You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অজানা বীরত্বগাথা

ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কে রায়

ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কে রায় পিভিএসএম, এভিএসএম ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর গােয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে রাজকীয় নৌবাহিনীতে যােগ দেন। তিনি ১৯৮৪ সালে ইস্টার্ন ন্যাভাল কমান্ডের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী থেকে অবসর নেন। ৪০ বছরের কর্মজীবনে তিনি ভারত মহাসাগরের যুদ্ধসংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ওয়ার ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশান (লানসার পাবলিশার, ১৯৯৫) গ্রন্থটি রচনা করেছেন। গ্রন্থের একটি পর্বে তিনি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গঠিত নৌকমান্ডাে গঠন ও তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। সেই পর্বের নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হলাে। রচনাটি ২৬ মার্চ ১৯৯৭ তারিখের ভােরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাঁতারু মুক্তিবাহিনী ও স্থলভিত্তিক মুক্তিবাহিনী ছাড়া জলপথে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, সেই সব বাঙালি গেরিলাকে মুক্তিবাহিনীর অন্য যােদ্ধাদের থেকে আলাদাভাবে পরিচয়। করানাের প্রয়ােজন আছে। কেননা, তাঁদের বীরত্বের কাহিনি অকথিত। তাঁদের নাম দেওয়া চলে ফ্রগমেন। তাঁরা পানির নিচের সাঁতারু, মুখে শ্বাসযন্ত্র আর পায়ে ফিন (fin) বেঁধে জলের নিচে সাঁতার কাটায় ছিলেন সুদক্ষ। এই পানির নিচের সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন ভিয়েতনামের গেরিলাযােদ্ধাদের মতাে, যারা স্থানীয় জনগণকে রক্ষা করার। জন্য শত্রুপক্ষকে অতর্কিত আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ আর কাহিল করে দিয়ে তাদের কোণঠাসা করার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন। পূর্ব বাংলার এই গেরিলাযােদ্ধারা ছিলেন গ্রাম আর শহরের খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের

পৃষ্ঠা: ২১৮

একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশােধ নেওয়া। এই সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও ত্যাগের কাহিনি আজও, সিকি শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও, অকথিত ও অজ্ঞাত রয়ে গেছে।

মােটাদাগে মুক্তিবাহিনী ছিল ৪ ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। ১. নিয়মিত বাহিনী, যা প্রাথমিকভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল ও বেসামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছিল, পরে এদের সঙ্গে যােগ দেন হাজার হাজার সাধারণ বাঙালি তরুণ-যুবক। ২. গণবাহিনী নামে একটি অনিয়মিত বাহিনী, যাদের লক্ষ্য ছিল সেতু, রেলপথ ও শক্তিকেন্দ্রগুলাে নষ্ট করে দেওয়া। ৩. ‘বিচ্ছু’ নামে মেয়েদের একটি ব্রিগেড, যারা গােপন খবরাখবর আনা-নেওয়া করত। এবং ৪. ফ্রগমেন বা সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধার দল। সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধারা প্রধানত নদী অঞ্চলগুলােতে তৎপর ছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম, চালনা, মােংলা ও খুলনা সমুদ্রবন্দরগুলাে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, যাতে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে সামরিক সরবরাহ আসতে না পারে। অভ্যন্তরীণ নদীপথে যােগাযােগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করাও ছিল তাঁদের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য। নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর, বরিশাল প্রভৃতি নদীবন্দর ছিল অভ্যন্তরীণ নৌযােগাযােগের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পথ। এসব অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ফ্রগম্যানরা তৎপর ছিলেন। তাদের আরও একটা লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানি বাহিনী যেন সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে না পারে।

সাঁতারু মুক্তিবাহিনী শারীরিক-মানসিক দুদিক থেকেই ছিল দুর্ধর্ষ। একটা সফল গেরিলা অভিযানের জন্য প্রয়ােজনীয় যেসব গুণ ভিয়েতনামের স্কুলমাস্টার জেনারেল গিয়াপ তালিকাবদ্ধ করেছেন, তার সব কটি বাঙালি সাঁতারু বাহিনীর ছিল। যেমন অসম-সাহসিকতা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও প্রচণ্ডতা। সবকিছুর ওপরে তাঁদের স্বপ্নের সােনার বাংলা কায়েমের স্বপ্ন এবং পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর তীব্র প্রতিশােধ গ্রহণের ইচ্ছা তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত করেছিল। তা ছাড়া তাদের কোনাে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল

, ছিল না কোনাে লাভ-লােকসানের হিসাব। তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যের প্রতি ছিলেন উৎসর্গচিত্ত। সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর কাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানগুলােতে এবং গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগক্ষেত্রগুলাের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের দিশেহারা করে দেওয়া। কর্ণফুলী নদীর ওপরে চট্টগ্রাম বন্দর আর পশুর নদে চালনা-মােংলা বন্দর ছিল পূর্ব বাংলায় সামরিক সরঞ্জাম ও তেল সরবরাহের প্রধান পথ, পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ১৮টি স্যাবর, ২টি সি-১৩০, ২টি ফকার ফ্রেন্ডশিপ এবং ৮টি হেলিকপ্টারের জ্বালানি ছাড়াও ট্যাংক, ট্রাক ও অন্যান্য সামরিক যানবাহনের জ্বালানি সরবরাহ হতাে এসব পথে।

