শ্রীরামসি গণকবর
১৯৭১ সালের ৩১শে অগাস্ট সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে পাক হানাদার বাহিনী ৭/৮টি নৌকা যোগে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি বাজারে আসে এবং স্থানীয় রাজাকারদের দিয়ে গ্রামবাসীদের শ্রীরামসি হাইস্কুল মাঠে শান্তি কমিটির সভায় সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য খবর দেয়। গ্রামবাসীরা সেদিন স্কুল মাঠে সমবেত হয়। যারা আসতে দেরি করেন তাদেরকেও ডেকে আনা হয়। এরপর পাকসেনারা ১০/১২ জন করে বিদ্যালয়ের মাঠে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে লাইন ধরিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি, কর্মচারী, যুবক, সাধারণ গ্রামবাসী। নারকীয় এ হত্যাকান্ডের পরপরই পাকসেনারা শ্রীরামসি গ্রামে ঢুকে গ্রামের প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ভীত স্বন্ত্রস্ত অবশিষ্ট গ্রামবাসী গ্রাম ছেলে পালিয়ে যায়। শহীদদের লাশগুলো দাফনের অভাবে কুকুর শেয়াল টানা হেঁচড়া করে। ঘটনার ৪/৫ দিন পর কয়েকজন গ্রামবাসী ফিরে লাশগুলো একটি গর্তে পুঁতে রাখে। সেদিন হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে ১২৬ জনকে হত্যা করে। শ্রীরামসি হত্যাকাণ্ডের শহীদদের আংশিক তালিকা- শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদ উদ্দিন আহমদ, ওই বিদ্যালয়ের প্রধান মাওলানা আ. হাই, শহীদ সতেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী (তহসিলদার), শহীদ এহিয়া চৌধুরী (সহকারী তহসিলদার), শহীদ সৈয়দ আসরাফ হোসেন (পোস্ট মাস্টার), শহীদ আ. বারী (ইউপি সদস্য), শহীদ ফিরোজ মিয়া (প্রবাসী), শহীদ এখলাছুর রহমান (দিঘীর পাড়), শহীদ সামসু মিয়া (সাতহাল), শহীদ আব্দুল জলিল (সাতহাল), শহীদ আলা মিয়া (সাতহাল), শহীদ ওয়ারিস মিয়া (সাতহাল), শহীদ ছুয়াব মিয়া (সাতহাল), শহীদ আব্দুল লতিফ (সাতহাল), শহীদ রইছ উল্যা (সাতহাল), শহীদ দবির মিয়া (আব্দুল্লাহপুর), শহীদ মরম আলী (সদা ভাই), শহীদ মন্তাজ আলী, শহীদ মজিদ মিয়া (রসুলপুর), শহীদ ডা. আব্দুল মান্নান, শহীদ সুনু মিয়া, শহীদ নজির মিয়া, শহীদ অজ্ঞাত পরিচয় দর্জি (রসুলপুর), শহীদ ছামির আলী (পশ্চিম শ্রীরামসি), শহীদ রূপু মিয়া (শ্রীরামসি), শহীদ রুস্তম আলী (শ্রীরামসি), শহীদ আছা মিয়া (শ্রীরামসি), শহীদ তৈয়ব আলী (শ্রীরামসি), শহীদ রোয়াব আলী, শহীদ তফজ্জুল আলী, শহীদ মছদ্দর আলী, শহীদ অজ্ঞাত পরিচয় (শিক্ষক শ্রীরামসি মডেল প্রাইমারি স্কুল), শহীদ অজ্ঞাতনামা পোস্ট মাস্টার (শ্রীরামসি ডাকঘর), শহীদ অজ্ঞাতনামা ডাকপিওন (শ্রীরামসি ডাকঘর), শহীদ মোক্তার মিয়া (চকসিপুর), শহীদ অজ্ঞাতনামা সহকারী কর্মকর্তা (শ্রীরামসি বাজার), শহীদ আ. মন্নান (হবিবপুর),শহীদ নুর মিয়া, শহীদ জহুর আলী। অন্য শহীদদেও নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। ১৯৭৩ সালে সরকারের পক্ষ থেকে শহীদের স্মরণে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের দিনটি এখানে আঞ্চলিক শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। (তথ্য সংগ্রাহক: জগন্নাথপুরের সাংবাদকর্মী আলী আহমদ)
অন্যান্য সূত্রেও এ হত্যাকান্ডের বর্ণনা রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পূর্ব প্রান্তে শ্রীরামসি একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল নয়টায় ৭/৮টি নৌকা বোঝাই হয়ে পাকসেনারা এদেশীয় কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে শ্রীরামসি গ্রামে এসে পৌছে। সকাল দশটায় তারা প্রায় পুরো গ্রাম ঘেরাও করে শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায়। এই আহবানে তারা সাড়া না দিলে, পাকসেনাদের অস্ত্রের মুখে বহু গ্রামবাসীকে ধরে আনা হয় শ্রীরামসি স্কুল মাঠে। এই মাঠে তাঁদের সবাইকে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১২৪-১২৫; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪৩২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, চতুর্থ খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১৪৮-১৫০; সিলেটে গণহত্যা – তাজুল মোহাম্মদ, পৃ.-১০৫-১০৮)