You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমি

১৯৭১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাক হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়ে আশপাশের শত শত গ্রামবাসী, ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, মহিলা, বৃদ্ধসহ স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সামসুজ্জোহা হলের আধা কিলোমিটার দূরে দেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভুমিটির অবস্থান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের শেষ রাতে পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ করে। প্রশাসনিক ভবনের নৈশ্য প্রহরী আব্দুর রাজ্জাকের গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। এরপর পাক বাহিনীর এই দলটি রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়। ১৩ এপ্রিল পাক সেনারা একটি বিরাট বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে তারা এবার শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে বানায় নির্যাতন কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-কর্মচারীদের হত্যা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে তৎকালীন ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, গনিত বিভাগের শিক্ষক ড. হাবিবুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুম, হিসাব বিজ্ঞানের উচ্চমান সহকারী এস এস সাইফুল ইসলাম, স্টুয়ার্ড শাখার প্রহরী নূরু মিয়া, সুইপার মোহনলাল, অরিবহন শাখার চালক আবুল আলী, প্রকৌশল দপ্তরের কাঠ মিস্ত্রী শফিকুর রহমান, উপাচার্য দপ্তরের পিয়ন মোহম্মদ ইউসুফ, প্রহরী আফজাল মৃধা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের অর্ডারলি ওয়াহাব আলী, আইন  বিভাগের বেয়ারা আবুল মালেক, ভূগোল বিভাগের প্রহরী কোরবান আলী।

ছাত্রদের মধ্যে বানিজ্য বিভাগের ছাত্র মোহন আখন্দ ও শাহজাহান আলী, বাংলা বিভাগের আমিরুল হুদা জিন্নাহ, গোলাম সারোয়ার সাধন, রসায়ন বিভাগের প্রদীপ কুমার রাহা ও রেজাউল করিম, অর্থনীতির মোহাম্মদ আলী খান, পদার্থ বিজ্ঞান পূর্বভাগের মিজানুল হক পিয়ারা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র নুরুজ্জামানসহ আরও নাম না জানা অসংখ্য ছাত্র জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক আব্দুল মান্নান সরকার ১১ অক্টোবর সীমান্ত এলাকা থেকে অভিযান শেষে রাজশাহী মহানগরীর বালিয়া পুকুর এলাকায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার, শান্তি কমিটি এবং বিহারিদের নিয়ে গঠিত সিএফ বাহিনী ১৬ অক্টোবর ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য এই এলাকায় অভিযান চালায়। সেই অভিযানে আব্দুল মান্নান সরকার, মুক্তিযোদ্ধা মীর রহমত আলী ওরফে তেতু মিয়া এবং মুসল্লিদের ধরে নিয়ে যায় জোহা হলে। জোহা হলে পৌছাবার পর আব্দুল মান্নান সরকার দেখতে পান সেখানে আরও অসংখ্য মানুষ সেখানে বন্দি। তাঁদের মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নেতা ভাষাসৈনিক আতাউর রহমান ও বাবর আলীকে দেখেন তিনি। জোহা হলে তাঁদের প্রায় এক সপ্তাহ আটকে রেখে চলে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন। মীর রহমত আলী ওরফে তেতু মিয়াকে তারই সামনে পিটিয়ে, হাতের ও পায়ের আঙ্গুলের মাথায় আলপিন ফুটিয়ে দেওয়া হয়। তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ জানার জন্য শেষ পর্যন্ত তার চোখ উপড়ে ফেলে এক বিহারি। তবুও সেদিন স্বীকারোক্তি দেননি তিনি। চোখ উৎপাটনের পরে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর তারা আব্দুল মান্নান সরকারকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ জানার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করে। তার হাত ও পায়ের নখ প্লায়ার্স দিয়ে উপড়ে ফেলে পাকহানাদাররা। নির্যাতনের এক পর্যায়ে পাকসেনারা তাকে মৃত মনে করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে দিয়ে আসে জোহা হলেন পাশে জেবের মিয়ার ইটভাটায়। সন্ধ্যার একটু আগে জ্ঞান ফিরলে নিজেকে তিনি লাশের স্তূপের ভিতরে আবিষ্কার করেন। চারদিকে অসংখ্য লাশ, তরতাজা লাশ, পচা-গলিত-বিকৃত লাশ। সেখান থেকে অনেক কৌশলে তিনি নিজেকে রক্ষা করেন সেদিন। এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র: মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান সরকার ও শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, রাবি)

অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পেছনে দীর্ঘ এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে এই বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে বহু নারী-পুরুষকে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করেছে। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল এই হলের পূর্ব কোণে আধ-মাইল দূরে আবিষ্কৃত হয় একটি গণকবর। এখান থেকে একুশটি মাথার খুলি, অসংখ্য নরকঙ্কাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় জনগন জানান, পাকসেনারা জোহা হলের এই বধ্যভূমিতে প্রতিদিন অগণিত নারী-পুরুষকে হাত বাঁধা অবস্থায় হত্যা করতো। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৭১-৭২; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৬; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, চতুর্থ খণ্ড মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১২৮; দৈনিক বাংলা, ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১০ মে ১৯৭২; দৈনিক বাংলা, ১৬ মে ১৯৭২)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!