পৃষ্ঠা: ২১৯

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিকভাবে এসব অঞ্চলে তৎপর হলেও আস্তে আস্তে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলােতে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধ্য হতে হয় আরও লােকবল ও শক্তি নিয়ােগ করতে। অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলাে এবং নৌযােগাযােগব্যবস্থা পাহারার কাজে তাদের আরও লােক এবং শক্তি খরচ করতে হয়। তা ছাড়া নৌচলাচলের ওপর হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণের ঘটনার ফলে বিদেশি জাহাজ চলাচলেও ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে। থাকে। যুদ্ধঝুঁকির ফলে বিমার হার বেড়ে গেলে বিদেশিরাও এমন অরক্ষিত এলাকায় পণ্য সরবরাহ নিয়ে আসতে দিন দিন নিরুৎসাহিত হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে পাকিস্তানের ন্যাভাল হেডকোয়ার্টার করাচি থেকে ডেস্ট্রয়ার পিএনএস জাহাঙ্গীর’ ও ‘ঢাকা’ নামক ট্যাংকারটিকে ডেকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হলে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের নিরাপত্তা একেবারে অরক্ষিত হয়ে যায়। শুধু ৪টি ব্রুক মেরিন টহলযান আর ২টি সমুদ্রগামী নিরাপত্তাযান পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়। তবে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর ও নদীপথগুলােতে টহল দেওয়ার জন্য হালকা অস্ত্রসজ্জিত বেশ কিছু রিভারক্র্যাফট যুক্ত করা হয়।

স্থলভিত্তিক মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা একদিকে চোরাগােপ্তা হামলা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধার দল প্রতি মাসে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিতভাবে আক্রমণ করে চলছিল; এসব আক্রমণের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আকস্মিকতা, ক্ষিপ্রতা, গােপনীয়তা। একেকটা বড় অভিযানের আগে তাদের লম্বা প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতাে। সাতারু মুক্তিযােদ্ধার দল কয়েক মাসের অভিযানে এক লাখ টন মালামালসহ জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল ও জাহাজের ক্ষতিসাধন করেছিল। এই হিসাব দিয়েছে লয়েডস রেজিস্টার অব শিপিং। এত অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কোনাে নৌবাহিনী কোনাে সাগরে এত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধারা যেসব অঞ্চলে অভিযান চালাতেন, সেগুলাের ভূগােল থাকত তাঁদের নখদর্পণে। তারা খুব অল্প অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে বহন করতেন এবং এ কারণে সহজেই তারা তাদের লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারতেন। চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে তারা ভালােভাবে প্রস্তুতি নিতেন। তারপর অপেক্ষায় থাকতেন জোয়ার অথবা ভাটার, পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যার। জলের নিচে শ্বাসকার্য চালানাের জন্য কোনাে উন্নত বা সূক্ষ্ম যন্ত্র তাদের ছিল না। তারা এ কাজে ব্যবহার করতেন বাঁশের ও পেঁপে পাতার চোঙা। তাঁদের বিশেষ কোনাে পােশাক ছিল না। লুঙ্গি আর বেনিয়ান পরেই তারা অভিযানে যেতেন। যেসব বাঙালি বিদেশে ছিলেন, যেমন মােমেন [ডা. এম এ মবিন] ও জাফরুল্লাহ [ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী] নামের দুই ডাক্তার, তাঁরা পায়ে বাঁধার তাড়নি, হাতে বাঁধার কম্পাস ইত্যাদি স্পাের্টসের দোকান থেকে কিনে পূর্ব

পৃষ্ঠা: ২২০

বাংলার সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পাচার করেছিলেন। স্থানীয় জনগণ সাঁতারু বাহিনীকে নানাভাবে খুব সাহায্য-সহযােগিতা করত, খবরাখবর দিত, পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটিগুলােতে ঢুকে কাজে সহযােগিতা করত, লুকানাের জায়গা দিত। আর অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব বাংলায় এসে ডাঙায় আটকে পড়া তিমি মাছের মতাে অবস্থায় পড়ত।

যেভাবে সংগঠিত হলাে

সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধাদের মূল অংশটি গঠিত হয়েছিল বাঙালি নাবিকদের একটা অংশকে ঘিরে, যারা তৃতীয় পাকিস্তানি দাফনি সাবমেরিন মানগ্রো থেকে পালিয়ে এসেছিল। সাবমেরিনটি ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট ফ্রান্সে কমিশন হয়। সেখান থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি নাবিকদের মধ্যে ছিলেন ৩৫ বছর বয়স্ক চিফ পেটি অফিসার রহমত গাজী মাে. রহমতউল্লাহ, বীর প্রতীক]; তিনি ছিলেন খুলনার মানুষ এবং দুই সন্তানের জনক, নৌবাহিনীর ফুটবল টিমে খেলতেন। ছিলেন পেটি অফিসার মুশারফ [সৈয়দ মাে. মােশারফ হােসেন]; ফরিদপুরের মানুষ কিন্তু সাত সন্তানের পরিবার থাকত ঢাকায় এবং পেটি অফিসার আমিন (আমানউল্লা শেখ, বীর বিক্রম) : কুমিল্লার মানুষ ও চার সন্তানের পিতা। এই দুঃসাহসী বাঙালি নাবিকেরা ফ্রান্সে পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে পালিয়ে স্পেনে চলে যান। স্পেন থেকে তারা পূর্ব বাংলায় ফিরে আসার পথ বের করেন। তাঁদের সঙ্গে যােগ দেন ঢাকার নাবিক আবদুল [আবেদুর রহমান, বীর বিক্রম], নােয়াখালীর মেকানিক মােহাম্মদ [মাে. আহসানউল্লাহ, বীর প্রতীক], চট্টগ্রামের রেডিও অপারেটর চৌধুরী আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী), রংপুরের নাবিক বদিউল [বদিউল আলম, বীর উত্তম) এবং টাঙ্গাইলের ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক আকিব [আবদুর রকীব মিয়া, বীর বিক্রম]। এই আটজন ছিলেন সাবমেরিন থেকে আসা। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন আরও এক ডজন বাঙালি নাবিক, যারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও তিনজন ব্যবসায়ী নাবিক, যারা ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামের লােক ছিলেন, তাঁরাও ওই দলে ভিড়ে যান। এভাবে বাঙালি সি-মেন মিলে গড়ে তােলেন মুক্তিবাহিনী ফ্রগমেন বা সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় অংশটি।

