মাস ছয়েক আগেকার কথা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে তখন এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আর সামুদ্রিক জলােচ্ছাস হয়ে গেছে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। মানব সভ্যতার
৪০
ইতিহাসে এরকম প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা আর হয়নি বললেই চলে। এই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের আট হাজার বর্গমাইল এলাকার প্রায় দশ লাখ লােক নিহত আর প্রায় ত্রিশ লাখ লােক গৃহহারা হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী নেতা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রগুলাে পর্যন্ত সাহায্যের জন্যে করুণ আবেদন করলেন। একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের সমস্ত সভ্যদেশ থেকে সাহায্য ও রিলিফ দ্রব্য এসে পৌছাতে শুরু করলাে। শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার দুর্গম দ্বীপাঞ্চলের গলিত লাশ দাফন আর রিলিফের কাজের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে দুই জাহাজ ভর্তি সৈন্য পাঠালাে।
অমনি ইসলামাবাদের জঙ্গি সরকারের টনক নড়লাে। কয়েক কোম্পানি পাক সৈন্যকে দ্রুত ঘূর্ণিবিধ্বস্ত এলাকায় হাজির হওয়ার নির্দেশ এল। দুটো উদ্দেশ্য; এক নম্বর হচ্ছে- বৃটিশ সৈন্যদের কাজকর্মের উপর কড়া নজর রাখা। আর দু’নম্বর- বিশ্বকে বােঝানাে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরাও রিলিফ কাজে লেগে পড়েছে। এধরণের পাকিস্তানী এক কোম্পানি সৈন্যের সংগে ঘূর্ণিঝড়ের দিন দশেক পর নােয়াখালীর চর বাটায় দেখা হলাে। তখন বেলা প্রায় চারটা বাজে। সমস্ত ভৌতিক এলাকাটার উপর বিকেলের পড়ন্ত রােদ এসে পড়েছে। শ’দুয়েক গজ দুরে কিছু ছাত্র আর স্বেচ্ছাসেবকের দল একটা ভেঙ্গে যাওয়া মসজিদ মেরামত করছে। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম সৈন্যদের মধ্যে খানিকটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। কোম্পানির কমান্ডার এগিয়ে যেয়ে ছাত্র আর স্বেচ্ছাসেবকদের একটু দূরে সরে যেতে বললেন আর নিজের সৈন্যদের মসজিদ মেরামতের কাজে হাত লাগাবার নির্দেশ দিলেন। দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠলাে। একটু ভালাে করে লক্ষ্য করে দেখলাম আর্মির একজন ফটোগ্রাফার দৌড়ে যেয়ে সৈন্যদের মসজিদ মেরামতের বেশ কয়েকটা ছবি তুললাে। এখানেই ঘটনার ইতি হয়ে গেল।
মিনিট পনেরাের মধ্যেই সৈন্যরা হাত ধুয়ে নােয়াখালীর দিকে ডবল মার্চ করে ফিরে চললাে। আর কমাণ্ডার সাহেব ছাত্র আর স্বেচ্ছাসেবকদের আবার তাদের কাজে হাত দেয়ার নির্দেশ দিলাে। দিন দুয়েকের মধ্যেই এসব ফটো ঢাকা, করাচী, লাহাের আর পিন্ডির সমস্ত কাগজে ফলাও করে ছাপা হলাে। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাকে কপূরের পােটলা বেঁধে কি সােন্দর ভাবে রিলিফের কাজ করছে। এটাই হচ্ছে পাকিস্তানীদের Propaganda লাইনের একটা ধারা।
