মুজিব বাহিনী গঠনের রাজনীতি
মে. জেনারেল এস এস উবান
মে. জেনারেল এস এস উবান ১৯৭১ সালে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা আরএডব্লিউর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি মুজিব বাহিনী গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী তিব্বতীয়দের নিয়ে তিনি স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স (এসএফএফ) গঠন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মুজিব বাহিনী ও এসএফএফকে সঙ্গে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযান শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি এসে পৌছান। মুজিব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ আর যুদ্ধকৌশল দিয়ে সংগঠিত করে তুলেছিলেন মে. জেনারেল উবান। সে সূত্রে গভীর মানবিক আর আবেগময় সম্পর্কে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন এ বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে। সেই অন্তরঙ্গতা ও অভিজ্ঞতার আলােকে মে. জেনারেল উবান স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর ফ্যান্টমস অব চিটাগং দ্য ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ বইয়ে। সে বইয়ের মুজিব বাহিনীসংক্রান্ত পরিচ্ছদগুলাের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ নিয়ে এ রচনা। রচনাটি ১৯৯৮ সালের ২৬ মার্চ ভােরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কর্নেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্থায়ী চিফ অব স্টাফ এবং সে পদমর্যাদায় মুক্তিযােদ্ধাদেরও প্রধান। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের প্রয়ােগ করার ব্যবস্থাদি সম্পর্কে অস্থায়ী সরকারকে পরামর্শ দিতেন। পরবর্তীকালে ভারত সরকার যখন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, কর্নেল ওসমানী তখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরােরার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করতেন এবং প্রশিক্ষণ শিবিরগুলাের তত্ত্বাবধান করতেন।
পৃষ্ঠা: ২০৪
হাজার হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা, যাদের মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মতাে নিয়মিত ইউনিটও অন্তর্ভুক্ত ছিল, বিভিন্ন কোম্পানি এবং ব্যাটালিয়নে মুক্তিবাহিনী নামে সংগঠিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নিজস্ব নেতৃত্বে যুদ্ধ করছিল। যেখানে নেতৃত্ব ভালাে ছিল, সেখানে ভালােই লড়ছিল ওরা। সীমান্তবর্তী এলাকায় লক্ষ্যবস্তুর ওপর কমান্ডাে কায়দায় আক্রমণ পরিচালনা করছিল মুক্তিবাহিনী, অথচ এ জন্য তাদের ছিল না পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জা। ফলে প্রায়ই তাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল পরিহারযােগ্য ক্ষয়ক্ষতির।
এই বাহিনীকে দেশের সুদূর অভ্যন্তরে পাঠানাের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলাে তাদের পাঠানাে হচ্ছিল ব্যাচপ্রতি প্রায় ২০০ জনের মতাে। করে। ছােট ছােট গ্রামে এত বড় দলের স্থান সংকুলান হতাে না, ফলে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এসব অস্বাভাবিক দলকে সহজেই খুঁজে বের করে ফেলত। মুক্তিবাহিনীর দল গ্রাম ত্যাগ করার পর তাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ গ্রামগুলােতে চালাত নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। এসব কারণে গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের আগমন অজনপ্রিয় এবং নিষ্ফল হয়ে উঠছিল। হাইকমান্ড তবু পূর্বাপর বিবেচনা না করেই এদের ক্রমাগত ভেতরের দিকে ঠেলে পাঠাতে থাকে।
এ সময় হাজার হাজার তরুণ-যুবা প্রশিক্ষণ নিতে আসছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণার্থীদের সবার উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা যাচাই করার কোনাে সন্তোষজনক ব্যবস্থা ছিল না। প্রশিক্ষণার্থীদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পগুলােকে নির্ভর করতে হতাে অস্থায়ী সরকার কর্তৃক নিয়ােজিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের (এমএনএ) দেওয়া সার্টিফিকেটের ওপর। এমএনএরা বাঙালি অফিসারদের প্রস্তুত করা তালিকা অনুযায়ী অন্ধভাবে সার্টিফিকেট দিতেন। এদের কারও কারও ভেতর ছিল পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ফলে কয়েকটি দল অস্ত্রসমেত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উধাও হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ অস্ত্র লুকিয়ে রেখে ফিরে এসে রিপাের্ট করে যে শত্রুর আক্রমণে অস্ত্র বেদখল হয়ে গেছে। এই অশুভ তৎপরতা নির্মূল করার জন্য একটা নিচ্ছিদ্র সমাধান বাতলানাে হয়, কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে। সেটা গ্রহণযােগ্য হয়নি। কারণ, উচ্চ পদমর্যাদার কারণে তাঁরা তাঁদের জ্ঞানকেও উন্নততর মনে করতেন।
এই ভুলের মাশুল বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। এই সংকট এতটাই বিস্তৃত হয়েছে ও পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছে যে এ থেকে বেরােতে বহু সময় লেগে যাবে।