কিন্তু পরে এতে যারা যােগ দেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের তরুণ ছাত্র এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ-যুবকের দল। তারা পূর্ব বাংলার খরস্রোতা নদীগুলাে থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার মতাে সাঁতারের কৌশল জানতেন ও অফুরন্ত

পৃষ্ঠা: ২২১

প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন। সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাদের ডজন ডজন মাইল সাঁতরাতে হতাে, বাঁশ বা পেঁপে পাতার চোঙা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে নিকষ অন্ধকার পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি রেখে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সাঁতরে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে যেতে হতাে—যা কিনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেমস বন্ড ধরনের কমান্ডােদের জন্যও একটা কঠিন কাজ। এ ধরনের কাজের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক শক্তিমত্তার প্রয়ােজন, পূর্ব বাংলার তরুণ-যুবকদের তা প্রচুর পরিমাণে ছিল। তাই সাঁতারু বা ফ্রগমেন বাহিনীর নেতৃত্ব শুরুর দিকে নৌবাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকলেও অচিরেই তা চলে যায় বিপুলভাবে উদ্দীপিত শিক্ষিত যুবকদের হাতে।

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীতে ১৩০ জন ছিলেন চট্টগ্রামের, খুলনা-চালনা অঞ্চলের ছিলেন ১০০ জন, ৪০ জনকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে এবং ৩০ জনকে চাঁদপুর, দাউদকান্দি এলাকা থেকে। তাদের ছিল সেই সাহসিকতা আর প্রাণশক্তি, যার বলে তারা এ রকম কষ্টকর, বিপজ্জনক ও দুঃসাহসী অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এ রকম কাজ সাধারণত দেওয়া হয় উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপকে, যাদের বলা হয় মেরিন কমান্ডাে, উন্নত নৌবাহিনীতে এদের বলা হয় “সিলস’। সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন মুসলমান। যে অল্পসংখ্যক হিন্দু যােদ্ধা ছিলেন, তাঁরা খতনা করেছিলেন, তাঁরা। ভেবেছিলেন ধরা পড়লে এতে অন্তত প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামাে ৪টি টাস্কফোর্সে বিভক্ত ছিল সাঁতারু মুক্তিবাহিনী। এরা ছিল চট্টগ্রাম, চালনা/খুলনা, নারায়ণগঞ্জ এবং দাউদকান্দি/চাঁদপুরে। প্রতিটি সেক্টরে ছিল চারটি করে টাস্ক ইউনিট। প্রতিটি টাস্ক ইউনিটে ছিল ১০টি করে টাস্ক এলিমেন্ট। প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টে ছিলেন তিনজন করে সাঁতারু যােদ্ধা। প্রত্যেক যােদ্ধার ছিল প্রথমে একটি, পরে দুটি করে লিমপেট মাইন, একটি গ্রেনেড, একটি ছােরা, সাঁতারের জন্য পায়ে বাঁধা এক জোড়া ডানা এবং কবজিতে বাঁধা একটি করে কম্পাস। প্রতিটি টাস্ক ইউনিটের ছিল একটি করে। গুলিভরা রাইফেল। এই সামান্য অস্ত্রসরঞ্জাম নিয়ে বাঙালি সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা যে অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন, শত্রুপক্ষের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছেন, তা পৃথিবীর গেরিলাযুদ্ধগুলাের ইতিহাসে বিরল।

সর্বোচ্চ সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে তারা প্রথম আক্রমণটি চালান একসঙ্গে একজোটে কয়েকটি স্থানে। সেটা ছিল ‘৭১-এর আগস্ট মাসের ১৫-১৬ তারিখের অন্ধকার রাত। একসঙ্গে তারা আক্রমণ করেন চট্টগ্রাম, চালনা,

পৃষ্ঠা: ২২২

খুলনা এবং নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালের নদীবন্দরগুলাের ওপর। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত মনে করত বলে একসঙ্গে এতগুলাে পয়েন্টে এমন অতর্কিত হামলায় তারা হকচকিয়ে গিয়েছিল।

প্রধান প্রধান সমুদ্রবন্দরগুলাের ওপর হামলা

চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর হামলা পরিচালনা করেছিলেন ওই শহরেরই এক যুবক। তিনি একজন সাবেক সাবমেরিনার এবং মেডিকেলের ছাত্র। চট্টগ্রামের ছেলে হওয়ায় ওই এলাকার ভূগােল তার খুব ভালােভাবে জানা ছিল, বন্দরের জাহাজগুলাের নাড়িনক্ষত্রও তাঁর জানা ছিল [নৌবাহিনীর সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম এই অভিযানের নেতা ছিলেন, তাঁর বাড়ি ছিল ফেনী এবং তিনি মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন না]। তাঁর নেতৃত্বে সাঁতারু বাহিনীর সদস্যরা জোড়ায় জোড়ায় তিনটি গ্রুপে বন্দরে ঢুকে পড়েন। মাথায় কাঁঠালের ঝুড়িতে লিমপেট মাইন লুকিয়ে নিয়ে তাঁরা বন্দরে ঘুরে ঘুরে শত্রুপক্ষের বিশদ খুঁটিনাটি দেখে নেন প্রকাশ্য দিবালােকে। তারপর প্রতি জোড়া সাঁতারু যােদ্ধার জন্য টার্গেট ভাগ করে দেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে তারা নদীর পাড় ধরে উজানের দিকে হেঁটে যান এবং নির্ধারিত সময়টির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। নির্ধারিত সময়টি ছিল মধ্যরাতের ঠিক পরের মুহূর্ত, যখন নদীতে ভাটার টান শুরু হয় এবং বন্দরে শ্রমিকদের পালাবদল ঘটে।