এধরনের Propaganda চালাবার জন্য ইসলমাবাদ কর্তৃপক্ষের যতগুলাে মাধ্যম রয়েছে, তার মধ্যে A.PP সংবাদ সংস্থা অন্যতম। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বছরে এই সংবাদ সরবরাহ সংস্থাকে বারাে লাখ টাকা সাহায্য দিচ্ছে। এর একমাত্র কাজই হচ্ছে সরকারের সমস্ত মিথ্যা প্রচারণাগুলেকে সাজিয়ে গুছিয়ে টেলিপ্রিন্টরের মাধ্যমে খবরের কাগজ আর রেডিও অফিসে পৌছে দেয়া। তাই ২৫শে মার্চ থেকে দু’মাস ধরে অবিরামভাবে এই A.P.P. একটা খবরই দিয়ে চলেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ঢাকা এবং প্রদেশের সর্বত্র দোকান-পাট অফিস-আদালত চালু হয়েছে।
আর অমনি ঢাকার দখলকৃত বেতারকেন্দ্র থেকে তারস্বরে চিৎকার শুরু হয়ে গেল ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে দোকানপাট সব খুলে গেছে। হঁা ঢাকার দোকানপাট
৪১
সবই খােলা রয়েছে। নবাবপুর-ইসলামপুর রােড দিয়ে হেঁটে গেলেই তাে তা বােঝা যায়। কেননা এসব এলাকার সমস্ত দোকানগুলাে হয় ছাই হয়ে গেছে, না হয় খােলা রয়েছে। দোকানগুলাের দরজা নেই কিনা? তাই দূর থেকে খােলাই মনে হয়। দোকানের দরজাগুলাে ভেঙ্গে লুট করাতেই দোকানগুলাে এখন হা-করে খুলে আছে। তা দেখেই আর্মী পি.আর.ও মেজর সিদ্দিক সালেক ঢাকার পুরানা পল্টনের A.PP অফিসের দোতলায় বসে নিউজ দিচ্ছেন- পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর ঢাকার দু’হাজার সার্কুলেশনওয়ালা কাগজগুলাে বগল বাজিয়ে সেই সব সংবাদ আজও পর্যন্ত পরিবেশন করে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন সকালে আবার মেজর সিদ্দিকের মতাে লােকেরাই ছাপার অক্ষরে সে সংবাদ পড়ে খুশিতে গদৃগ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আহম্মক আর কাকে বলে!
এর সঙ্গে আবার জুটেছে হারু মিয়ার দল। হারু মিয়াদের চিনলেন না? এবারের নির্বাচনে বাঙালিদের জ্বালায় যারা হেরে গেছেন তাদেরই Shortcut-এ হারু’ মিয়া বলা হয়। হানাদার দখলকৃত এলাকায় এসব হারু মিয়ার দল এখন দারুণ active হয়েছে। সামরিক প্রহরায় কোনাে বাড়ির মধ্যে একদল অবাঙ্গালির সংগে বেঠক করেই এঁরা মেজর সিদ্দিকের কাছে দৌড়াচ্ছেন। আর অমনি সিদ্দিক সাহেব A.PP.-র মাধ্যমে সে সংবাদ জায়গা মতাে পৌছে দিচ্ছেন।
অবশ্য কয়েকটা লাইন সেখানে এই বলে জুড়ে দেয়া হচ্ছে যে, বিরাট জনসভা আর। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা। এবারের সাধারণ নির্বাচনের সময়েও এই হারু মিয়ার দল হাজারে হাজার বিরাট জলসা করেছিলেন আর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা পেয়েছিলেন। খালি ইলেকশনের result টা out হওয়ার পর জানতে পারলেন যে, তারা লাড্ড পেয়েছেন। সমস্ত বাঙালিরা দেশের শত্রু হওয়াতেই তাদের এই কুফা অবস্থা। তাই তাে এখন এই হারু মিয়ার দল নিরস্ত্র আর নিরীহ বাঙালির উপর প্রতিশােধ নেয়ার কাজে নেমেছে। কিন্তু হ্যালাে, হারু মিয়ার দল একটা কথা কাইয়্যা রাখি- ওস্তাদের মাইর কিন্তু বিয়্যান রাইতে। হপায় তাে খেলার শুরু!