You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.30 | চরমপত্র ৩০ মে ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় আজকাল একটা শব্দের বড় বেশি চল হয়েছে। শব্দটা হচ্ছে প্রাক্তন’- ইংরেজিতে যাকে বলে Ex কিংবা Former। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের। হানাদার বাহিনী এসব Former-ওয়ালাদের সংগেই খুব বেশি রকম দহরম-মহরম। চালাচ্ছেন। আজকে এসব Former লােকদের কিছু পরিচয় দিতে চাই। অবশ্য এঁদের Informer-ও বলতে পারেন। কেননা দালালীর সংগে সংগে চোলামি মার্কা খবর সংগ্রহও এদের মস্ত বড় যােগ্যতা। এদের পরিচয় দিতে যেয়ে কার নাম যে প্রথমে

৩৮

বলবাে, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। কেননা এসে এক বড়া। কাকে রেখে কার কথা বলি? যা প্রথমে শুকু্যাকে দিয়েই শুরু করা যাক। হায় আল্লাহ্, শুকুয্যাকে চেনেন না! আঁরার চাটগার শুকুয্যা। হ-অ-অ বুঝছি ফ কা কইলে চিনতে পারবেন। যিনিই শুকুয্যা তিনিই ফা কা- অর্থাৎ কিনা চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী। এই চৌধুরী সাহেব আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে একবার স্পিকার হয়েছিলেন। ব্যাস্ আর যায় কোথায়! সারা জীবনের মতাে প্যাডের মাস্তুলে নিজের নামের পাশে Former Speaker, Pakistan Parliament কথা ক’টা ছাপিয়ে ফেললেন। এবারের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জনৈক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন স্যার আপনার Election Prospect টা কি রকম? অমনি বিকট এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। গলাটা একটু নিচু করে বললেন, “আমার Result খারাপ হলে তাে Riot শুরু হয়ে যাবে। আমাদের ফ কা চৌধুরীর যেরকম দশাসই চেহারা, তেমনি মােটাবুদ্ধি। তাই Election-এর সময় উনি তার এলাকার Minority ভােটারদের পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, “আমি হেরে গেলে কিন্তু আপনাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে হবে, সে বুঝে ভােট দিবেন। এদিকে নির্বাচনের ডামাডােলে শেখ মুজিবুরের পক্ষেও আর চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চল সফর করা সম্ভব হলাে না। তাই সব্বাই ভেবেছিলেন অন্ততঃ কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব ফকা চৌধুরী এবারে নির্বাচনে জিতবেনই। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থী। অধ্যাপক মােঃ খালেদ এহেন ফকা চৌধুরীকে Election-এ ল্যাং মেরে দিলেন। তাই চৌধুরী সাহেব সেই Former Speaker-ই থেকে গেলেন। Current হওয়া আর তার কপালে জুটলাে না। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যে চট্টগ্রাম থেকে এধরনের একজন পরাজিত নেতাকে দলে ভিড়াতে পারবেন, তা একেবারে সুনিশ্চিত ছিল। ইনি এখন খালি মাঠে গদা ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর চোখে মুখে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করছেন। 

দু’নম্বরে যার কথা বলবাে তিনি নিজেই এক ইতিহাস। লােক চক্ষুর অন্তরালে তিনি পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র-রাজনীতির সংগে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। জীবনে কোনাে দিন কোনাে। প্রত্যক্ষ নির্বাচনে ইনি জয়লাভ করতে পারেননি। তাই নির্বাচন জিনিষটাকে ইনি বরাবরই পছন্দ করেননি। আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে এঁর বেশ এলার্জি আছে। এর। অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। গরমের সময় একদিন তিনি অফিসে বসে তার। পিওনকে একটা ডাব আনতে বললেন। কাচের গ্লাসে সেই ডাবের পানি খেলেন। খালি। গ্লাসটা তখনও তার টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। কিন্তু গ্লাসটার তলায় সামান্য একটু ডাবের তলানী পানি ছিল। এমন সময় পিওনটা এসে খালি গ্লাসটা নিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পরেই সাহেব গর্জন করে উঠলেন। দৌড়ে পিওন ঘরে প্রবেশ করলাে। সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন, অর্ধেক গ্লাস ডাবের পানি কি হলাে?’ পিওনের চোখ কপালে উঠলাে। বেচারা শুধু আতা আতা করে হাত দুটো কচলাতে লাগলাে। সাহেবের হুকুম হলাে, ‘ওসব বুঝি না, আমার ডাবের পানি আইন্যা দাও। পিওন মুখ কাচুমাচু করে। বেরিয়ে যেয়ে নিজের গাটের পয়সা খরচ করে ডাব কিনে এনে পরিবেশন করলাে। আর ভদ্রলােক বেশ আরামসে সেই ডাবের পানি খেলেন। হায় খােদা! এখনও একে চিনতে