সাঁতারু বাহিনীর সদস্যরা লুঙ্গি গুটিয়ে মালকোঁচা বাঁধেন এবং পায়ে বেঁধে নেন সাঁতারের সুবিধার জন্য ডানা (পরবর্তী অপারেশনে অবশ্য তাঁরা লুঙ্গি ছুড়ে ফেলে পুরােদস্তুর ন্যাংটো হয়েছিলেন)। তারপর ঘড়ি-কম্পাসগুলাে হিসাবমতাে ঠিকঠাক করে নিয়ে বেশ উজান থেকে তারা অন্ধকার পানিতে নেমে পড়েন। মুখে একটা করে বাঁশের চোঙা নিয়ে সেটার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালাতে চালাতে তাঁরা ভাটার স্রোতের টানে ভেসে চলেন পানিতে যতটা সম্ভব মাথা নিচু রেখে। নির্ধারিত লক্ষ্যস্থলগুলােতে পৌছে তারা জেটির নিচে কাঠের পাটাতনগুলাে ধরে দাঁড়ান এবং যাতে আক্রমণগুলাে একসঙ্গে করা যায়, সে জন্য নিজ নিজ ঘড়ি মিলিয়ে নেন। লাগাতার আক্রমণে শত্রুপক্ষকে বেসামাল করে দিয়ে সেই সুযােগে কেটে পড়ার জন্য আক্রমণগুলাে একই সময় ঘটানাের পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা।

নির্ধারিত মুহূর্তটি যখন এগিয়ে এল, তখন চৌধুরী ও আলম বুকভরে শ্বাস নিলেন, তারপর সাঁতরে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর জলযানের মাঝবরাবর লিমপেট মাইনগুলাে বেঁধে দিলেন, মাইনগুলাের ম্যাগনেট বন্দরের দিকে সেট

পৃষ্ঠা: ২২৩

করা থাকল, ইঞ্জিনরুমের কাছাকাছি জলসীমার ঠিক নিচেই, যাতে বিস্ফোরণের ফলে পানি গিয়ে ঢােকে ইঞ্জিনরুমের ভেতরে এবং এর ফলে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে পাম্পগুলাে অকেজো হয়ে যায়। আমিনুল্লা ও মােমেন দুজনও একইভাবে ফ্রেইটারের স্টারবাের্ডের সঙ্গে লিমপেট মাইন বেঁধে দেন। তারপর উভয় জুটি সাঁতরে ডকগুলাে অতিক্রম করে ডাঙার দিকে পালিয়ে যায়। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটে দ্রবণীয় প্লাগগুলাে গলে যায় এবং লিমপেট চার্জ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। তারপর বিস্ফোরণের শব্দে যখন আকাশবাতাস কেঁপে ওঠে, তখন পাকিস্তানিদের ওপর নরক ভেঙে পড়ে এবং পাকিস্তানি ফ্রেইটার ‘আল আব্বাস’ এবং হরমুজ তলিয়ে যায়। একই ধরনের। আক্রমণ চালানাে হয় দুটি কোস্টার, একটি টাগ, একটি ফেরিবােট ও দুটি হারবার ক্র্যাফটের ওপর। তৎক্ষণাৎ জ্বলে ওঠে সার্চলাইটগুলাে, সেন্টিদের তন্দ্রা ছুটে যায় এবং তারা প্রতিটি বস্তুর ছায়া লক্ষ্য করে তাদের কারবাইনগুলাে খালি করে ফেলে এবং কর্ণফুলীর প্রবহমান জলে হ্যান্ডগ্রেনেডের বৃষ্টি ঝরায়।

এদিকে একই রাতে [আহসান] উল্লাহ, শেখ খসরু আর মণ্ডল—এই চার সাতারু মুক্তিযােদ্ধা চালনা বন্দরের নিরাপত্তাব্যুহের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং পশুর নদের পােতাশ্রয়ে দাঁড়ানাে সােমালীয় সাত হাজার টনি ফ্রেইটার এসএস লাইটনিং’-এ চারটি লিমপেট মাইন বেঁধে দেন।

একজন সাবেক সাঁতারু নৌসেনার নেতৃত্বে সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর একটি টাস্ক এলিমেন্ট চাঁদপুরে একটি কয়লাবাহী জাহাজ ও তিনটি কোস্টারের ওপর হামলা চালায়। তা ছাড়া খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দিতে সাঁতারু বাহিনীর সদস্যরা তিনটি নদী স্টিমার, ছয়টি ম্যাকনাইজড বার্জ, দুটি মােটরলঞ্চ এবং চারটি পন্টুন ধ্বংস করে দেন। এই টাস্ক ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক নাবিক রহমত ও সিদ্দিকী নামের এক তরুণ ছাত্র।

খুলনায় সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর এক যােদ্ধা [মহেন্দ্রনাথ] এক অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। একটি স্টিমারে তিনি যখন লিমপেট বিস্ফোরক বাঁধছিলেন, তখন তাকে পাকিস্তানি বাহিনীর লােকেরা সন্দেহ করে চ্যালেঞ্জ করে। তিনি তাদের বলেন যে তিনি একজন জেলে, নিশানা হারিয়ে ফেলেছেন। এই জন্য সাঁতরে তীরের দিকে যাচ্ছেন। তাকে তখন স্টিমারে টেনে তােলা হয় এবং সমুদ্রযাত্রীদের রীতি অনুযায়ী এক কাপ চা খেতে দেওয়া। হয়। তিনি চা খাওয়া শেষ করতে না করতে আপ্যায়নকারীদের ধন্যবাদ দিয়ে লাফিয়ে স্টিমার থেকে নেমে তীর বরাবর ভোঁ দৌড় লাগান। মুহূর্ত পরই বিস্ফোরণে স্টিমারটি চুরমার হয়ে উড়ে যায়।

