You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.16 | চরমপত্র ১৬ জুন ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

ওদিকে দম্ মওলা কাদের মওলা হয়ে গেছে। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের ভাণ্ডাটা ফুটা হয়ে গেছে। কত কষ্ট আর পেরেশানের মধ্যে প্ল্যান করা হলাে। রাস্তাঘাটে যাতে করে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্ন দেখতে না পায়, তার জন্যে হেলিকপ্টারে সফরের ব্যবস্থা হলাে; অন্য কাজ বন্ধ রেখে বেছে বেছে ভদ্রলােকের মতাে চেহারাওয়ালা আর চৌকশ কথা বলতে পারে এমন সব অফিসারদের পাঠিয়ে কসাইখানাগুলাে আরে নাঃ নাঃ নাঃ Reception counter- গুলাে সাজানাে হলাে। আর কত কষ্টে গেরামের মধ্যে থেকে কিছু জ্যান্ত বাঙালি ধরে এনে রিফুজি হিসেবে দেখানাে হলাে। বেড়াদের পােলাও-কোর্মা কত কিছু খাওয়াইয়া খুশি করা হলাে! আর সেই বেডাগুলা কিনা মাত্র

৭০

ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে উলডা-পাল্টা কথা কইলাে । কলিকাল, অহন অক্করে কলিকাল পড়ছে। না অইলে, হের জাতভাইগাে দিয়া কত রকমের কথা কওয়াইয়া হেগাে চ্যাতইলাম। তবুও বেডাগুলা অওগৃগা কথার মধ্যে আমাগাে আসল কামডা সারলাে।

হ্যা ঠিকই ধরেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের কথাই বলছি। বেচারা সদরুদ্দিন। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় Reception counter গুলাের ঝঝকে তক্তকে অবস্থা দেখে চমকৃত হয়েছেন। বার বার করে সেই সার্টিফিকেটই দিলেন। বললেন, ইসলামাবাদ সরকার বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় আসল শরণার্থীদের জন্য জব্বর এন্তেজাম করেছেন। ভাইয়া লােকসব হায় বাঙালি! হায় বাঙালি! বলে জিগির তুলেছেন। কেননা অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে বাঙালি শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে, বিশ্বের সমস্ত দেশের সাহায্য সব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। 

তাই দশ লাখ বাঙালিকে হত্যা, পঞ্চাশ লাখকে দেশত্যাগ আর দু’কোটি বাঙালিকে বাস্তুচ্যুত করবার পর সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এখন নতুন ভ্যাস্ ধরেছেন। তারস্বরে চিৎকার করেছেন, ভাইসব আইস্যা পড়ুন। আইস্যা দেখফাইন, আনাগাে লাইগ্যা কেমন সুন্দর ব্যবস্থা করছি। শুধু এখানেই শেষ নয়, জঙ্গী সরকার এবার জাতিসংঘের কাছ থেকে কিছু মাল-পানি কামাবার জন্য একটা নতুন প্ল্যান Submit করেছে। ইয়াহিয়া সরকার বলেছে, দেশের সংহতি রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে দু’কোটি লােককে বাস্তচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পূনর্বাসনেরর জন্যে টাকা চাই। কি অদ্ভুত এ অপূর্ব যুক্তি। একথাটা প্রকাশ করে প্রিন্স সদরুদ্দিন বলেছেন যে, ঢাকায় তার প্রতিনিধি এখন এই পরিকল্পনা পর্যালােচনা করে দেখছেন। ইয়াহিয়া সরকার এখন লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বসে আছেন। টাকা, টাকা করে হগল কথাই ফাঁস করে দিয়েছেন। 

এরা প্রথমে বলেছিল যে, ভারত সরকার মিথ্যে কথা বলছে। কোনাে শরণার্থীই সীমান্তের ওধারে যায়নি। কলকাতার ফুটপাথ থেকে কিছু বেকার লােককে ধরে এনে শরণার্থী শিবিরে রেখে ভারত Propaganda চালাচ্ছে। কিন্তু যখন সমস্ত বিশ্ব একমত হয়ে মত প্রকাশ করলাে যে, মানবজাতির ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বেশি শরণার্থী আর কোনাে সময় দেশত্যাগ করেনি। অমনি সােনার চাদ পিলা ঘুঘুর দল বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় অক্করে Reception counter খুইল্যা মেসিনগান- মাফ করবেন, মাইক ফিট করে বইস্যা রইলেন। আর সদর ইয়াহিয়া বলতে লাগলেন ‘আসল পাকিস্তানীরা ফিরে আসলে তার কোনােই আপত্তি নাই। যেমন উনি ধরে নিয়েছেন তার এই দাওয়াতের চোটে লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী ফিরে আসবেন। শুধু তাই-ই নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিকও এসে হাজির হবেন। কি চমৎকার চিন্তাধারা। মুরগি ঠোটের মধ্যে চাকু লইয়্যা ফেকু ওস্তাগার লেনে অনেক পেরেশান কইর‌্যা কসাই-এর বাড়িতে হাজির হইলাে। অহন খালি কষ্ট কইর‌্যা আড়াইড্য পোঁচ

৭১

দেওন বাকি আর কি! 