পৃষ্ঠা: ২০৫
মুজিব বাহিনী এই গােলযােগপূর্ণ সময়ে আমরা কয়েকজন উৎসর্গীকৃতপ্রাণ যুবনেতার সাক্ষাৎ পাই, যাদের নাম বাংলাদেশে সুপরিচিত ছিল। এরা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তােফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। এঁদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ এই ধারণা দেয় যে এঁরাই হচ্ছেন একমাত্র নেতা, যারা ভালাে কিছু দিতে পারবেন।
এঁদের প্রেরণাময় মরণপণ অঙ্গীকারে আবদ্ধ মনে হলাে। সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে এঁদের নেতৃত্ব বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গ্রহণযােগ্য। দুর্ভাগ্যজনক হলাে অস্থায়ী সরকারের মধ্যে এঁদের এ রকম কোনাে মর্যাদা মেনে নেওয়ার মতাে মনােভাব ছিল না। সরকার চাইছিল এঁদের মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বের অধীনে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ করাতে। কিন্তু তরুণ এই নেতাদের এ-জাতীয় প্রশিক্ষণের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি ছিল। মুজিবের প্রতি এঁদের একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং তাঁর সঙ্গে নৈকট্যের কারণে এঁদের সবাই মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের দেওয়া কারাদণ্ড ভােগ করেছে। এরা ‘মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিত হতে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। ওঁরা ওঁদের পুরােনাে সহকর্মীদের বাছাই করে তাঁদের একনিষ্ঠ আনুগত্য সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকে যথেষ্ট ত্যাগী, দৃঢ়চেতা এবং বিশ্বস্ত লােকদের ওঁরা বাছাই করে এনে চাপ দিতে থাকেন, যাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যে রকম কমান্ডাে ট্রেনিং পাচ্ছিল, তার বদলে যেন এদের অপ্রথাগত যুদ্ধের আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বােধ হয় দলের নেতৃত্ব দিতে চাইছিলেন ওঁরা। সেনাবাহিনীর অধীনে প্রশিক্ষণরত হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযােদ্ধা, যারা আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেনি, তাদের খাঁটিত্ব সম্পর্কে এই নেতারা নিশ্চিত ছিলেন না। সে কারণে ওঁরা ওঁদের সংগঠন অথবা গােপন সেলগুলাে সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীর কাছে কিছু প্রকাশ করার ব্যাপারে সাবধানী ছিলেন। . কর্নেল ওসমানী কমান্ডের ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছিলেন, যা যেকোনাে যুদ্ধের অবশ্যই সবচেয়ে প্রয়ােজনীয় উপাদান। অস্থায়ী সরকার গঠন করেছেন এমন কিছু জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতাও তরুণ নেতাদের দ্বারা গঠিত আওয়ামী লীগের যে সংগঠন এবং তার আলাদা কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই ইস্যুতে উভয় পক্ষই ছিল অনমনীয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের মাধ্যমে কেবল অস্থায়ী সরকারের মতামতই গ্রহণ করত, এবং যে রকম কার্যকর ও দেশপ্রেমিকই হােক না কেন, অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিল না।
পৃষ্ঠা: ২০৬
আমি এ-জাতীয় পরিস্থিতিতে একটা সুসংগঠিত এবং প্রতিষ্ঠিত, ত্যাগী ও অনুপ্রাণিত যুবসংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। গােপনীয়তা রক্ষার খাতিরেও এ রকম একটা সংগঠনের প্রয়ােজন রয়েছে বলে বুঝতে পারি আমি; বিশেষ করে এমন একটা পরিস্থিতিতে, যখন যে কেউ মুক্তিযােদ্ধার পােশাকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসমেত বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারত। সাধারণ জ্ঞানও বলছিল যে আমাদের মুজিব বাহিনীকে সমর্থন করা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কমান্ডের অধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে সব মহলের কাছে গণ্য তাজউদ্দীনের কাছ থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশাল আকারের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের (মুজিব বাহিনী) সম্পর্ককে স্বচ্ছন্দ করার যথাযােগ্য চেষ্টা করা উচিত।
তখন আমার অসামরিক ওপরওয়ালা কেবিনেট সচিবালয়ের সচিব আর এন কাওয়ের ছিল আওয়ামী লীগের যুব অঙ্গসংগঠনটি এবং তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যপ্রাপ্তির সুযােগ। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যেসব তরুণ নেতাকে তিনি আমার তত্ত্বাবধানে দিয়েছেন, একমাত্র তারাই ভালাে কিছু দিতে পারে এবং বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য তাদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া প্রয়ােজন। তিনি তরুণ নেতাদের প্রতি অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের পুষে রাখা ঈর্ষার ব্যাপারটা জানতেন, যার কারণ ছিল এই নেতাদের উগ্র মস্তিষ্ক এবং আপসহীন। মনােভাব আর তাদের (মন্ত্রীদের) উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অভিসন্ধি। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য যখনই সম্ভব তিনি যথাসাধ্য করেছিলেন কিন্তু সমালােচনার ধকলগুলাে প্রায় সব সময় আমাকেই সইতে হয়েছে, কারণ তাদের (মুজিব বাহিনী) প্রশিক্ষণ এবং মাঠে নামানাের জন্য আমিই ছিলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক।