পৃষ্ঠা: ২২৪

৩০ আগস্ট ১৯৭১ হার্ডিঞ্জ ব্রিজে হামলা দক্ষিণাঞ্চলের নদীবন্দর ও জলপথগুলাের ওপর যখন আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে, তখন আগস্টের শেষ দিকে সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর একটি দল উত্তরে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল পদ্মা নদীর ওপরের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মা পেরিয়ে কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহী-পাবনার দিকে রেল যােগাযােগের গুরুত্বপূর্ণ পথ। ১৩ জন সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধা রাজশাহী পৌছান। তারপর তারা সারদাতে পদ্মা নদী পেরিয়ে চারঘাটের দিকে এগােন এবং দাদুপুর চরে গিয়ে আশ্রয় নেন।

সাঁতারু দলের মধ্যে মােহাম্মদ কাইয়ুম হােসেন কাদের ও ওয়াহিদুল ইসলাম ছিলেন এই এলাকার মানুষ। তারা একটি দেশি নৌকা ছিনতাই করেন। এবং ২১ হেরিক চার্জসহ আটজন সাঁতারুকে ওই নৌকায় লুকিয়ে রাখেন। একটা মােটরবােট ওই নৌকাটিকে টেনে নিয়ে যায় রাইতা পয়েন্ট পর্যন্ত, যা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে আধা মাইল উজানের দিকে। তারপর দেশি নৌকাটি মােটরবােট থেকে আলাদা হয়ে নিজে ব্রিজের কেন্দ্রীয় পিলারের দিকে অগ্রসর হয়। সেটি সবার অগােচরে ৩০ আগস্ট রাত একটায় সেখানে পৌঁছায়। নৌকাটি রক্ষা করার জন্য দুজনকে সাতরে ব্রিজটির বিপরীত পাশের পিলারগুলাের দিকে যেতে হবে, কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে দুজন সাঁতারু তা করতে ব্যর্থ হন। তখন নােঙর ফেলা হয় সরাসরি ব্রিজটির নিচেই। নৌকাটি ঝাঁকুনি খেয়ে আটকে যায় এবং তৎক্ষণাৎ নৌকার সম্মুখভাগ তীব্র স্রোতের কারণে পানিসীমার নিচে একটা গোত্তা খায়। বইঠাচালক ভয় পেয়ে নােঙরের শিকল খুলে ছুড়ে ফেলে দেন। নৌকাটি ভাটির দিকে চলে যায় এবং খুব কষ্টে সে রাতে তারা রক্ষা পান।

পরদিন রাত ১০টায় দ্বিতীয়বারের মতাে তাঁরা চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হন। তৃতীয়বার তাঁরা তীরের কাছাকাছি একটা পিলারকে লক্ষ্য হিসেবে নেন। এবার তাদের সফলতার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ব্রিজের ওপর থেকে সেন্ট্রিরা নৌকার ওপর গুলি করে। মুক্তিযােদ্ধারা লাফিয়ে পড়ে ভাটির দিকে সাতরাতে থাকেন। এরই মধ্যে নিকটস্থ একটা রাজাকার ক্যাম্পকে সৈন্যরা সতর্ক করে দেয়। রাজাকাররা কাদের ও ওয়াহিদকে ধরে ফেলে। এরপর তাদের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অন্যরা আশপাশের আখখেতে গা ঢাকা দেন এবং প্রায় মাঝরাতের দিকে পৌছান বাজুমারা। তারপর তারা আবদুলপুর-নন্দনগাছির মধ্যে রেলপথের ওপরে আড়ানি সেতু নষ্ট করে দিয়ে তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে যান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আক্রমণের ব্যাপারে সাঁতারু মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান এই জাতীয় সম্পদ স্বাধীনতার পর বাঙালিকেই মেরামত করতে হবে এবং তার পেছনে অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হবে—এমন উপলব্ধি তাদের দ্বিধান্বিত করেছিল।

পৃষ্ঠা: ২২৫

আগস্ট মাসের মধ্যে সাঁতারু বাহিনীর অভিযানে মােট ১৬ হাজার টন মালামাল ডুবে গিয়েছিল এবং ১৪ হাজার টন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঢাকা থেকে বিদেশি সাংবাদিকেরা মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ অভিযান-আক্রমণগুলাের সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন। সাতারু বাহিনীর তৎপরতার ফলে বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলাের মধ্যে গুরুতর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যুদ্ধঝুঁকি বিমা ৫ শিলিং থেকে বাড়িয়ে ১ পাউন্ড করা হয়। জাহাজিদের জন্য আরও ২০ শতাংশ “রিস্কপে’ যােগ হয়। তা ছাড়া কোনাে জাহাজ বন্দরে এক সপ্তাহের বেশি সময় থাকার সাহস করলে সে জাহাজকে দৈনিক এক হাজার মার্কিন ডলার ‘রিস্ক মানি’ প্রদান করতে হতাে। সুতরাং পাকিস্তান সামরিক জান্তার কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর সাঁতারু যােদ্ধাদের তৎপরতা এমনই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল যে বিদেশি জাহাজগুলাে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরগুলাে থেকে পাততাড়ি গােটাতে থাকে।

পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর মােকাবিলায় সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রথম দিকে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তারা মূলত জলের তলের গেরিলা গ্রুপ ছিলেন। একটি অভিযানে ২১ জন সাঁতারু যােদ্ধা প্রাণ হারান। একটা রাজাকারপ্রধান এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি ইউনিটের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে তথ্য পাচার হয়ে যায়। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা বিরাট ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন এবং তাঁদের মনােবল কমে যায়।

