আজ একটা ছােট্ট কাহিনী দিয়ে শুরু করা যাক। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। তখন কলকাতা থেকে স্টেটম্যান বলে ইংরেজি কাগজটা আমাদের বাংলাদেশে বিক্রি হতাে। একদিন হঠাৎ করে দেখা গেল যে, এই Stateman পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় একটা ছােট্ট সংবাদ ছাপানাে হয়েছে। সংবাদটা হচ্ছে ঢাকার বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হওয়ায় সমস্ত মাছ মরে গেছে। আর যায় কোথায়? ইডেন বিল্ডিংস-এ ডিরেক্টর অব । পাবলিক রিলেসন্স অফিসে জোর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। পেপার Clippings থেকে। শুরু করে নতুন ফাইল তৈরি হলাে। Very Urgent-এর লাল Flap দেয়া ফাইল Noting-এ ভরে গেল। পূর্ব বাংলার অবাঙালি চিফ সেক্রেটারি প্রেসনােট ইস্যু করবার। নির্দেশ দিলেন। প্রেসনােটে বলা হলাে, ভারতীয় সংবাদপত্রের নির্লজ্জ আর মিথ্যা। প্রচারণা। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষিত হয়নি এবং মাছও মরেনি। পাকিস্তানের
৪৬
সংবাদপত্রগুলােতে ফলাও করে এ সংবাদ প্রকাশিত হলাে আর বেতার কেন্দ্রগুলাে কয়েক দফায় এই একই প্রেসনােট প্রচার করলাে। কিন্তু মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মাথায় পূর্ব বাংলার অবাঙালি চিফ সেক্রেটারি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসলেন। পুরাে attack টাই Misfire হয়ে গেছে। লেজ তুলে ভালাে করে দেখাই হয়নি যে, এটা খাসী না পাঁঠা ।
স্টেটম্যান কাগজে আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে’-এ নামে একটা কলাম রয়েছে। আর সেই কলামেই ছাপানাে হয়েছে যে, পঁচাত্তর বছর আগে ঠিক এই দিনে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষিত হওয়ায় মাছ সব মরে গেছে। সংগে সংগে order হলাে চাপিস- অর্থাৎ কিনা চেপে যাও।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অধিকৃত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের এখন এই চাপিস্-এর অবস্থা হয়েছে। এক একটা Propaganda misfire করছে আর পর মুহূর্তেই তা চাপিস্ হয়ে যাচ্ছে। তাইতাে এক সময় এ বেতার কেন্দ্রের নাম হয়েছিল- ‘ইয়ে গায়েবী আওয়াজ হ্যায়। হতা খানেক আগে হানাদার হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এল ‘জোর Propaganda চালাও যে লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী পশ্চিম বাংলায় চলে গেছে বলে India সরকার যে দাবি জানাচ্ছে তা মিথ্যা। সব লােক কলকাতার ফুটপাতে পড়েছিল। সেসব বেকার লােকগুলােকে কতকগুলাে Camp-এ এনে India Government এই প্রচারণা চালাচ্ছে। দিন কয়েক পরেই order এল চাপিস্। অর্থাৎ এ Propaganda লাইনটা গড়বড় হয়ে গেছে।
কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মায় জাতিসংঘ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ বাঙালি। ভারতে চলে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাধ্যমতাে সাহায্য দেয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই কানাডা সরকার ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের জন্যে দেড় কোটি টাকা। সাহায্যের কথা ঘােষণা করেছেন। নরওয়ে সরকার ৭৯ লাখ ২০ হাজার টাকার সাহায্য মঞ্জুর করেছে। আর পশ্চিম জার্মান সরকার দুই দফায় ৪০ লাখ টাকার রিলিফের কথা প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের আবেদনেই বিভিন্ন দেশ। ভারতে চলে যাওয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্যে সাহায্য দিতে শুরু করেছে। সুইডিশ সরকার বিশ লাখ সুইস মুদ্রা মঞ্জুর করেছে। আর ফরাসি সরকার জাতিসংঘের মাধ্যমে সাহায্য দানের কথা বলেছে। এমনকি নিউজিল্যান্ড সরকার ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা রিলিফ দিয়েছেন। অমনি পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের মুখ দিয়ে লালা পড়তে শুরু করলাে। ই-ই-ই এতাে টাকা হতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
