়া হলাে। কলকাতায় প্যারা ট্রুপারদের ক্যাম্পটা করা হয়েছিল বােটানিক্যাল গার্ডেনসে।

চার রকমের ৫০টা বিমান। তাদের গতিবেগ বিভিন্ন। অতি সাবধানে হিসাব করা হলাে, কে ঠিক কোন মুহূর্তে মাটি ছেড়ে উড়বে, কে কোন দিক দিয়ে যাবে, কত উঁচুতে উড়বে। সব বিমান রওনা হওয়ার ২০ মিনিট আগে দুটি পথপ্রদর্শক প্যাকেট রওনা হলাে। সেনাদের নামার নির্দিষ্ট স্থান ছিল টাঙ্গাইলের মাইল পাঁচেক উত্তর-পূর্বে, জামালপুর-ময়মনসিংহ থেকে আসা রাস্তার ওপর। ৫০ মিনিটে ৫০টি বিমান নিজেদের প্রস্তুতি সুসম্পন্ন করল। ১ সেদিন জোরে হাওয়া বইছিল। প্রথমে পৌছাল দুটো ক্যারিবু। তারা নির্দিষ্ট জায়গার একটু দূরে প্রথমে কয়েকটা মানুষের মতাে পুতুল ফেলল। তারপর ফেলা হলাে ব্যক্তিগত জিনিসপত্রসহ সেনাদের। প্রতিজন নিল তিনচার দিনের মতাে খাবার। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একেকজনের বােঝা প্রায় ২৫ কিলােগ্রাম। এক-আধটু বিপত্তি ছাড়া মােটের ওপর নামানাের ব্যাপারটা নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হলাে। ১৯ জন পড়ল অন্য সেনাদের থেকে ১১ মাইল। দূরে। তাদের বিপক্ষের সঙ্গে একটু লড়াই করে নিজেদের দলের কাছে। আসতে হলাে। এসে পৌছাতে এক দিন লাগল। একটা প্যাকেট থেকে একটা কামান আর দুটো জিপ চার মাইল দক্ষিণে পড়ে গেল। চারটে জিপ একটা পুকুরে পড়ে গেল। ভাগ্য ভালাে যে পুকুরটা গভীর ছিল না। একটা। প্যাকেটের ইঞ্জিনে কিছু গােলমাল হলাে। জন চল্লিশেক সেনা নিয়ে তাকে দমদম ফিরে যেতে হলাে। তাদের আবার পরদিন পাঠানাে হলাে। একটা এএন ১২-এ বিপক্ষের গুলি লাগল। তবে বেশির ভাগ সেনা ও যুদ্ধের। সরঞ্জাম আড়াই বর্গমাইল জায়গার মধ্যে পড়ে।

পরদিন দুপুরবেলা এরা জামালপুর থেকে আমাদের যে সেনারা ঢাকা অভিমুখে আসছিল, তাদের সঙ্গে মিলিত হলাে। আমাদের ক্ষতি খুবই কম। হলাে। কিন্তু এগােনাের জন্য গাড়ির বড় অভাব দেখা দিল—যে যাতে পারল তাতেই চড়ল, এমনকি সাইকেল-রিকশা অবধি।

পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দিন—প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়কের জন্য গৌরবের দিন। ওই অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ সবাই উপস্থিত হলেন। আমাদের পূর্বাঞ্চল অধিনায়ক এয়ার মার্শাল দেওয়ান

পৃষ্ঠা: ২৪৪

পাকিস্তানি অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার হাতে তাে এখনাে কিছু সেনা ছিল, যারা লড়াই করতে তৈরি, তা সত্ত্বেও আপনারা এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়লেন কেন?’ গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, বুকের ওপর তাঁর বিমানবাহিনীর চিহ্ন ‘উইংস বা ডানা লাগানাে। সেটার ওপর অঙ্গুলি নির্দেশ করে জেনারেল নিয়াজি বললেন, ‘এদের জন্য। এই বিমানবাহিনীর জন্য গত কয়েক দিন কোনাে সময়ে কোনাে জায়গায় আমি ও আমার সঙ্গী অনুচরেরা চোখের দুই পাতা এক করতে পারিনি। ক্লান্ত হয়ে গেছি। তাই আর লড়াই করতে পারলাম। আত্মসমর্পণ করতে হলাে, আর কোনাে গতি রইল না।’

অনুবাদ : ইলা লাল (এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লালের স্ত্রী)

পৃষ্ঠা: ২৪৫

Reference:

১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!