এ ব্যাপারে আমার অসুবিধাগুলাে আরও বৃদ্ধি পায় যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ডি পি ধর আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম দেখাশােনা শুরু করলেন।
যুবনেতাদের চারজন শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন এক টুকরাে জ্বলন্ত কাঠসদৃশ বিরল প্রকৃতির মানুষ। তিনি এসেছিলেন প্রকৃতিদত্ত নেতৃত্ব নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ছিল উৎসর্গীকৃত প্রাণ এবং সে জন্য যেকোনাে ত্যাগে প্রস্তুত। অসুস্থ অবস্থাতেও কাজ বন্ধ হতাে না তাঁর, প্রায়ই অসুখে পড়তেন, আর সীমান্তবর্তী এলাকায় ওঁর গােপন আস্তানায় ডাক্তার পাঠিয়ে যথাসাধ্য চিকিৎসার কঠিন কাজটা আমাকেই করতে হতাে।
পৃষ্ঠা: ২০৭
সিরাজ ছিলেন বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং অনমনীয়। তিনি যুদ্ধ করতেন বাঘের মতাে আর কাজ করতেন ত্যাগী ভূত্যের মতাে। শুধু চা খেয়ে নিঘুম উপবাসে কাজ করতে পারতেন দিনের পর দিন। বক্তৃতা করতে পছন্দ করতেন না, মুজিব বাহিনীর ছেলেদের সামনে কিছু বলার জন্য তাঁকে সাধাসাধি করতে হতাে। একজন কর্মবিশ্বাসী মানুষ এবং তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর মতােই কথা বলতেন। প্রচারণা পরিহার করে নিভৃতে কাজ করা ছিল ওঁর পছন্দ।
আইয়ুব শাসনামলে মিথ্যা অপরাধে কারান্তরীণ শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তােলার দায়িত্ব পালন করেন যে ছাত্রনেতা, তিনি হচ্ছেন তােফায়েল আহমেদ। যখনই তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের সামনে পৌছাতেন, ছাত্ররা প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে সব শৃঙ্খলা বিস্মৃত হয়ে তাদের প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য ছুটে আসত।
আবদুর রাজ্জাক ছিলেন প্রীতিভাজন, সংস্কৃতিমান, রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক ও সুবক্তা। সাংগঠনিক কাজে ছিল তাঁর বিশেষ দক্ষতা। সময় ও নিয়মনিষ্ঠ রাজ্জাক সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী এবং উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সব ধরনের ত্যাগে প্রস্তুত।
রাজনৈতিক কলহ এই চারজনের আমি নাম দিয়েছিলাম ‘অবিচ্ছেদ্য চতুষ্টয়’। এঁরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতেন। খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা করতেন একসঙ্গে। আমার মনে হলাে এঁরা শেখ মনির নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন, সম্ভবত তিনি শেখ মুজিবের ভাগনে বলে। তাঁরা তাঁদের ছেলেদের গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যগ্র ছিলেন, যা দেওয়ার মতাে বিশেষ সামর্থ্য আমাদের ছিল।
সেনাবাহিনী কেবল নিয়মিত এবং কমান্ডাে ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে পারত, যার জন্য হাজার হাজার যুবক এগিয়ে আসছিল এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী গঠনের জন্য। এই চার নেতা আমাদের জানান যে বাংলাদেশে নকশাল বাহিনীর অনুরূপ বহু অবাঞ্ছিত ব্যক্তি প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পাচ্ছে। ওঁরা সতর্ক করে দেন যে এসব অস্ত্র পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, বরং স্বাধীনতার পর নকশাল আন্দোলনের অনুরূপ কিছু করার জন্য বাংলাদেশে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। বস্তুত তারা মুক্তিবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশের কিছু সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্কিত চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের নাম উল্লেখ করেন, যাদের অনুমােদনক্রমে বিপুলসংখ্যক কমিউনিস্ট ক্যাডারকে রিক্রুট করে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অস্ত্রসজ্জিত করা হচ্ছিল।
পৃষ্ঠা: ২০৮
ব্যাপারটা বিশ্বাসযােগ্যভাবে কর্তৃপক্ষের গােচরে আনা হয়, তবে ফলাফল ছিল। শূন্য। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে আরেক ধরনের মুক্তিযােদ্ধা ছিল, যারা সাম্প্রদায়িক এবং পাকিস্তানপন্থী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে এরা অস্ত্র। সমর্পণ করবে না, এটা ছিল নিশ্চিত, বরং একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পরিকল্পনা ছিল ওদের, যাতে পাকিস্তানিরা ফিরে আসার সুযােগ পায়। সৌভাগ্যবশত পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার নৃশংসতার কারণে এরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। এদের মধ্যে তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ ছিল অসাধু চরিত্রের স্বেচ্ছাসৈনিক এবং ডাকাত, যারা অত্যাধুনিক অস্ত্রই শুধু নয়, ভারতীয় খরচে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তির সুবর্ণ সুযােগও পাচ্ছিল।