সেবার তাে বাংলাদেশে নভেম্বরের সাইক্লোনে দশ লাখ লােক মারা যাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যে নগদ ৮৫ কোটি টাকা সাহায্য এসেছিল তা গঁড়ামারা হয়েছিল । সেই টাকার জোরেই তাে মাত্র নব্বই দিনের মাথায় সংখ্যাগুরু বাংলাদেশে সশস্ত্র আক্রমণ চালানাে সম্ভব হলাে। তাই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের-advisor দের বুক মােচড় দিয়ে উঠলাে। এখন এই টাকাগুলাে হাত করার বুদ্ধি কি? অমনি আব্বাজান অর্থাৎ ইয়াহিয়াকে দিয়ে করাচীতে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করানাে হলাে।
একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে! সেনাপতি ইয়াহিয়া বাঙালি শরণার্থীদের বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় দাওয়াত করে পাঠিয়েছেন। শুধু তাই-ই নয়, ২০টা
৪৭
Reception counter খােলার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন order তেমনি কাজ। সামরিক ট্রাকে করে কিছু ছােরা, চাকু, রাইফেল আর মেসিনগান এসব Reception counter-এর সাজ-সরঞ্জাম হিসেবে হাজির হলাে। আর ঢাকার গায়েবী আওয়াজ’ থেকে হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া রব উঠলাে। ভাইসব আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা Back করুন। আপনাদের। জন্য Reception counter খােলা হয়েছে। কিন্তু কিসের কি? Reception counterএর বড় বড় গোঁফওয়ালা লােকগুলাে বসে বসে মাছি মেরে পাহাড় করে ফেললাে। তবুও একটা শরণার্থী ফিরে এল না।
বরং এদিকে এক উল্টো দুঃসংবাদ এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার অবস্থাপন্ন অবাঙালিরা প্রতি সপ্তাহে ২/৩ জাহাজ ভর্তি করে চট্টগ্রাম থেকে করাচীতে চলে যাচ্ছে। সিলেট, কুড়িগ্রাম, বরিশাল আর সাতক্ষীরা এলাকায় মুক্তিফৌজের হাতে হানাদার বাহিনী গাবুর মাইর খাওয়াতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এখন চোখে মুখে সর্ষের ফুল দেখছেন। তাই পাঞ্জাবের লেঃ জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীকে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার ইস্টার্ন কম্যান্ডের জি.ও.সি. নিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া জেনারেল নিয়াজীকে আবার ডেপুটি মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেনারেল টিক্কার শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে। বলেই এ নয়া Arrangement করা হয়েছে।
এদিকে পূর্বাঞ্চলের Nineth Infantry Division-এর প্রধান মেজর জেনারেল মােহাম্মদ নেওয়াজকে ‘অপদার্থ’ বলে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়েছে। এর জায়গায় মেজর জেনারেল শের আলী এসেছেন। গত দু’মাসের যুদ্ধে হাজার কয়েক হানাদার সৈন্য বাংলাদেশের মাটিতে নিহত হওয়ায় ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার এখন অস্থির হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের কতকগুলাে বেয়াড়া সংবাদপত্রে এসব খবর প্রকাশ হওয়াতেই সেনাপতি ইয়াহিয়ার সাঙ্গ-পাঙ্গোরা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছেন। লাহােরের ‘আফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে পাওয়া খারাপ খবরগুলাে চাপিস না করায় পাঁচ হাজার টাকা জামানত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাপ্তাহিক আফাক’ গােমর ফাঁক করে দিয়েছে।
এরা লিখেছে, বাংলাদেশে যুদ্ধ শেষ হওয়া তাে দূরের কথা, সেখানে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য মারা যাচ্ছে। আর বাঙালিদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়াতেই বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছে। আর যায় কোথায়? আফাকের’ ভিটায় এখন ঘুঘু চরছে। এদিকে লাহােরের উর্দু দৈনিক আজাদের সম্পাদক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ মালেককে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড আর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বেচারা আব্দুল্লাহ বাংলাদেশের সংবাদ চাপিস্ না করে ফাঁস করে দিয়েছিল। একেবারে আস্ত আহাম্মক আর কি? ঢাকার ‘গায়েবী আওয়াজ’ অফিস থেকে কিছুদিনের ট্রেনিং নিলেই ঠিক লাইনটা বুঝতে পারতাে। এখন Mango Gunny bag both gone! আমও গ্যালাে, ছালাও গ্যালাে! জেলও হলাে- জরিমানাও হলাে। বাছাধন কিসের পাল্লায় পড়েছাে এখন বুঝেছাে তাে?