পরে সাঁতারু বাহিনী স্থির করে যে তারা পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর পেছনে যেখানে-সেখানে ছুটবে না, তারা তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে পানিতে। * চট্টগ্রামে দ্বিতীয় আক্রমণটি পরিচালিত হয় নূর মােহাম্মদ ও রহমানের নেতৃত্বে। তাঁরা দুজনেই ছিলেন সাবেক নৌসেনা, যাদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর বরখাস্ত করা হয়। এবার সাঁতারু দলের অভিযান ছিল কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে গুপ্ত খালের সংযােগস্থলে। প্রাথমিকভাবে টার্গেট করা হয় ফ্রেইটার ‘আল মুর্তাজা’ ও ‘ইমতিয়াজ বক্স’। পরে ব্রিটেনের ‘টিভিওট ব্যাংক এবং গ্রিক ফ্রেইটার আভলােস’কেও টার্গেট করা হয়। এ দুটি জাহাজ পাকিস্তানি ফ্রেইটার দুটির অদূরে মালামাল ও সামরিক সরঞ্জাম খালাস করছিল। এই মূল টার্গেটগুলাের প্রতিটিতে দুটি করে লিমপেট মাইন জুড়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়া ছােটখাটো টার্গেট, যেমন বার্জ, হারবার ক্র্যাফট ও পন্টুন ইত্যাদির জন্য একটা করে বােমাই যথেষ্ট ছিল। সাঁতারু বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিস্ফোরক ছিল সীমিত। এগুলাের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন তারা। প্রতিটি

পৃষ্ঠা: ২২৬

অভিযানের পর অবিস্ফোরিত মাইন, বােমা উদ্ধারের চেষ্টা করতেন। এটা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কিন্তু সাঁতারু বাহিনীর জন্য তা করা দরকারি ছিল। গেরিলা অপারেশনগুলােতে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ অপরিহার্য।

সেপ্টেম্বরেই খুলনা/চালনায় আলম, আহসানউল্লাহ, মণ্ডল ও মুখার্জি দ্বারকা’ [Dwarka] নামের একটি কোস্টার জাহাজ, দুটি বার্জ ও একটি টাগ আক্রমণ করেন।

বরিশালে মহিউদ্দিন, মঞ্জুর ও নূরুজ্জামান একটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। বরিশাল নদীবন্দরে এই অভিযানে তাঁরা ‘সপ্তডিঙা’ নামে একটি কোস্টার জাহাজ, দুটি টাগ, একটি রিভার স্টিমার, একটি ফেরি এবং ‘পাথফাইন্ডার’ নামের একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। ( অভ্যন্তরীণ বন্দর চাঁদপুরে আলতাফ মাহমুদ, হাফিজ ও স্বপনের নেতৃত্বে আক্রমণে একটি লঞ্চ, তিনটি ফেরি এবং একটি কোস্টারের সলিলসমাধি ঘটে। আরিচা ঘাটেও তারা একটি লঞ্চ ও একটি টার্মিনাল পন্টুন ডুবিয়ে দেন। গােয়ালন্দঘাটে একটি পন্টুন ও একটি ফেরি আক্রান্ত হয়ে তলিয়ে যায়, সাবধান খালে তিনটি বার্জের একই অবস্থা ঘটে। আশুগঞ্জে একটি কোস্টারের। মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। এভাবে সাঁতারু বাহিনীর লিমপেট মাইনের যৎসামান্য মজুত ও অন্যান্য বিস্ফোরক ফুরিয়ে যায়। জগন্নাথপুর ঘাটে তারা একটি ফেরিতে আগুন ধরিয়ে দেন। ফরিদপুরে বুড়া মিয়া, মুস্তাফা, জহির ও বাচ্চু পুলিশ কনস্টেবলের বেশ ধরে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবিয়ে দেন। লঞ্চ দুটির একটি ছিল বিলাসবহুল টুরিস্ট বােট ‘শিকাপুর ফরিদন’ [Shikapur Faridon]। তারা তিনটি যন্ত্রচালিত নৌকা ছিনতাইও করেন।

শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে যেসব অভিযান চালান, তাতে ৬ হাজার টন মালামালসহ জাহাজ ও অন্যান্য জলযান ডুবে যায় এবং ১০ হাজার টন মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ ছিল সব পাকিস্তানি জলযানকে বন্দর ত্যাগ করার পর থেকে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলিত রাখতে হবে। এ নির্দেশ না। মানার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা চারদিকে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে পাকিস্তানি জলযানগুলাে গেরিলা-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলাে দিয়ে যাওয়ার সময় পতাকা নামিয়ে রাখত।

অক্টোবর : তৎপরতা বৃদ্ধি

সে বছর অক্টোবর মাস ছিল রমজানের মাস। সে মাসে ১৫০ জন সাঁতারু গেরিলা পাকিস্তানের বন্দর ও অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলাের ওপর একযােগে

পৃষ্ঠা: ২২৭

সমন্বিত আরও একটি বৃহৎ আকারের আক্রমণ চালান। এবার অন্যান্য এলাকা ছাড়াও আক্রমণ চালানাে হয় প্রমত্তা মেঘনা নদীতে, যে নদী তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর ও সন্দ্বীপ হয়ে চট্টগ্রামের কাছে সাগরে পড়েছে। মেঘনা নদী ও তার শাখা-উপশাখাগুলাে নানা রকম আগাছা আর ঝােপঝাড়ে ঢাকা ছিল। সাঁতারু বাহিনীর অভিযানের জন্য তা আদর্শ আড়ালের কাজ করেছে।

চট্টগ্রামের প্রধান বন্দরের ওপর তৃতীয় আক্রমণটির নেতৃত্ব দেন মাহবুব, শরিফ, নিরঞ্জন, কাজী ও বাদল। আক্রমণের সময় নির্ধারণ করা হয় নদীর স্রোত, অন্ধকারের সময়কাল, জাহাজের চলাচল এবং বন্দর নিরাপত্তাব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যাপারগুলাের কথা বিবেচনায় রেখে।

