You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোইল গণকবর

এপ্রিলের মাঝামাঝি সারা রাজশাহী তখন যুদ্ধের ভয়াবহতার স্থবির। রাজাকার, শান্তি বাহিনী ও বিহারীদের নিয়ে পাক হানাদাররা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে। রাজশাহীর শিরোইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এলাকায় তখন অবাঙালি বিহারিদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। মসজিদের সামনে নিউডিগ্রী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বৈলায়েত আলী ও এলাকায় ডাক্তার খ্যাত এক ব্যক্তির বাড়িতে পাক হানাদাররা ক্যাম্প করেছে। (ওই ডাক্তারের নাম কেউ বলতে পারেনি। সবাই তাকে ডাক্তার বলেই চেনে) এই বাড়ি দুটি ছিল ঐ এলাকায় পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। বিহারিদের সহায়তায় আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে তাঁদের জবাই করা হতো বেলায়েত আলীর বাড়িতে। বাড়ির পিছনে ছিল ফাঁকা মাঠ আর তার একটু দূরেই ডাক্তারের বাড়ি। বাড়ির পিছনে মাঠের মধ্যে একটি ছোট পুকুর ছিল। পাক সেনারা তাঁদের চোখে সন্দেহভাজনদের ধরে এনে নির্মম অত্যাচার করে জবাই করে ও গাছে উলটো করে ঝুলিয়ে হত্যা করত। পরে লাশ গুলো পুকুরের পাড়ে ডাক্তারের বাড়ির উঠান সংলগ্ন স্থানে একটি মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলত। তাছাড়া পুকুরের পাড়ে ও মাঠের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গর্ত করে ৩/৪টি লাশ একসঙ্গে পুঁতে ফেলত।

শিরোইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের অদূরেই কাজী আশরাফ উদ্দিনের বাড়ি। তার বড় ছেলে কাজী মেসবাউল আলম তখন (২১) টিএন্ডটি অফিসে অপারেটর হিসেবে কাজ করত। মহল্লার মধ্যে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে কাজ করতেন। টিএন্ডটি অপারেটর হবার সুবাদে অনেক গোপন খবর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রিম জানিয়ে দিতেন। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে যান তিনি। পাকবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় পাশেই তাঁদের ডাক্তারের বাড়ির ক্যাম্পে। রাতে বিহারিরা তাঁদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাকে হত্যা করা হয়।

যুদ্ধ শেষ হলে ডাক্তার বাড়ির উঠানে একটি গণকবরের সন্ধান মেলে। শহীদ কাজী মেসবাউল আলমের ছোটভাই কাজী মোস্তাফিজুর আলম বলেন, “১৬ ডিসেম্বরের পরে ডাক্তার বাড়ির উঠান সংলগ্ন ট্রেঞ্চ এবং পুকুরের পাড় থেকে এলাকাবাসী প্রায় ৫০/৬০টি পচা গলিত লাশ উদ্ধার করে। কিন্তু আমার ভাইকে আমরা কেউ সনাক্ত করতে পারিনি। সেদিন যারা আপনজনের লাশ সনাক্ত করতে পেরেছিলেন তারা লাশ নিয়ে গিয়ে নিজস্বভাবে দাফনের ব্যবস্থা করেন। আর যে লাশগুলো সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি সেই লাশগুলোর হাড়গোড় নিয়ে তৎকালীন ইম্পিরিয়াল বর্তমানে শিরোইল ক্লাবে রাখা হয়। পরবর্তীতে রাজশাহী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সেগুলো সংগ্রহ করে টিকাপাড়া গোরস্থানে সমাহিত করেন”।

বর্তমানে সেই ডাক্তার বাড়িতে বসবাস করছেন রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত একাউন্টেন্ট শীষ মোহম্মদ ও তার পরিবার। গণকবরের সেই জায়গাটি এখন তার বাড়ির উঠান। যত্ন করে লাগানো হয়েছে কাগুজি লেবুর গাছ। (তথ্যসূত্র: কাজী মোস্তাফিজুল আলম, শহীদ পরিবারের সদস্য ও মো. আসলাম আলী)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!