এদিকে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার এত দিনে কবুল করলেন যে, হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপায়ে পড়ায় বেশি না মাত্র দু’কোটি লােক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের দোহাই পেড়ে যদি জাতিসংঘের কাছ থেকে কিছু খসানাে যায়। কেননা মালপানির অভাবে যে ওদের অবস্থা এখন একেবারে ছেরাবেরা হয়ে গেছে। হানাদার বাহিনীর লােকদের এর মধ্যেই পুরাে বেতন দেয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। শতকরা পঁচিশ ভাগ বেতন আজকাল কি বলে Defence Savings Certificate-এ দেয়া হচ্ছে। এভাবে ভাড়াটিয়া হানাদার বাহিনীকে কতদিন ঠিক রাখা যাবে কে জানে? অবশ্য টিক্কা সাব’ এদের বলেছেন, যা পারাে লুটে নাও। কিন্তু কারবারটা আরেক জায়গায় খতর নাক হয়ে গেছে। পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার নােট বেআইনী করায় হানাদার বাহিনী এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন যে এতদিন ধরে তারা টাকা মনে করে যা লুট করেছিলেনসেগুলাে টাকা নয়- সেগুলাে হচ্ছে কাগজ। তাই পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় একেবারে হাহাকার পড়ে গেছে। চারদিকে শুধু একটাই আওয়াজ ইয়া আল্লাহ গজব নাজেল হাে গিয়া। হায় ইয়াহিয়া তুমনে ইয়ে কেউ কিয়া? যাক, যা বলছিলাম। সাংবাদিকরা হচ্ছে যত নষ্টের মূল। জাতিসংঘের প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখান গত মঙ্গলবার পশ্চিমবাংলার রিফিউজি ক্যাম্পগুলাে পরিদর্শন করতে গেলে সাংবাদিকরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে হেতাইনেরে অক্করে কাইত কইর‌্যা ফেলাইছেন। তাঁরা প্রশ্ন করলেন, কত শরণার্থী ফিরে গেছে? প্রিন্স একটু মিষ্টি হেসে বললেন, ‘তা তাে বলতে পারি না। ওরা যে Figure দিয়েছে, সেটাই আমাদের গ্রহণ করতে হয়েছে। আবার প্রশ্ন হলাে, ‘ঢাকা, যশাের, কুমিল্লা প্রভৃতি জায়গায় কি আপনি বাংলাদেশের ভয়াবহ চেহারা দেখেননি?’ এবারে উত্তর এল, যেখানে এত বড় একটা ঘটনা ঘটলাে, তার চিহ্ন কি এত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলা যায়। সেখানে আমি অনেক পোেড়া ঘরবাড়ি দেখেছি। লাখ লাখ সর্বহারা শরণার্থীদের মাঝ দিয়ে প্রিন্স সদরুদ্দিন যখন গাইঘাট শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করছিলেন, তখন হঠাৎ করে এক তরুণী-নাম তার হাসিনা- একটা এগারাে মাসের বাচ্চা কোলে প্রিন্সের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার স্বামী সিরাজুল হক ছিলেন ঢাকার রমনা থানার দারােগা। ২৫শে মার্চ রাতেই নরপশুর দল রমনা থানা আক্রমণ করে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমার সােনার সংসার জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ক্যানাে? কে এর জবাব দেবে? কে এর ক্ষতিপূরণ করবে?’ |

কোনাে জবাবই দিতে পারলেন না প্রিন্স। শুধু ক্ষণিকের তরে চোখ দুটো তাঁর ছল ছল করে উঠলাে। এরপর সদরুদ্দিন আগাখান সাংবাদিকদের বললেন, শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে সমস্যার সবচেয়ে সন্তোষজনক সমাধান। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন হলাে, কিন্তু কেমন করে ফিরে যাবে?’ প্রিন্স বললেন, আমি রাজনীতির বিতর্কে জড়িয়ে। পড়তে চাই না। আমার এজেন্সি মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ। বনগাঁ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ শরণার্থীদের আর্ত চিৎকারে তিনি ক্ষণিকের তরে দো-মনা হয়ে পড়লেন। পকেটের সাদা

৭২

রুমালটা বের করে মুখের ঘাম মুছে বেডে শুয়ে থাকা যশােরের কোট চাঁদপুরের বৃদ্ধা পুঁটি মনির বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া পা-দুটোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

আবার তার যাত্রা শুরু হলাে। এবার বয়ড়া সীমান্ত। কিন্তু পথেই হেলেঞ্চায় একদল শরণার্থী তার গাড়ি থামিয়ে দিলেন। একজন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, মাত্র গত বুধবার যখন নরঘাতকের দল তার গ্রাজুয়েট ভাইকে মাটির নিচে গলা পর্যন্ত পুতে মেসিনগান চালিয়ে হত্যা করলাে, তখন তারা নিঃস্ব হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। দুপুরের কড়া রােদের বয়ড়া সীমান্তে দাঁড়িয়ে সদরুদ্দিন আগাখান দেখলেন তাঁর সামনে দিয়েই বাঙালি শরণার্থীদের কাফেলা এগিয়ে আসছে। ওরা হিন্দু নয়, ওরা মুসলমান নয়, ওরা মানুষ, ওরা আল্লাহর বান্দা। ওদের ফরিয়াদে খােদার সাত আসমান পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। তাঁর সঙ্গের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, শরণার্থীরা দেশে ফিরে গেলে আমি নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারি না। আমি তাে আর Prophet নই।’ তাই। বলেছিলাম ওদিকে দম মওলা, কাদের মওলা হয়ে গেছে। প্রিন্স সদরুদ্দিন অউগগা কথার মধ্যে হেগাে আসল কামডা সাইর্যা ফ্যালাইছে।।