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে নাসিমা’, ‘শের আফগান’ ও ‘লালসিরা’ নামের তিনটি কোস্টার জাহাজ ডুবে যায়। একটি ট্যাংকার এবং অন্য দুটি কোস্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তীব্র স্রোত আর নদীতে জলের ঘূর্ণির কারণে এই টার্গেটগুলাের সঙ্গে মাত্র একটি করে লিমপেট মাইন বাঁধা সম্ভব হয়েছিল। বড় কোস্টারগুলাে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য কখনাে কখনাে একটি লিমপেট মাইনের বিস্ফোরণ যথেষ্ট হতাে না। বিশেষ করে চীনে নির্মিত কোস্টারগুলাের বেলায়, যেগুলাে পাকিস্তান নতুনভাবে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিল। র এসব আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ক্রমশ জোরদার করা হয়। টহল বােটগুলাে সার্চলাইট জ্বালিয়ে বিরামহীন টহল দিতে থাকে। বন্দরের শ্রমিকদের প্রতিটি শিফটে কড়া দেহতল্লাশি শুরু হয় এবং জাহাজ লােড-আনলােড করার সময় সতর্কতা আরও বাড়ানাে হয়। এসবের ফলে সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর আরও প্রশিক্ষণ, আরও শৃঙ্খলা ও বিচক্ষণতার প্রয়ােজন হয়। সাঁতারু গেরিলাদের, যারা শুরু থেকেই বেশ কিছু অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ইতিমধ্যেই বেশ বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে; ফলে তারা নবীন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতে পারতেন। সাঁতারু বাহিনীর তৎপরতার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুরসংখ্যক সৈন্যকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, ফলে মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপ কিছুটা কম পড়েছে।

অক্টোবর মাসেই বরিশালে একটি কোস্টার জাহাজ সাঁতারু বাহিনীর সদস্যরা ডুবিয়ে দেন এবং নৌচলাচলের সীমানা নির্ধারণকারী একটি ভাসমান স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেন। একই সঙ্গে সন্দ্বীপ ও হাতিয়ায় এ রকম দুটি স্থাপনার তলা ফুটো করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ওদিকে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ ও নগরবাড়ির পন্টুন ও ফেরি টার্মিনালগুলাে ধ্বংস করে দেন। সামাদ, আশিক, মাসুদ ও খালেদ। তাঁরা সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হরিনগর ও জামালপুর থেকে দুটি লঞ্চ ছিনতাই করে মুক্তিবাহিনীর গােপন ঘটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

পৃষ্ঠা: ২২৮

অক্টোবর মাসে সাঁতারু বাহিনী মােট ৮ হাজার টন মালামাল ডুবিয়ে দেয়। এবং ১৬ হাজার টনের ক্ষতিসাধন করে। অভ্যন্তরীণ নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম ও খুলনা থেকে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার মধ্যে চলাচল অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নিয়ােজিত সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুম শেষ হতে হতে পাকিস্তান চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা ও যশাের ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে। এই ক্যান্টনমেন্টগুলাে ছিল ব্রিটিশ স্টাইলে প্রতিষ্ঠিত সেনানিবাস, যেখানে কমান্ড ও কন্ট্রোল ছিল কড়া। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন বন্দর থেকে এসব ক্যান্টনমেন্টে যােগাযােগের পথগুলােকে তাদের প্রধান টার্গেট করেন। তা ছাড়া পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একমাত্র তেল শােধনাগারটি ছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টগুলাের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে কাবু করার কৌশল অবলম্বন করেন মুক্তিযােদ্ধারা।

মুক্তিযােদ্ধারা ইতিমধ্যে প্রচুর বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ আস্থাও তাঁদের মনে সৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বর মাসের ১০-১১ তারিখে ১২ জন সাঁতারু গেরিলা ছিনতাই করা দুটি লঞ্চে চেপে পৌছান আকরাম পয়েন্টে। জায়গাটি হলাে পশুর নদে ঢােকার মুখ। গেরিলাবাহিনীর মধ্যে ছিলেন কয়েকজন সাবেক নৌসেনা এবং কয়েকজন নতুন প্রশিক্ষিত সাঁতারু। মধ্য নভেম্বরে কুয়াশা নেমেছিল। কেড়ে নেওয়া একটি ৪০x৬০ বােফোর্স গান নিয়ে গেরিলাবাহিনী কুয়াশার মধ্যে লঞ্চ দুটি ভাসিয়ে দিল। এ রকম আবহাওয়ায় লঞ্চ দুটিকে শনাক্ত করা কঠিন। . সে সময় ‘সেন্ট অ্যালবানস’ নামের সাত হাজার টনি একটি ব্রিটিশ ফ্রেইটার পশুর খালে ঢুকতে শুরু করে। লঞ্চের মুক্তিযােদ্ধারা শুধু জাহাজটির আবছা সীমারেখাটি দেখতে পান এবং তৎক্ষণাৎ গুলি করা শুরু করেন। ভাগ্যক্রমে কেউ কোনাে আঘাত পাননি।

সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর অভিযানগুলাের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বাইরে থেকে সরবরাহ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। বেশির ভাগ বিদেশি জাহাজ পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরগুলাে থেকে বিদায় নিয়েছিল এবং তারা আর এদিকে ভিড়ছিল না। তবে উচ্চ হারে যুদ্ধঝুঁকি প্রাপ্তির লােভে গ্রিস ও পানামার জাহাজগুলাে সরবরাহ বহন অব্যাহত রেখেছিল। তারা তাদের জাহাজে পতাকাও ওড়াচ্ছিল। এ সাঁতারু বাহিনী পশুর নদের প্রবেশপথে মাইন পেতে দিল। বিশেষ ধরনের মাইন, যাতে শিপ-কাউন্ট মেকানিজম ছিল। সম্ভবত মাইনটি তারা চুরি করেছিলেন চিটাগাং অর্ডিন্যান্স ডিপাে থেকে।