আমি সরকারকে মুক্তিবাহিনীর ভেতর উপরিউক্ত তিন ধরনের চক্র সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে সাবধান করে দিই যে এরা একজোট হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। মুজিব বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি সব মুক্তিযােদ্ধাকে নিশ্চিতভাবে যাচাই করার একটা কৌশল বাতলে দিই, যা কার্যকর করা হয়নি। দিনেরাতে এই যুবনেতারা আমার কাছে আসত এবং নতুন নতুন প্রমাণ নিয়ে তাঁদের স্থিতিশীলতার এই বিপদ সম্পর্কে আমার কাছে অভিযােগ করতেন। একইভাবে আমি তাদের নিশ্চিত করতাম যে এটা বন্ধ করার জন্য আমি আমার সাধ্যমতাে করব। আমি জানতাম, যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি, সেখানে এটা সম্ভব নয়।
আরও বেশিসংখ্যক মুক্তিবাহিনী সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ক্রমবর্ধনশীল চাপ অব্যাহত ছিল। জোর দেওয়া হচ্ছিল যত বেশি সংখ্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তার ওপর। তারা ছিলও পর্যাপ্ত। সে সময় কেবল একটা নিয়মমাফিক ব্যবস্থা চালু ছিল যে তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের দুজন মনােনীত সদস্য (এমএনএ) মুক্তিযােদ্ধাদের অকৃত্রিমতা সত্যায়িত করতেন। আগ্রহী যেকোনাে দল কর্তৃক যে তালিকাই দেওয়া হােক, সামান্যতম দায়সারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আওয়ামী লীগের এই দুই কর্তাব্যক্তি সেটা সত্যায়িত করে দিতেন। একবার তালিকাতে স্বাক্ষর করে ফেলার পর তাঁরা এ কথা স্বীকার করতেও প্রস্তুত ছিলেন না যে অবাঞ্ছিত লােককে সত্যায়িত করে নিজেরা ভুল করেছেন। সমগ্র ব্যাপারটা এতই গতানুগতিক ছিল যে ধারণা করা যায়, হয় এই এমএনএ দুজন আগ্রহী মহল কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত কিংবা স্বাধীনতার পর তাদের দেশে যা-ই ঘটুক না কেন, সে ব্যাপারে তারা আগ্রহী নন।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার, যা বলতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেই বােঝাত, কোনােভাবেই মুজিব বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে অভিন্ন মত পােষণ
পৃষ্ঠা: ২০৯
করতেন না এবং তাদের সব অভিযােগই দেখতেন হালকাভাবে। কর্নেল। ওসমানী তাঁর সরকারের কাছ থেকেই নির্দেশ গ্রহণ করতেন এবং এই যুবনেতাদের সঙ্গে বাহ্যিকভাবে বন্ধুভাবাপন্ন হলেও মুজিব বাহিনী নামের আলাদা কোনাে বাহিনী পরিচালনার ব্যাপারটা পছন্দ করতেন না, বিশেষ করে যে বাহিনী তাঁর সার্বিক কমান্ডের অধীনে থাকবে না। সামগ্রিক অপারেশন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ােজিত পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল অরােরাও ব্যাপারটা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ মুজিব বাহিনী সরাসরি তার কমান্ডের অধীনে ছিল না, যদিও মুজিব বাহিনী কমান্ডের একজন সৈনিক হিসেবে আমি তাঁকে নিশ্চিত করেছিলাম যে এই বাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতর কার্যকর করার জন্য তাঁর যেকোনাে নির্দেশ মান্য করবে এবং আমি এর ফলাফল অবহিত করার জন্য তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করে চলব। এতেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না, যেহেতু আমি নিজেও সরাসরি তাঁর কমান্ডের অধীন ছিলাম না। এই বিশেষ ধরনের কমান্ড কাঠামাে গঠনের কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার বিশদ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জেনারেল অরােরা তা বুঝতে সক্ষম হননি। কখনােই।
সমস্যার মূলে যুবনেতারা সব সময় অভিযােগ করছিলেন যে তাজউদ্দীনের সঙ্গে জেনারেল অরােরার কোনাে বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক যােগসাজশ আছে। কারণ, তাঁরা দুজনই চাপ দিচ্ছিলেন যাতে মুজিব বাহিনী তাদের কমান্ডের অধীন থেকে পরিচালিত হয়, তাজউদ্দীনের প্রতি আনুগত্যহীন এই যুবনেতাদের অধীনে নয়। আমি জানতাম যুবনেতারা তাজউদ্দীনের সমমতাবলম্বী ছিল না, যিনি বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন তাঁর আবেগের আতিশয্য দিয়ে। এরা বরং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিল, কিন্তু তাজউদ্দীনের প্রতি নয়। আমি এই ভুল-বােঝাবুঝি দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি কিন্তু এর মূল ছিল অতীতের গভীরে, তাই পুরােনাে মনােভাব মুছে ফেলার জন্য কিছুই করা যায়নি।
যুবনেতারা যেকোনােভাবে হােক বয়ােজ্যেষ্ঠ এমএনএ এবং এমপিদের একটা দলকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাজউদ্দীনবিরােধী প্রােপাগান্ডা চালায় যে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি বেদখল করা হয়েছে, যা তাদের মতে অন্য কারও পাওয়া উচিত ছিল। আমার মনে হয় ওরা সৈয়দ নজরুল ইসলামের কথা মনে রেখে এ কথা বলছিল। ব্যাপারটা একটা বিশ্রী রূপ নিতে পারত যেহেতু যুবনেতারা তাজউদ্দীনকে তার স্থান দেখিয়ে দেওয়ার জন্য পাগলপ্রায় ছিলেন।