.৩৯

পারলেন না। ইনিই হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ফরিন মিনিষ্টার জনাব হরিবল হক- না, না, না জনাব হামিদুল হক চৌধুরী। এঁরই পরামর্শে তাে’ এবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বস্তি এলাকাগুলাে হানাদার সৈন্যরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খা করে দিয়েছে আর হত্যার তাণ্ডব লীলা চালিয়েছে। এই হামিদুল হক চৌধুরীই তাে ঢাকার পাকিস্তান অবজার্ভার, পূর্বদেশ আর উর্দু দৈনিক ওয়াতান ছাড়াও উর্দু এবং বাংলা সাপ্তাহিক চিত্রালির মালিক। 

মে মাসের গােড়ার দিকে হঠাৎ করে একদিন দুপুরে দেখা গেল একটা লাল রঙের গাড়িতে চৌধুরী সাহেব নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে ঘুরে গেলেন। সে রাতেই নবীগঞ্জের আকাশ আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠলাে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নবীগঞ্জের শত শত সুখের সংসার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

জনাব চৌধুরী করিকর্মা লােক। তাই নিজের আইন ব্যবসা আর খবরের কাগজের ব্যবসা ছাড়াও ছাপাখানা, প্যাকেজেস ইন্ডাস্ট্রিজ, চা বাগান মায় চিটাগাং রিফাইনারির জন্য আমদানীর বিরাট ইমপাের্ট লাইসেন্স পর্যন্ত রয়েছে। আর এদিকে কবে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন- সে ঘি-এর গন্ধের কথা তিনি এখনাে বড় গলায় বলে বেড়াচ্ছেন। তিনি হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার। আর এই ফরিন মিনিস্টার থাকার সময়েই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরলােকগত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের সংগে সিয়াটো চুক্তিতে দস্তখত করেছিলেন। এছাড়া সুয়েজ খাল সংকটের সময় পাকিস্তানের এই ফরিন মিনিস্টারই সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নাসেরকে বিরাট ধাপা দিয়েছিলেন। এ ধাপ্পাবাজী ধরা পড়লে বহু বছর পর্যন্ত পি.আই.এ. বিমানের কায়রাে বিমানবন্দরে অবতরণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এ্যাই-ই যাঃ জনাব চৌধুরীর সবচেয়ে বড় যােগ্যতার কথাটাই তাে বলা হয়নি। ভারত বিভাগ হওয়ার পর পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের ইনি কিছুদিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার। পুকুর চুরি চেনেন! দিনে দুপুরে সেই পুকুর চুরি শুরু হলাে। শেষ পর্যন্ত এ্যালেন বেরির ড্রাম চুরির ব্যাপারে ভদ্রলােক অকরে হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেলেন। এই বিদিকিছুছি ব্যাপারের ঠ্যালাতেই ভদ্রলােকের অবস্থা একেবারে কেরাসিন হয়ে উঠলাে। হামিদুল হক চৌধুরীর অবস্থা একেবারে ছেরাবেরা হয়ে গেল। এখন নােয়াখালীর এহেনাে হরিবল হক চৌধুরী আর চাটিগার ফ.কা. চৌধুরীর মতাে Former লােকেরাই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর স্যাংগাৎ হয়েছেন। চোরের সাক্ষী গাঁট কাটা আর কি? কিন্তু আর কতদিন? বয়স তাে হলাে। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান এইবারে ঘুঘু তােমার বধিব পরাণ।