পৃষ্ঠা: ২২৯

এই অভূতপূর্ব মাইন অভিযানের প্রথম শিকার হয় গ্রিক ফ্রেইটার জাহাজ ‘ক্রাইনােভেলান্দু’। এই জাহাজটি স্থানীয় অধিবাসীদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিল, কারণ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সরবরাহ করা হচ্ছিল এতে করে। তাই মাইন বিস্ফোরণে জাহাজটি যখন তলিয়ে গেল, তখন স্থানীয় অধিবাসীরা খুশি হয়েছিল। মাইনের বিস্ফোরণে জাহাজটির আঘাত ছিল নাটকীয়। কোনাে প্রাণহানি ঘটেনি, কিন্তু জাহাজটি ধীরে ধীরে তলিয়ে গেছে, যার ফলে পশুর খালে জাহাজ চলাচলের উপযােগী একটা অংশ বন্ধ হয়ে যায়। এ মাস্ত্রোসতেলােস’ নামের আট হাজার টনি অন্য একটি গ্রিক ফ্রেইটার আরেকটি মাইনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অকেজো হয়ে যায়। এর ফলে সম্পূর্ণ পশুর চ্যানেলটি জাহাজ চলাচলের অনুপযােগী হয়ে পড়ে। মাইন পাতার কাজে ব্যবহৃত কোনাে রকম যন্ত্রপাতি বা জলযান ছাড়াই মাইন ব্যবহারের এ রকম সাফল্যের ঘটনা বিরল। পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তর বন্দরটি অতঃপর আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়।

নভেম্বর থেকে বিজয়। নভেম্বরে ১৭২ জন সাঁতারু যােদ্ধা আরও ব্যাপক এক অভিযানে অংশ নেন। এবার প্রতিজোড়া সাঁতারু বহন করেন দুটি করে লিমপেট মাইন ও একটি করে হ্যান্ডগ্রেনেড। রাত থেকে ভাের পর্যন্ত অভিযান চলে; শীতের রাতের কুয়াশার সুবিধা নেওয়া হয়। লেফটেন্যান্ট জিয়ার নেতৃত্বে সাঁতারু বাহিনী গাবখান খাল নিষ্ক্রিয় করে দেন। খুলনায় ‘মিনিলেবার’ নামের একটি বাল্ক ক্যারিয়ার এবং মােংলায় কলম্বিয়া ট্রেডার’ নামের একটি জাহাজ হালকা। এয়ারক্র্যাফট ও হেলিকপ্টারের পাহারা সত্ত্বেও সাঁতারু বাহিনী বিকল করে দেয়। চট্টগ্রামে সিদ্দিকী (কাদের সিদ্দিকী নন) নামের একজন সাঁতারু গেরিলার নেতৃত্বে একটি ট্যাংকার ও একটি বিশাল বার্জ ডুবিয়ে দেয় সাঁতারু বাহিনী। এই আক্রমণের পর সাঁতারুদের মধ্যে দুজন হারিয়ে যান। তারা আর কখনাে ফিরে আসেননি। ও নারায়ণগঞ্জে ৮০০ টনি গমের জাহাজ ‘মিনি লায়ন’, একটি মােটরলঞ্চ এবং একটি ফেরি ডুবিয়ে দেয় সাঁতারু বাহিনী। চাঁদপুরে শরিফ আর বুড়া মিয়া তিনটি বিশাল বার্জ এবং এমভি শামী’ নামের একটি কোস্টার ডুবিয়ে দেন। চাঁদপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আক্রমণ চালানাে হয়। পারেরহাট ও মােহনপুরের ইমাম ও রহমান লিলি’ নামের একটি কোস্টার জাহাজ ও একটি ছােট জলযান ডুবিয়ে দেন। আলাশপুরে সাঁতারু বাহিনী ‘জয়পুর’ ও ‘গফুর’

পৃষ্ঠা: ২৩০

নামের বিশাল বার্জ ডুবিয়ে দেয়। সােবহান’ ও ‘কল্পনা’ নামের দুটি লঞ্চ। সাঁতারু বাহিনী দখল করেছিল। ভাদুরঘাটে একটি বিশাল আকারের বার্জ ও একটি স্টিমার ডুবিয়ে দেওয়া হয়। বরিশালে আলম ও কুতুবদ্দীন ‘এমভি স্লেটার’ ও ‘আফ্রিকা প্রক্টর’ জাহাজ দুটিতে লিমপেট মাইন সেঁটে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান যে ভাটা শুরু হচ্ছে। জাহাজের সেন্ট্রিরা খােলা লিমপেটগুলাে দেখে ফেলে এবং দ্রুত বিস্ফোরক সরিয়ে নেয়।

নভেম্বর মাসে সাঁতারু বাহিনীর বিভিন্ন আক্রমণে মােট ২০ হাজার টন। শিপিং সামগ্রী ডুবে যায় এবং ১৮ হাজার টন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুক্তিবাহিনীর সাঁতারু দল ছিল একটি ছােট্ট গেরিলাবাহিনী, পূর্ব বাংলার নদীনালা-খালে-বিলে এরা মাছের মতােই স্বচ্ছন্দে চলতে পারত। এই স্বল্পসংখ্যক তরুণ-যুবক তাদের অপরিসীম সাহসিকতা, মাতৃভূমির জন্য। ভালােবাসা, কষ্টসহিষ্ণুতা আর দৃঢ়তার বলে চট্টগ্রাম, চালনা, মােংলা ও খুলনা–পূর্ব পাকিস্তানের এ প্রধান চারটি বন্দর অচল করে দিয়েছিলেন। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলােতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্দরসমূহের পরিচালকেরা বন্দর বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের জাহাজ প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর পর সাতারু মুক্তিবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীর। সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তার মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে পাকিস্তানি। বাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

অনুবাদ : মশিউল আলম।

পৃষ্ঠা:  ২৩১

Reference:

১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!