পৃষ্ঠা: ২১০
এ পর্যায়ে অস্থায়ী সরকারের মধ্যে একটা ভাঙন পুরাে আন্দোলনের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনতে পারত। আমার মনে হয় আমি যুবনেতাদের বােঝাতে সক্ষম হই যে এ রকম কোনাে পদক্ষেপ তাঁদের মিশনের জন্য বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকিপূর্ণ, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের জন্য আরও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। সৌভাগ্যক্রমে ওঁরা আমার সঙ্গে একমত হন, যদিও ভেতরে ভেতরে তাজউদ্দীনকে ওঁরা ভাজা ভাজা করে ফেলছিলেন, যা আমার মতাে অল্প কয়েকজন বন্ধু ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ জানত না। আমার মনে হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামও ওঁদের সাবধান হতে পরামর্শ দেন এবং এভাবেই একটা মারাত্মক রাজনৈতিক হুমকি এড়ানাে সম্ভব হয়।
কমিউনিস্ট-ভীতি
তখনাে আরও একটা, সম্ভবত আরও স্পর্শকাতর সমস্যা রয়ে যায়, যার প্রতি আশু মনােযােগ দেওয়া প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। যুবনেতারা ভারতের অভিজাত হােটেলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নকশালপন্থী লােকজনকে গল্পগুজব করতে দেখেন। শেষােক্তরা এসব হােটেলেই থাকত বলে মনে হয়। যুবনেতারা জানতেন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনামলে এরাই তাদের নিকৃষ্টতম শত্রু ছিল। মূলত এদের বিরুদ্ধেই আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। যুবনেতারা বুঝতে পারছিলেন না যে তাঁদের চিহ্নিত শত্রুর সঙ্গে ভারত সরকার কেন পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে। ওঁরা তাই ভুলভাবে এর সারার্থ করেন যে বাংলাদেশে শক্ত ভিত্তির ওপর একটা কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড় করানােই আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য। ওঁরা বিশ্বস্ত সূত্রে এ খবরও পান যে মার্ক্সবাদী কর্মী এবং মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের আলাদা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা ওঁদের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন ছিল। যথারীতি আমার ওপর রাগ ঝাড়ার জন্য ছুটে আসেন ওঁরা। ওঁদের সঙ্গে আমার কথােপকথন হয় এ রকম :
যুবনেতারা : স্যার, আমরা আশা করিনি, গত ২৫ বছরে আমাদের অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য আপনারা মার্ক্সবাদী এবং নকশালিদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দেবেন।
সম্পূর্ণ হতচকিত এবং রক্তিম মুখে আমি বলি : কী বলছেন আপনারা?
যুবনেতারা : তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি জানেন না যে নকশালিরা অমুক স্থানে ট্রেনিং ও অস্ত্র পাচ্ছে আর ভারতীয় অফিসাররা তাদের নেতাদের প্রথম শ্রেণির হােটেলে রেখে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে।
আমি : এ ধরনের বাজে কথা এর আগে আমি কখনাে শুনিনি। আমার সব
পৃষ্ঠা: ২১১
সময়ই মনে হয়েছে শত্রুদের মধ্য থেকে কেউ আমাদের মধ্যে ভাঙন ধরাবে। এখন বলুন কে আপনাদের কাছে এই মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছে?
যুবনেতারা : আমরা নিজ চোখে দেখেছি, নিজ কানে শুনেছি। এখানে ভুল হওয়ার কোনাে অবকাশ নেই। আমরা খুবই হতাশ এবং আমাদের সামগ্রিক মনােভাব পুনর্বিবেচনা করতে চাই। আমরা আপনার কাছ থেকে কখনােই কিছু লুকাব না। আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি আপনার বিশ্বস্ততার জন্য আমরা সব সময়ই আপনাকে ভালােবাসি। সম্ভবত আপনার দেবতুল্য চরিত্রের কারণেই আপনার সরকার আপনাকে বিশ্বাস করেনি। খুব সম্ভব তারা কোনাে বিদেশি শক্তিকে সহযােগিতা করে তাদের খুশি করতে চাইছে। দয়া করে আপনি একটু তদন্ত করে আপনার সরকারের মনােভাবটা আমাদের জানান। আমরা আমাদের দেশে, এমনকি সােভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানকে বুঝতে পারি, যা কেবল বইপত্রে সীমাবদ্ধ, কিন্তু চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কেন? . আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। একমাত্র ঈশ্বর জানেন আমি আমার দেশের ভেতর এমন কোনাে কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। রাশিয়ার প্রতি আমার নিজের শ্রদ্ধাবােধ ছিল, যারা আমাদের প্রয়ােজনের সময় আমাদের সাহায্য করার জন্য এত কিছু করেছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে বাংলাদেশে চীনপন্থী একটা কমিউনিস্ট পার্টিকে দাঁড় করানাের জন্য আমার দেশের কেউই সহায়তা করবেন না।
আমি যুবনেতাদের মনােভাব সম্পর্কে আর এন কাওকে অবহিত করার পর আমাকে বিস্মিত করে তিনি এই তথ্য জানালেন যে মওলানা ভাসানীর নকশালিরা অন্য আরেক জায়গায় প্রশিক্ষণরত। তাদের আমার হেফাজতে দেওয়া হয়নি, কারণ তিনি নিশ্চিত জানতেন যে এ ধরনের কোনাে প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করব না এবং আমাদের যুবনেতারা খুব দ্রুত তাদের খোঁজ পেয়ে যেত, আর এতে একটা মারাত্মক গােলযােগ সৃষ্টি হতাে।
