You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভোটমারী বধ্যপুকুর

লালমনিরহাটের সবচেয়ে বড় বধ্যপুকুরটি কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারীতে। ভোটমারী রেলস্টেশনের উত্তর-পূর্বের মেঠো পথ ধরে মিনিট সাতেক হাটলেই সেখানে পৌছানো যায়। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মাস্টারের বাড়ির সামনের বাঁশ বাগান ও ঝোপ ঝাড় বেষ্টিত ছোট একটি মজা পুকুর একটি। পুকুরটি যে অবহেলিত তা দেখলেই বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধের লাখো মানুষের আত্মত্যাগের নীরব সাক্ষী এই পুকুর। সারা দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজছিল ঠিক সেই সময় পুকুরটিতে চলছিল নির্বিচারে গণহত্যা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে। পাক হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও তার দোসররা হাতিবান্ধা উপজেলার বড় খাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ভাঙ্গতে না পেরে ভোটমারী রেলস্টেশন সংলগ্ন ভাকারি এলাকার রেলসেতুর কাছে ক্যাম্প করে। সেখান থেকেই তারা মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালায়। লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, দিনমজুরসহ সর্বস্তরের মানুষদের ধরে এনে জবাই করে পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেয় তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিদিনই ১৫/২০ জন নারী-পুরুষকে গরু-ছাগলের মতো জবাই করে পুকুরটির পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। লাশগুলো একটার পর একটা পাট জাগের মতো ভাসতো। ওই সময় এই বাসিন্দারা বাড়ি ছেরে পালিয়ে থাকলেও মাঝেমধ্যে গোপনে পুকুর পাড়ে গিয়ে এসব বীভৎস দৃশ্য দেখে আসতো। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে এ খবর পৌছে দেয়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাতের পর রাত তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারে এসব হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা স্থানীয় রাজাকার ওসমান মৌলভী। আর এই ওসমান মৌলভী ৩/৪ জন সঙ্গীসহ প্রতি সকালে বধ্যভূমি এলাকায় এসে ওই হত্যাকাণ্ডে যোগ দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সালামের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি দল বধ্যপুকুরের ৪শ’ মিটার পূর্ব দিকে মদাতি রব্বানীয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ওৎ পেতে ওসমানের ওপর হামলা চালায়। বুলুর স্টেনগানের গুলিতে খতম হয় এই লোকটা। এরপর আর ওই পুকুরে কোনো গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, কাকিনার আমজাদ হোসেন, জোবেদ আলী, মানিকসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করে তাঁদের লাশ বধ্যপুকুরটিতে ফেলা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট শত্রু মুক্ত হয়। স্থানীয় লোকজন বাড়িতে ফিরে আসে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বধ্যপুকুরটি দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। তারা এসে দেখতে পায় সেখানে অসংখ্য মানুষের হাড়, মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মাস্টার যুদ্ধ শেষে বাড়ি এসে দেখতে পান মানুষের কঙ্কাল, হাড়, মাথার খুলিগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মানুষের সবগুলো কঙ্কাল সংগ্রহ করে একটি গর্ত করে পুঁতে রাখেন তিনি। আর পুকুরটির নাম দেন “বধ্যপুকুর”।

বধ্যপুকুরটিতে তেমনভাবে চিহ্নিত হয়নি। পুকুরটি যেমনি ছিল তেমনি রয়ে গেছে। এখনও পুকুরটিতে কেউ নামে না কিংবা পুকুরের মাছ ধরে খায়ও না।

২০০৮ সালের ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বধ্যপুকুরটিতে স্মৃতি সোউধ “আত্মত্যাগের মিছিল” নির্মানের ভিত্তি স্থাপন ও ফলক উন্মোচন করা হয়।

গত ৪ বছর ধরে ১৫ ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বধ্যপুকুরে পুষ্পমাল্য অর্পন করা হয়। লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার জয়দেব চন্দ্র রায়, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মাস্টারের দাবি স্বাধীনতার জন্য গ্রামগঞ্জের অনেকেই যারা যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে, কীর্তি রেখেছে ইতিহাসে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হোক তাঁদের নাম।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!