আমি এই আবিষ্কারের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সেক্রেটারি মি. কাওয়ের প্রতি আমি সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিলাম, কারণ তাঁর যােগ্যতা ও বিশ্বস্ততা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন ঈশ্বরভক্ত লােক এবং আমার প্রতি সর্বদাই সদয় এবং সৌজন্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু এবারে আমার বিরক্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি যুবনেতাদের কাছে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখােমুখি হই। আমার কোনাে দোষ না থাকলেও আমি আমার বিশ্বাসযােগ্যতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। এ ব্যাপারটা আমাকে আগে অবহিত করা হলে আমি এই পদক্ষেপকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের জন্য কিছু একটা অজুহাত বের করতে পারতাম কিংবা এই সক্রিয় যুবকদের বােঝানাের মতাে করে বিষয়টা উপস্থাপন করতে পারতাম।
পৃষ্ঠা: ২১২
আর এন কাও আমাকে কেবল জানালেন, আমরা বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করিনি, যারা ভাসানীর লােকদের পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সম্পদ মনে করে। আমরা ওদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করি কীভাবে? তােমার যুবনেতাদের বলাে যে ব্যাপারটা ওরা পছন্দ না করলেও এটা ওদেরকে গিলতে হবে। সার্বিক পরিকল্পনায় আমরা ওদের কেবল গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে সমর্থন জানাব, কিন্তু কোনাে স্বাধীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে নয়। ওরা যদি ঠিকমতাে না চলে, আমাদের কিছু করার নেই। গােল্লায় যাক ওরা।’ অথবা এ-জাতীয় কোনাে শব্দই ব্যবহার করেছিলেন তিনি।
আমি জানি অভিমানবশত যা তিনি বললেন, সেসব আসলে বােঝাতে চাননি, কারণ এ রকম ত্যাগী এবং বিশ্বস্ত নেতৃত্বের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের ভেতরের আসন্ন কর্মযজ্ঞ কীভাবে সমাধান করবেন তিনি? আর এন কাও প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও একটা চরম স্পর্শকাতর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনন্যসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারি নির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা তিনি সম্ভবত এড়াতে পারেননি। অবিশ্বস্ত লােকজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এই সুস্পষ্ট ভুল পদক্ষেপের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হয়ে একটা হতাশ মনােভাব নিয়ে আমি তার অফিস ত্যাগ করি।
আমি যুবনেতাদের বলি যে স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ। করতে যারা প্রস্তুত, তাদেরকে তাদেরই অস্থায়ী সরকারের সুপারিশ মােতাবেক ভারতীয় সরকার সহায়তা প্রদান করছে। এতে করে অবাঞ্ছিত লােকজন পরিস্থিতির সুযােগ নিতে পারে—সেটা খুবই সম্ভব, সে জন্য ওঁদের দ্বিগুণ সতর্ক থাকতে হবে।
তবু যুবনেতাদের ভেতর সন্দেহ ও আশঙ্কা রয়ে গেল। ফলে ওঁরা আমাকে ছাড়া অন্য কারও কাছে ওঁদের গােপন সেল ও আস্তানা এবং গতিবিধি সম্পর্কে কোনাে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে আরও সাবধান হয়ে যান। আমি ওঁদের কথা দিই যে ওঁরা অনুমতি না দিলে ওঁদের সংগঠন সম্পর্কে ওঁরা আমাকে যা বলেছে আর যা বলবে, সেসব অন্য কারও কাছে ফাঁস করব না। এসব তথ্য আমার কাছে খুবই দরকারি ছিল, কারণ আমি আমার যাবতীয় পরিকল্পনা করতাম ওঁদের সহযােগিতা নিয়ে। আমাদের একত্রে কাজ করার সুবাদে আমার প্রতি ওঁদের অগাধ বিশ্বাস উৎপন্ন হয়। এতে আমি সম্মানিত বােধ করি এবং কোনাে অবস্থাতেই এই বিশ্বাস ভঙ্গ করতাম না আমি। ওঁরা ওঁদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের, এমনকি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছেও ওঁদের গােপন তথ্য প্রকাশ করতেন না। তাজউদ্দীনকে ওঁরা দৃঢ়ভাবে সন্দেহ করতেন যে স্বাধীনতার পর তিনি শেখ মুজিবকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করবেন। পরে
পৃষ্ঠা: ২১৩
তারা আমাকে অকপটে বলেন, ‘তাজউদ্দীন আপনাদের কমিউনিস্ট মন্ত্রী ডি পি ধরের সঙ্গে একজোট। আমরা দুজনের কাউকেই বিশ্বাস করি না। আমাদের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ব্যাপারে ওঁদের কী যে পরিকল্পনা আছে, সেটা আপনাদের সরকারও জানে না।
ওঁরা কর্নেল ওসমানীকেও, যিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন, কোনাে তথ্য জানাতেন না, অথবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরােরাকেও নয়, যিনি তাঁদের বিচারে ধারণাতীত কোনাে কারণে ওঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে খেলছেন। আমাকে ওঁরা প্রায়ই বলতেন যে জেনারেল অরােরা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাজউদ্দীনকে প্ররােচিত করছেন এবং চাপ দিচ্ছেন মুজিব বাহিনীকে যাতে তার কমান্ডের অধীন করা হয়।
নামকরণ সমস্যা সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী ছিল এক দুর্ধর্ষ বাহিনী, যার সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক হাজারে। এই বাহিনী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযােগিতায় বাংলাদেশ সীমান্তে মােতায়েন ছিল। সীমান্তে অবস্থান গ্রহণ করছিল তারা। সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের কারণে সুসজ্জিত পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর কমান্ডাে কায়দায় হামলা চালানাের জন্য যথেষ্ট পারঙ্গম ছিল না ওরা, ফলে ওদের প্রায়ই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। কিন্তু প্রেরণা এবং হাইকমান্ডের বিরামহীন চাপ ওদের মনােবল চাঙা রাখছিল। গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করার সীমিত জ্ঞানবশত সেনা কমান্ড একেক দলে প্রায় ২০০ জন মুক্তিবাহিনী সদস্যকে বাংলাদেশের ভেতর প্রেরণ করছিল এবং যত দিন সম্ভব সেখানে অবস্থান করার নির্দেশ দিচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সব উপায়ে শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য বেসামরিক লােকজনকে সাহস জোগানাে। কিন্তু প্রায়ই এই কৌশল বয়ে আনছিল বিপরীত ফলাফল।
জনশক্তির এই নিষ্ফলা অপচয়ের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত, তারা যথারীতি সেনাবাহিনীর চাপ প্রয়ােগ কৌশলের শিকার হতাে। কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদবঞ্চিত হন এবং তাঁদের অন্যান্য প্রশংসনীয় কীর্তি ও অস্বীকৃত রয়ে যায়। জেনারেল মাকেনশর বিশ্বাসভাজন লে. জেনারেল অরােরা বহু স্পর্শকাতর ইস্যুর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে যে ভুল করছিলেন, তার জন্য ভারতকে চরম মূল্য দিতে হতাে। তাজউদ্দীন এবং ডি পি ধরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তাকে যথেষ্ট সুবিধা প্রদান করে।
পৃষ্ঠা: ২১৪
যুবনেতারা বাংলাদেশের ভেতর তাদের বিশাল সংগঠন সূত্রে জানতে পারেন যে মুক্তিবাহিনীর কিছু ইউনিট কতগুলাে খারাপ অভ্যাস রপ্ত করেছে। কেউ কেউ জনগণের সম্পদ লুট করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, আবার কেউ ব্যক্তিগত শত্রুর বিরুদ্ধে নিচ্ছে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা। আগেই বলা হয়েছে। যে মুক্তিবাহিনীতে সব ধরনের লােককে নিয়ােগ করা হচ্ছিল, যদিও একটা সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ করছিল, কিন্তু তাদের ভেতর কেউ কেউ তিরস্কারযােগ্য কাজ করে পুরাে বাহিনীর জন্য বদনাম কুড়াচ্ছিল। তাই যুবনেতারা দৃঢ় মত পােষণ করেন যে ওঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত বাছাই করা গেরিলা নেতাদের বাহিনীর নাম হওয়া উচিত ‘মুজিব বাহিনী’, যাতে ওদের মুক্তিবাহিনী থেকে আলাদা করে চেনা যায়।
যখন আমি এই বিশেষ বাহিনীর নাম মুজিব বাহিনী রাখার প্রস্তাব দিলাম, সেটা হাইকমান্ডের কাছে গ্রহণযােগ্য হলাে না। তাদের মতে, এটা হলে বাংলাদেশের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হবে, এমনকি মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে ফাটলও দেখা দিতে পারে। আমি যুবনেতাদের ওপর কোনাে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারলাম না। ওঁরা শুধু বললেন, অন্যরা যে যা-ই বলুক এই ছেলেরা বাংলাদেশের ভেতর ‘মুজিব বাহিনী’ নামেই পরিচিত হবে। আমার সঙ্গে বিতর্কের সমাপ্তি হলাে এভাবেই, তবে উচ্চতর সেনা কমান্ড একটা আলাদা সংগঠনকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না, তার উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন। লে, জেনারেল অরােরা বলেন যে তাজউদ্দীন জানতে চাইছেন কে এই সংগঠন দাঁড় করাচ্ছেন এবং কী উদ্দেশ্যে? বাংলাদেশের ভেতর গেরিলা কার্যক্রম পরিচালনা এবং সেখানে আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনকে চাঙা করার জন্য চরম আত্মত্যাগী যুবনেতারাই এটা করাচ্ছেন—আমার এই ব্যাখ্যা তাঁকে সন্তুষ্ট করল না। সবকিছুই তার কমান্ডের অধীনে নেওয়ার ব্যাপারে তার মনােভাব স্থির ছিল, আর তাই অন্য সব যুক্তিতর্ক এখানে ছিল নিরর্থক। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ স্বভাবতই তার পরামর্শমতাে চলতেন, একবার কলকাতায়। তিনি আমার সঙ্গে খুব কঠোর ব্যবহার করেন। আমি বুঝতে পারি কেউ তাঁকে বুঝিয়েছে যে আমি আমার নিজস্ব কমান্ডের অধীন একটা বাহিনী গঠন করার জন্য এই যুবনেতাদের ব্যবহার করছি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য অথবা অন্ততপক্ষে আমার মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি হাইকমান্ডের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণের ব্যাপারে যুবনেতাদের চাপ প্রয়ােগের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়। তারা এসব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এজাতীয় চাপের প্রতি ওঁদের দৃঢ় ও ক্রুদ্ধ মনােভাবের কারণে এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্রমাগত আমার ওপর চাপ প্রয়ােগ অব্যাহত থাকে, যেহেতু আমি চাকরিরত ছিলাম।
পৃষ্ঠা: ২১৫
এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার ব্যাপারটা ফয়সালা করার জন্য আমি লে. জেনারেল অরােরার সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, সীমান্তের ২০ মাইল ভেতর পর্যন্ত আক্রমণের দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর এবং আরও ভেতরের অঞ্চলের দায়িত্ব মুজিব বাহিনীর। যুবনেতারা এটাই চাইছিলেন। কিন্তু তিনি চাইছিলেন, ওঁরা তাঁর কমান্ডের অধীনে পরিচালিত হােক, যা ওঁরা মেনে নিচ্ছিলেন না।
সীমান্ত অতিক্রম করে অনুপ্রবেশের পদ্ধতির ব্যাপারে আরও একটা সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন ছিল, যেটা সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। আমরা বাংলাদেশজুড়ে সেফ হাউসসহ প্রশস্ত করিডর স্থাপন করেছিলাম, আর মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত যুব সংগঠনের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত চমৎকার যােগাযােগ তৈরি করে রেখেছিল।
লে. জেনারেল অরােরা আমার ছেলেদের ব্যবহৃত রাস্তা, সীমান্তে তাদের। প্রবেশপথ, সেফ হাউস এবং গন্তব্য সম্পর্কে জানার জন্য চাপাচাপি করতেন। সীমান্তে তাদের প্রবেশপথ সম্পর্কে জানাতে যুবনেতাদের কোনাে সমস্যা ছিল না, যাতে ওঁদের অনুপ্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য সেনা ইউনিটসমূহ সতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ওঁরা ওঁদের করিডর, সেফ হাউস এবং গন্তব্য সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি ছিলেন না, যেহেতু ওদের রাজনৈতিক শত্রু এমন বহু। মুক্তিবাহিনী নেতার অকৃত্রিমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন ওঁরা।
সেনাবাহিনীকে কিছু বলা হতাে না, যেহেতু মুক্তিবাহিনী ওদের কমান্ডের অধীন ছিল এবং মুক্তিবাহিনীকে সবকিছু জানতে দিতে ওরা ছিল বাধ্য।
শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে একটা আপসমূলক সমাধানে ওঁদের রাজি করানাে গেল যে ওঁরা সীমান্তে ওঁদের প্রবেশপথ সম্পর্কে কেবল স্থানীয় সেনা কমান্ডারকে জানাবেন, যিনি ওঁদের প্রবেশের অনুমতি দেবেন। এই ব্যবস্থা সম্পর্কে সব সেনা ইউনিটকে কমান্ড হেডকোয়ার্টারের জানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। আমরা সপ্তাহ কয়েক অপেক্ষা করলাম, যাতে সেনা ইউনিটগুলাে এই ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে এবং লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়ােজিত এসএফএফের সেনা অফিসারদের মাধ্যমে স্থানীয় ফরমেশন এবং ইউনিট কমান্ডারদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে পারে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ সহজতর করার জন্য এসএফএফের লে. কর্নেলদের সীমান্তসংলগ্ন স্থানে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। যােগাযােগ স্থাপন করা হয়েছে কিন্তু সেনা কমান্ড তাদের ইউনিটসমূহের জন্য। কোনাে নির্দেশ প্রদান করেনি, এ রকম রিপাের্ট পাওয়ার পর আমি ব্যাপারটা আবার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে জানাই। তিনি যখন লে.
পৃষ্ঠা: ২১৬
জেনারেল অরােরার কাছ থেকে জানতে চাইলেন যে নির্দেশ প্রদান এবং যথাযােগ্য যােগাযােগ স্থাপন করা হয়েছে কি না। তিনি জানান যে আমার। কোনাে অফিসার তার কমান্ডারদের সঙ্গে দেখা করেনি এবং তিনি তাঁর। কমান্ডের অধীন সব ফরমেশনের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন। আমি যখন আমার অফিসারদের সাক্ষাতের সঠিক তারিখ এবং সময় জানালাম, সেনাপ্রধান খুব বিস্মিত হলেন এবং লে. জেনারেল অরােরাকে আবারও জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নিশ্চিত করেন যে আমার অফিসাররা তার কমান্ডারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তবে সে তথ্য তাঁকে জানানাে হয়নি।
এটা একটা সামান্য ঘটনা এবং আমি এ ঘটনা উল্লেখ করতাম না। কিন্তু পরে আমরা আবিষ্কার করি যে কমান্ড হেডকোয়ার্টারের সদস্যরা সেনাপ্রধানের কাছে মুজিব বাহিনীসংক্রান্ত তথ্যাবলি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করত ইচ্ছাকৃতভাবে। এর ফলে সেনাপ্রধান ও তাঁর ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশনের (ডিএমও) কাছে মুজিব বাহিনীসম্পর্কিত প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার জন্য আমাকে বেশ কয়েকবার সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। মেজর জেনারেল কে কে সিং, যিনি সেনাসদরের ডিএমও হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন মেধাবী অফিসার এবং মুজিব বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও তাদের প্রতিশ্রুতিশীলতা সম্পর্কে খুব ভালােভাবে বুঝতে পারেন তিনি। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি খুব সাহায্যে লেগেছেন।
জেনারেল কে কে সিং সেনাপ্রধানের তরফ থেকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ এবং এই বাহিনীকে কী কাজে লাগানাে যায়, সে বিষয়ে লে. জেনারেল অরােরার কাছে খুব প্রাঞ্জল একটা নােট পাঠান। এই নােট পাঠানাে সত্ত্বেও অবিরাম বিবাদে পরিহারযােগ্য অন্তর্দাহ রয়ে যায়।
ভাষান্তর : ফারুক মঈনউদ্দীন
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান